রাজধানীতে যানজট ভোগান্তি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে এক কোটি ৯০ লাখ কর্মঘণ্টা। যানজটে নষ্ট হওয়া অতিরিক্ত সময়ের মূল্য গড়ে ঘণ্টায় ৭০ টাকা ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ ১৩৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।  রাজধানীর সড়কে পরিচালিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

২০১৯ সালে বিশ্বের শীর্ষ যানজটপূর্ণ শহরের উপাধি জুটেছিল রাজধানী ঢাকার কপালে। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিওর প্রকাশিত ‘ট্রাফিক ইনডেক্স ২০১৯’-এ কলকাতাকে পিছিয়ে ফেলে ছিল শীর্ষ স্থান দখল করেছিল ঢাকা। এর আগে ২০১৮ ও ২০১৭ সালে সূচকটিতে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল এ শহর। আর ২০১৬ সালে তৃতীয় ও ২০১৫ সালে এ অবস্থান ছিল অষ্টম। অর্থাৎ ঢাকায় যানজটের প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি শহরের আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। তবে ঢাকায় সড়ক রয়েছে সাত-আট শতাংশ। যদিও গাড়ি চলাচলের মতো রয়েছে তিন-চার শতাংশ সড়ক। এরপরেও সড়কের উপর যেখানে সেখানে বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনেই এসব ঘটলেও পুলিশ তা দেখেও দেখে না। এ ছাড়া রাজধানীর যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের কারণেও বাড়ছে যানজট ও ভোগান্তি। অন্যদিকে, হাইওয়ে পুলিশের নির্লিপ্ততায় ঢাকায় প্রবেশের মুখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকছে গাড়ি। বিশেষ করে ছুটির দিনে ঢাকার আশপাশে সাভার, টঙ্গী, আশুলিয়া, কাঁচপুর, শিমরাইল, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সেদিকে হাইওয়ে পুলিশের কোনো নজর নেই।

গতকাল শুক্রবার দুপুর ২টা। কারওয়ান বাজার মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে, যানজটে থমকে আছে গাড়ি। অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন। কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য দাঁড়িয়ে আছেন। আরেক জন পুলিশ বক্সের ভেতরে বসে আছেন। শুধু কারওরান বাজার নয়, এমন চিত্র শাহবাগ, মৎস্য ভবন, বাংলামোটর, পান্থপথ, ফার্মগেট, আগারগাঁও, পল্টন মোড়, মতিঝিল, গুলিস্তান, মহাখালী, বনানী এলাকায়ও। ওইসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তার দু’পাশে যানজট লেগে আছে। এ অবস্থায়ও চলন্ত গাড়ির ফাঁক গলে রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা। যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকলেও সেদিকেও নজর ছিল না কারোরই। ট্রাফিক পুলিশের কোনো তৎপরতা না থাকায় সুযোগ কাজে লাগাচ্ছিলেন রিকশাচালকরাও। পথচারীদের অভিযোগ, ওই সব এলাকায় কোনো কোনো সময় রাস্তার দু’পাশের গাড়িগুলো ঘণ্টাখানেক স্থবির হয়ে থাকে।

মনির হোসেন নামের এক পথচারী জানান, কারওরান বাজার মোড়ে কোনো ফুটওভার ব্রিজ নেই। সেই জন্য লোকজন ঝুঁকি নিয়েই হেঁটেই রাস্তা পারাপার হন। তার অভিযোগ, এখানে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বসেই থাকেন, কোনো দায়িত্ব পালন করেন না। তিনি বলেন, যেহেতু ফুটওভার ব্রিজ নেই সেহেতু এখানে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব ছিল, গাড়িগুলোকে দাঁড় করিয়ে লোকজনকে রাস্তা পার করানো। কিন্তু তারাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। সে জন্য ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। এছাড়াও যানজটের সৃষ্টির হচ্ছে।

তবে মাসুদ নামের এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য ইনকিলাবকে বলেন, জনবল কম থাকায় দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খেতে হয়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য জানান, দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মাঝে মধ্যে একটু বিশ্রাম নিতে হয়। এছাড়া করোনার ভয়ে অনেকই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। অনেকেই দায়িত্ব পালন করতে এসে বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে পুলিশ বক্সে গিয়ে বসে থাকেন।

কর্মক্ষেত্রে যথাযথ মূল্যায়ন না থাকায় ও সুযোগ-সুবিধা কম পাওয়ায় অনেক ট্রাফিক সার্জেন্টই দায়িত্ব পালনের চেয়ে অসৎ উপায়ে অর্থ-উপার্জনে বেশি আগ্রহী হন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে তীব্র যানজট থাকার পরও অনেক সময় সেদিকে খেয়াল না করে সার্জেন্ট গাড়ির কাগজপত্র দেখায় ব্যস্ত থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, অযথাই গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র চেক করার নামে কতিপয় সার্জেন্ট পয়সা কামানোর ধান্ধায় থাকেন। এতে যানজটের তীব্রতা বাড়তে থাকে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর শাহবাগ, মৎস্য ভবন, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, ফার্মগেট, আগারগাঁও, পল্টন মোড়, মতিঝিল, গুলিস্তান, মহাখালী, বনানী, রমনা ও আশপাশের এলাকার সড়কগুলোতে দীর্ঘ সময় যানবাহন আটকা পড়ে সৃষ্টি হয় যানজটের। আর ওইসব এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা দায়সারা দায়িত্ব পালন করছেন। তাই ওইসব সড়কে চলাচলকারী লোকজন নিয়মিতই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

