মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের গৌরবময় স্মৃতি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় এক লাখ সদস্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের এ বিজয় জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ডিসেম্বর মাস আমার জন্য শ্রেষ্ঠতম আনন্দের মাস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর ২৭ মার্চ পায়ে হেঁটে, রিকশা ও নৌকায় অনেক কষ্টে নরসিংদী পৌঁছেছিলাম; নিয়েছিলেম মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। যোগাযোগ করেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত মেজর নূরুজ্জামানের সঙ্গে। ২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন মতিউরের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। বিকালে নরসিংদীর পাঁচদোনা পৌঁছালে পাকবাহিনী নৌ, রেল ও স্থল তিনদিক থেকে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে শুরু হয় মুখোমুখি যুদ্ধ। শত্রুবাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। তাদের অতর্কিত আক্রমণে আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লেও অসীম সাহসিকতায় যুদ্ধ চালাতে থাকলাম। পাকবাহিনীর ৮-১০ জন সৈন্য হতাহত হল। উড়িয়ে দেয়া হল তাদের দুটি গাড়ি। আমাদের কয়েকজন হতাহত হল।

আমরা তিন ভাই মুক্তিযোদ্ধা। ছোট ভাই গেরিলা যোদ্ধা শাহ আলম চৌধুরী ও জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। ১৯৭১-এর এপ্রিল মাসে আমি আগরতলা যাই। মূলত সেখানেই মিজানুর রহমান চৌধুরী, শেখ জামাল, আবদুস সামাদ আজাদ, গাজী গোলাম মোস্তফা, কর্নেল ওসমানী, মেজর জিয়া, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার, মেজর নূরুজ্জামান, আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান প্রমুখ নেতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় ২ ও ৩নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টার। সে দায়িত্ব থেকেই ২৫ এপ্রিল আমি খালেদ মোশাররফ ও কুমিল্লার হোমনার এমপি প্রফেসর মোজাফফর আলীকে নিয়ে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করি। তার নির্দেশনা গ্রহণ করে কলকাতা থেকে আগরতলায় ফিরে আসি। সংগঠক হিসেবে সে সময়ে মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পসহ ত্রিপুরার অনেক ক্যাম্পেই প্রতিনিয়তই যেতে হতো আমাকে। সূর্যমণি নগর হাসপাতাল, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য, পরিদর্শনে গিয়ে দেখা হল আমার স্কুল জীবনের বন্ধু ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে। এ সময়ে অর্থাৎ ২৮ মে তৎকালীন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলারও সুযোগ হয় আমার।

আমি ১ জুন হোমনার এমপি প্রফেসর মোজাফফর আলী ও ছাত্রলীগ নেতা আলীসহ হবিগঞ্জের মাধবপুর বর্ডার দিয়ে দেশে প্রবেশ করি। রাত ২টা ৩০ মিনিটে বর্ডার ক্রস করতে সাহায্য করেন ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন)। সারা দিন চলার পর রাতে ঝড়-বাদলে মাঝপথ হারিয়ে ফেলায় অনেক কষ্টে ৩ জুন সকালে প্রফেসর মোজাফফর আলী এমপিএ’র এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠি। পরদিন সকালে বাঞ্ছারামপুরের এমপিএ মহিউদ্দিনের খোঁজে তার এলাকায় গিয়ে তাকে পেলাম ডোমরাকান্দিতে। এরপর রায়পুরার এমপিএ আফতাব উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হল নিলীক্ষায়। শিবপুর-মনোহরদীর এমপি ফজলুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হাইরমারা গ্রামে চেয়ারম্যান আবদুল হাই চৌধুরীর বাড়িতে। তাদের সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর মেসেজ জানাই এবং তারা সবাই আগরতলায় তথা ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হন। এভাবে ২১ জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে এমপিএ, মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিকামী বাঙালিদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে আলোচনা ও সাক্ষাৎকার কার্যক্রম চালাই।

২২ জুন নিজ গ্রাম নরসিংদীর আলোকবালীতে যাই। চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ। আমাদের বাড়িতে ২৯ জুন রাতে পরিবার-পরিজনসহ আসেন নরসিংদীর এমপিএ মোসলেহউদ্দিন। তাকে পেয়ে আমার কাজে অনেকটাই সুবিধা হল। এ সময়ে আলোকবালী নিরাপদ নয় ভেবে পরিবার-পরিজন স্থানান্তর করলাম বাঞ্ছারামপুরে। সেখানেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হল আমার ছোট মেয়ে সুইটি। পরে সে হোমনাতে মারা গেল একরকম বিনা চিকিৎসাতেই।

পরিবার-পরিজন রেখে ৩০ জুলাই আবারও ঢাকার পথে রওনা হলাম। হেঁটে, নৌকায়, রেলপথে ও রিকশায় অনেক কষ্টে ঢাকায় পৌঁছালাম ৩ আগস্ট রাতে। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, জোরাইন, শ্যামপুর, মাতুয়াইল, ধলপুর, মাণ্ডা, মুরাদপুর ও আশপাশের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে ১৭ আগস্ট রওনা হয়ে ১৯ আগস্ট নরসিংদী পৌঁছালাম। নরসিংদী তখন ভীষণ উত্তপ্ত। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের দৌরাত্ম্য তখন চরমে। এরই মধ্যে বাড়াইল হয়ে আমার গ্রাম আলোকবালীতে পৌঁছালাম। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশনা দিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে আবারও রওনা হলাম আগরতলার উদ্দেশে। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের চোখ এড়িয়ে দুই-এক জায়গায় ছদ্মবেশে অনেক বিপদ এড়িয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করলাম। ২৫ সেপ্টেম্বর মেজর নূরুজ্জামান ও ২৬ সেপ্টেম্বর গাজী গোলাম মোস্তফাকে দেশের অভ্যন্তরের যুদ্ধ পরিস্থিতি বর্ণনা করলাম। এরপর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আগরতলা, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন এবং অন্যান্য সাংগঠনিক কাজে ভারতেই ছিলাম।

দেশে এলাম ১৪ ডিসেম্বর মেজর হায়দারসহ হেলিকপ্টারে কুমিল্লায়। পরে নরসিংদী হয়ে ঢাকায় এলাম ১৫ ডিসেম্বর বিকালে। যাত্রাবাড়ীতে সেদিনই বিজয় উল্লাস। জনতা মেজর হায়দার ও আমাকে মাথায় নিয়ে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। পরদিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর আমরা কয়েকজন ঢাকা ক্লাব থেকে টেবিল-চেয়ার এনে বর্তমানে যেখানে শিশুপার্ক সেখানে সেট করি আত্মসমর্পণ কার্য সম্পাদন করার জন্য। আমার জন্য এটি একটি গৌরবের বিষয় যে, পাকিস্তানি হায়েনাদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরেছিলাম।

আর কে চৌধুরী : সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক; মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর