হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৯৭৫ এর ১৫ ই আগস্টের হত্যা একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। শোকাবহ আগস্ট মাস আসলেই মুজিবীয় চেতনাবাহীদের উদ্যোগে শোকের আহাজারি বইতে থাকে আকাশে বাতাসে । গান, কবিতায়, আলোচনায় ওঠে আসে সেই দিনের ভয়াবহ হত্যাকান্ডের তথ্যচিত্র, রক্ত মাখা ফটোগ্রাফ।
বনের পাখি, গাঁয়ের কৃষক,ধানমন্ডি লেকের জলরাশি, বঙ্গবন্ধু যাদুঘরের ধুলিবালি,প্রত্যক্ষ দরজা জানালা –ভয়ঙ্কর স্মৃতির পাতা উল্টায় নয়ন জলে ভেসে।
কিন্তু হায় সারা পৃথিবীর ধূলিবালি উল্টালেও বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনার অমর কাব্যের মহা নায়ক বঙ্গবন্ধুকে খোঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু অনুভবে তার মহানুভবতা,বাঙালির মুক্তির লড়াইয়ে রক্ত ঝরানো ত্যাগের স্মৃতি কথা নবায়ন করা যাবে।স্মৃতির পৃষ্টায় মূর্তমুজিব ও ইতিহাসের স্বর্ণজ্জোল মহান নেতাকে নত শিরে ফুলেল শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানানো যাবে। হৃদয় কেটে রক্ত দিয়ে লিখে ব্যক্ত করা যাবে শোক ত্যাগের দহন জ্বালা।
মধুমতি নদী তীরে বেড়ে ওঠা খোকা নামের ছেলেটি বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের ছিলো নয়নের মণি। রাজটিকা কপালে নিয়েই জন্মেছিলেন। কেউ কেউ আদর করে ডাকতো মিয়া ভাই। দুষ্ট প্রকৃতির,একগুঁয়ে স্বভাবের মারদাঙ্গা প্রকৃতির ছেলেটি ছিলো অতিশয় মানবিক ও জনদরদি দেশ প্রেমিক। তিনি তাঁর মেধা, নেতৃত্ব, দেশ প্রেম দিয়ে পুর্ববাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে করছিলেন আম্রেলা বন্দি।
তিনি শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মৃত্যুঞ্জয়ী নেতাই নই। জোট নিরপেক্ষ সন্মেলনে সমগ্র বিশ্বের শোষিত গণমানুষের পক্ষে বজ্রকন্ঠি আওয়াজ তুলে পরিনত হয়েছিলেন বিশ্ব নেতা। বাংলাদেশকে কেউ না চিনলেও বঙ্গবন্ধুর এই দেশকে চিনতো। আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো সীমানা পেরিয়ে অসীমের উচ্চ শিকড়ে। এটাই ছিলো বহু জনের গাত্রদাহ ও ঈর্ষার কারন।
আসে কলঙ্কজনক পনেরই আগস্টের নির্লজ্জ অধ্যায়। আমরা নিজের পায়ে কুরালে আঘাত করে হাজার বছরের অর্জিত সম্পদ বঙ্গবন্ধুকে পিস্তলের আঘাতে স্তব্দ করে দেই। ইতিহাসকে প্রবাহিত করি কালের চক্রে ষঢ়যন্ত্রের পেছনমুখী স্রোতে। কি অপরাধ ছিলো জাতির পিতার, আজও কেউ তা উদ্ধার করতে পারেনি। বরং পদ্মা মেঘনার অববাহিকার জনপদ বার বার নত শিরে করছে অপরাধ স্বীকার। অকৃঞ্জ জাতি হিসেবে বাঙালি বিশ্ব ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে হায় লজ্জা।
তাঁর অভিধানে ভয়ের জায়গা ছিলো না। সাহসি মুজিব ১৭ বার কারারোদ্ধ হয়েছিলেন। মৃত্যু ঝুকি মাথায় নিয়ে দুইবার ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছিলেন। বিশ্ব খ্যাত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বুলেটের গুলির মুখে দাঁড়িয়ে। পাকিস্তান সরকার হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলছিলো– স্বাধীনতার ঘোষনা দিলে সভাস্থল রক্ত বন্যায় তলিয়ে দিব। বঙ্গবন্ধুর মাথার উপর উড়ছিলো বোমারু বিমান। প্রয়োজনে বোমা নিক্ষেপ করে শাসন করার মত কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না। তারপরও অত্যান্ত সাহসিকতার সঙ্গে পশ্চিমা শত্রুদের উদ্দ্যেশে বঙ্গবন্ধু বলে ছিলেন– রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্।
২৫ মার্চ ১৯৭১ এ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করে বলেছিলেন — এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা,আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। এই ঘোষনা কোন গোপন স্থানে বসে দেন নাই। অনিশ্চিত ভয় আতঙ্ক মাথায় নিয়ে ধানমন্ডির নিজ বাস ভবন থেকে বলেছিলেন। এই ঘোষণাটি বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফের মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছিলো। সেই দিনই অল্প সময়ের ব্যবধানে ইয়াহিয়া সরকার রাত ১২টা ৩০ মিনিটে ৩২ নাম্বারের বাড়ী থেকে গ্রেফতার করে ও বন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে। তারা এই মহান ব্যক্তিকে ফাঁসির মঞ্চে ওঠালেও বিশ্ব রাজনৈতিক চাপে হত্যা করতে পারেনি।
অথচ অত্যান্ত কাছের আস্থা ভাজন স্বজনরাই ক্ষমতার মোহে উন্মাদ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এই দুঃখ ভারাক্রান্ত ইতিহাস লিখতে থাকলে সাগরে পানি শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু কষ্টের বোজা লাগব হবে না। অনেক কাঠখর পোড়ানোর পর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রক্ত ঝরিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ এ রাষ্ট্রীয় কর্ণধার হিসাবে ক্ষমতায় আসেন। ইনডিমিনিটি আইন বাতিল করার পাশাপাশি ১৫ ই আগস্টের পৈশাচিক হত্যার আইনি বিচার দাবি করেন। দীর্ঘ পর্যালোচনার পর ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসূল ১৯৯৮ এ ৮ নভেম্বরে ১৫ জন আসামীকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়ে মামলার রায় ঘোষণা করেন।
২০০১ এ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট জামাত- বিএনপি’র অনুকূলে চলে গেলে বিচারিক প্রক্রিয়া থমকে দাঁড়ায়। ইতিহাস বলে- সত্যকে কখনও ছাই চাপা দিয়ে রাখা যায় না। আবার দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি প্রাণ ফিরে পায়। ২০০৯ সালের ২৯ দিন শুনানির পর ১৯ নভেম্বর প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচজন বিচারপতি রায় ঘোষনায় ১২ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। আসামীদের দাখিলকৃত রিভিউ পিটিশন খারিজ করে ২০১০ সালে ২৭ জানুয়ারীতে। অতঃপর পরদিন ২৮ জানুয়ারী পাঁচ জন ঘাতকের মৃত্যু দন্ডের মাধ্যমে ফাঁসির আদেশ কার্যকর করে। এক জন আসামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। ২০২০ এ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আরো এক জনের মুত্যু দন্ড দেয়া হয়। এখনও ৫ জন আসামী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সময়ের দাবি উপস্থাপন করে বলছি –১৫ ই আগস্টের তথ্য উপাত্ত সংকলিত একটি শ্বেতপত্র প্রনয়ণ করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হউক। উক্ত কমিটি উপাত্ত যাচাই ও মূল্যায়ন সাপেক্ষে একটি দলিল বা শ্বেতপত্র তৈরী করবে। সেই দলিলে ১৫ ই আগস্টের হত্যা সংশ্লিস্ট যাবতীয় বিষয়াবলী লিপিবদ্ধ থাকবে। শত বছর পরেও কেউ দলিলটি হাতে তুলে জানতে পারলে ইতি আদি সামগ্রিক চিত্র।
যে সমস্ত তথ্য বা তথ্যের উত্তর খোঁজে পাওয়া যাবে–
১। কেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছিলো ?
২। তাঁর ভাগ্নে ও যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসস্থা স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করার কারণ কি ছিলো।
৩। ভগ্নিপতি ও কৃষকলীগের প্রতিষ্টাতা সভাপতি আবদুর সেরনিয়াবাদকে কোন অপরাদে হত্য করা হলো।
৪। ঘাতকদের নিষ্টুরতার,দানবীয় তালিকা প্রনয়ণ।
৫। মৃত্যু দন্ড প্রাপ্ত আসামীদের তালিকা উপস্থাপন।
৬। রায় কার্যকর হয়েছে যাদের,তাদের নামের তালিকা।
৭। ধানমন্ডি থানা থেকে উচ্চ আদালত, এপিলেড ডিভিশান হয়ে রায় কার্যকর হওয়া পর্যন্ত মামলার সামগ্রিক বিবরণ।
৮। নেপথ্যের কারিগর,কে কোথায় বসে, কি দিক নির্দেশনা দিয়েছিলো, সেই বিশ্বাস ঘাতক মীরজাফরদের নির্দয়তার তথ্য, তাদের করুন পরিনতি।
৯। তিনটি বাড়ীতে হত্যাষজ্ঞ চালাতে গিয়ে, কে কোথায় অবস্থান নিয়েছিলো ও কে কি ভাবে গুলি করে, কার জীবন কিভাবে কেড়ে নিয়েছিলো।
১০। ক্যান্টনমেন্ট থেকে কি ভাবে ট্যাঙ্ক, কামান, গোলাবারুধ সহ হত্যা সামগ্রী বের করা হয়েছিলো ?
১১। সৈনরাই – বা কার আদেশে, নির্দেশে এই হত্যা কার্যকরে ভুমিকা নিয়েছিলো।
১২। মায়ের দুধের কসম খেয়ে তারা কোথায়, কেমন করে, কেন হত্যার শপথ নিয়েছিলো।
১৩। জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে কারা ছিলো, কেন তারা কোন কিছুই জানলো না, বা জেনেও নীরব ছিলো।
১৪। লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু সাহায্য চাওয়ার পরও সামরিক সচিব কর্ণেল জামিল ছাড়া কেউ কেন এগিয়ে এলো না।
১৫। বঙ্গবন্ধুর চারপাশে ঘুর্নায়মান দুধের মাছি, যারা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রী পরিষদে যোগ দিয়েছিলো তাদের জিহ্বা লালার বিবরণ তালিকা।
আরো বহু প্রাসঙ্গিক বিষয়সহ বহু চমকপ্রদ উপাদান প্রত্যক্ষ দর্শিদের লিখিত গন্থে ছড়িয়ে রয়েছে। তা সংকলিত করে একটি সত্যনিষ্ট দলিল প্রনয়ন করার এখনই উপযুক্ত সময়। যে দলিলে চোখ রাখলে আয়নার মত পরিস্কার ফটোগ্রাফে ভেসে উঠবে হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত স্নাত সুর্যের মত উজ্জল বিদায় বেলার প্রভার বিচ্ছুরণ রশ্নি। যে রশ্নি কষ্ট ধুয়ে নবায়ন করবে ১৫ই আগস্টের ক্ষত চিহ্নকে যত দিন বাংলাদেশ থাকবে গর্ব অহংকারে বেঁচে।
ঘাতকদের নাম অঙ্কিত একটি ধিক্কার স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করে একটি নির্দিষ্ট তারিখে ও সময়ে থুতু ছিটিয়ে দেয়ার রেয়াজ চালু করা যেতে পারে।
লেখকঃ ড. গোলসান আরা বেগম কবি,কলামিষ্ট, সিনেট সদস্য