মিরপুর এলাকার বাসিন্দা জাহিদ আহমেদ জানান, তিনি মতিঝিল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এই সুবাধে সপ্তাহে প্রতিদিন মতিঝিল যেতে হয় তার। আগে তিনি মিরপুর ১০ নম্বর মোড় থেকে ফার্মগেট হয়ে বাসে করে মতিঝিল যেতেন। কিন্তু গত কয়েক মাস থেকে তিনি কচুক্ষেত হয় ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে মহাখালী হয়ে মতিঝিল পৌঁছান। এতে অনেক সময় বেঁচে যায় বলে জানান জাহিদ।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসে কারণে গত বছরের মার্চ মাস থেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তারপরও রাজধানীতে যানজট কমছে না। ট্রাফিক পুলিশের অবহেলা ও মেট্রোরেলের কাজের কারণে যানজটের এমন দশা।
শুধু জাহিদ আহেমদই নয়, শেওরাপাড়ার বাসিন্দা শারমিন বেগম বলেন, তিনি কারওরান বাজার এলাকায় একটি অফিসে চাকরি করেন। সেই সুবাধে তিনি প্রতিদিন কারওরান বাজার এলাকায় যাতায়াত করতে হয়। তবে বর্তমানে অফিসে যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যায়।

উত্তরার বাসিন্দা সাজেদুর রহমান ইনকিলাবকে জানান, তার কর্মস্থল বাংলামোটর এলাকায়। করোনা মহামারির সময় যানজট কম থাকলে বর্তমানে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় বিমানবন্দর সড়কে। সেখানে একদিকে বিআরটির কাজের জন্য নির্মাণ সামগ্রী রাখা হয়েছে। তাতে সড়ক অনেকটা সরু হয়ে গেছে। তার উপর বিমান বন্দর গোল চত্ত¡র থেকে বিশাল এলাকাজুড়ে বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করায়। এতে সরু সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশের সামনে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে কিভাবে এসব অনিয়ম পুলিশ বরদাস্ত করে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

রাজধানীর যানজটের কারণ রাস্তায় অবৈধ পার্কিং, ফুটপাত দখল, রাস্তার পাশে অস্থায়ী পাইকারি কাঁচা বাজার, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্রমিক ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, লেন মেনে যানবাহন না চালানো, ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, ট্রাফিক পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, ট্রাফিক আইন ও রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতাও ইত্যাদি। এসব কারণের মধ্যে পুলিশের সহযোগীতায় গোটা রাজধানীতেই যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করা হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, মতিঝিল, আগারগাঁও, সায়েদাবাদ, ফার্মগেইট, মিরপুর-২ থেকে মিরপুর-১০, কাফরুল, আজিমপুর, খিলগাঁও, রামপুরাসহ এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে সড়কের উপর গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয় না। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পাড়া মহল্লায় শত শত ভ্যানগাড়ি। গোটা রাজধানীজুড়েই সড়কের উপর ভ্যানগাড়িতে করে সবজি, মাছ, ফল, কাপড়, ডিম, দুধ, বই-খাতা, কলম, রকমারি খাবারসহ বিভিন্ন সামগ্রী। পুলিশ টাকার বিনিময়ে ভ্যানচালকদের সড়ক দখল করে ব্যবসার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকার বর্ণমালা স্কুল সড়কে এমন অর্ধশতাধিক ভ্যান থেকে চাঁদা তোলেন কদমতলী থানার শনিরআখড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই সাইদুল। শুধু তাই নয়, এখানে রাস্তা দখল করে বসানো হয়েছে প্রায় একশ’ খাবারের দোকান। যেগুলো থেকে এসআই সাইদুলের লোকজন প্রতিদিন দেড় থেকে দুশ’ টাকা করে চাঁদা তোলে। একজন ভুক্তভোগি জানান, তার বাড়ির সামনের রাস্তা দখল করে ফার্স্টফুডের দোকান বসাতে বাধা দিলে এসআই সাইদুল তাকে ফোন করে দোকান বসাতে দিতে বলেন। দনিয়া এলাকার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে এখানকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে এখন আইজিপির কাছে লিখিত অভিযোগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এর আগে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহু সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই পুলিশের চাঁদাবাজি থামছে না। যানজটে ভোগান্তি পোহাচ্ছে এলাকাবাসী।

যানজটের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের ডিসি মো. ওয়ালিদ হোসেন বলেন, মেট্রোরেল, গ্যাসলাইন এবং ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাস্তা সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় কিছুটা জ্যাম সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আগের তুলনায় জ্যাম অনেক কমেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ট্রাফিক পুলিশ যানজট কমাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নাগরিকদের সুবিধার্থে ট্রাফিক বিভাগ যানজট নিরসনে সর্বদাই সচেষ্ট রয়েছেন। তবে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আব্দুর রাজ্জাকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে আছি। পরে কথা বলব।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর