রাজাকারের ছেলে আ’লীগের প্রার্থী

চিহ্নিত এক রাজাকারের ছেলে হয়েছেন আওয়ামী লীগের পৌর মেয়র প্রার্থী। এ ঘটনা ঢাকার অদূরে সোনারগাঁ পৌরসভায়। এতে ক্ষোভ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে খোদ সরকারি দলে। একটি জাতীয় দৈনিকে খবর বেরিয়েছে, দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও নৌকা প্রতীকের এমন প্রার্থী অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বিকে ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের অনেকে।

এতে বলা হয়েছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশংকা করছেন সরকারি দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ও বিদায়ী মেয়র সাদেকুর রহমান। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোশারফ হোসেনও নানা শংকায় উদ্বিগ্ন। অভিযোগ উঠেছে, ভোট কেন্দ্র দখলের জন্য আড়াইহাজারসহ আশপাশের এলাকা থেকে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের জড়ো করা হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি দলের প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন তো প্রতিদিনই করছেন। তবে সব জেনেশুনেও প্রশাসন নীরব। কারণ, ফজলে রাব্বি একদিকে সরকারি দলের প্রার্থী, অপরদিকে এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর নিকটাত্মীয়। অগত্যা যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।

প্রার্থী রাজাকারের ছেলে হওয়ায় দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে যারা এলাকায় ভোট চাইতে যাচ্ছেন তারাও এক রকম বিব্রত হচ্ছেন। কেন না, সাধারণ ভোটারদের অনেকে তাদের মুখের সামনে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন। তবে নির্বাচনের দু’দিন বাকি থাকতে ভোটারদের মনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। প্রতিবেদককে অনেকে জানিয়েছেন, নির্বাচনের দিন পাশের উপজেলা আড়াইহাজার থেকে কয়েক হাজার বহিরাগতকে নিয়ে কেন্দ্র দখল করার গুজব রয়েছে। অনেকে এমন খবর ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে নির্বাচনী এলাকাজুড়ে আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার আওয়ামী লীগ কেন রাজাকারের ছেলের হাতে নৌকার প্রতীক তুলে দিল? বিশেষ করে এই মনোনয়ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।

সোনারগাঁ পৌর এলাকার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানালেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বির পিতা তমিজ উদ্দিনের ভূমিকা ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে। তিনি সোনারগাঁয়ের কুখ্যাত রাজাকার এসএম সোলাইমানের প্রধান সহযোগী ছিলেন। তমিজ উদ্দিন সোনারগাঁয়ের জিআর ইন্সটিটিউটের শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা এমতাজ উদ্দিন হত্যার অন্যতম অভিযুক্ত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তমিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে লুটপাটের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তিনি ১৯৭২ সালে সোনারগাঁ উদ্ধবগঞ্জ বাজার জনতা ব্যাংক শাখা ডাকাতি মামলায় ৯ বছর কারাভোগও করেছেন।

এদিকে ফজলে রাব্বির নিজ এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, তাদের বর্তমান বাড়িটিও হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জবরদখল করে নেয়া। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দলের প্রতি আস্থা ও আনুগত্যের কারণে তারা নৌকার পক্ষে থাকলেও মাঠে নামছেন না। কারণ, দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভুল এবং মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে রাব্বির মতো রাজাকারের ছেলেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আমরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করলে দল থেকে বহিষ্কার হতে পারি, এমন আশংকায় কিছু বলছি না।

স্থানীয় বাসিন্দা রাজ্জাক আলী নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘রাব্বির বাপে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার মাস্টারকে মারছে, ব্যাংক লুট কইরা জেল খাটছে। আর তারে দিছে নৌকা মার্কা! ভাবতেই বুকটা ফাইট্টা যায়।’ এদিকে সরকারদলীয় প্রার্থী অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বির ছোট ভাই ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধেও এলাকায় অভিযোগ রয়েছে বালু সন্ত্রাসের। স্থানীয়দের দাবি, ‘উনি (রাব্বি) যদি জিততা যায় তাইলে গেরাম তো আর গেরাম থাকব না, সব নদীতে চইল্লা যাইব।’ জানা গেছে, ইকবাল আড়াইহাজার ও কুমিল্লার মেঘনা থানা এলাকার দস্যুদের নিয়ে সোনারগাঁ থানার মেঘনা নদী তীরবর্তী ফসলি জমি এবং গ্রামের অংশ বিশেষ থেকে ক’বছর ধরে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে আসছেন।

অপরদিকে ভোটের দিন বহিরাগত সন্ত্রাসীদের জড়ো করার গুজবটি শেষ পর্যন্ত সত্য হলে বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ জানিয়েছে, ‘আমাদের এলাকায় যদি কোনো বহিরাগত লোকজনকে ভোটের আগের দিন বা ভোটের দিন দেখা যায় তবে আমরাও কঠোর জবাব দেব।’ এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে আরও জানা যায়, নিজের ভগ্নিপতি ফজলে রাব্বির পক্ষে আড়াইহাজারের এমপি নজরুল ইসলাম বাবু ও সোনারগাঁয়ের সাবেক এমপি কায়সার হাসনাত ব্যাপকভাবে মাঠে নেমেছেন। ইতিমধ্যেই কেন্দ্র দখলের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। তাই নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে তাদের মধ্যে নানা শংকাও ঘনীভূত হচ্ছে। এ ছাড়া অনেকে ভোট কেন্দ্র দখলের আশংকাও করছেন। বিশেষ করে বিরোধী দল বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে এমন আশংকা এখন অনেক প্রবল।

এ ব্যাপারে সোনারগাঁ পৌরসভার বিদায়ী মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক পৌর মেয়র সাদেকুর রহমান ওই পত্রিকাটিকে বলেন, ‘বহিরাগতদের এনে জড়ো করা হচ্ছে সোনারগাঁয়ে। ভোটের দিন কেন্দ্র দখলের ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক এমপি কায়সার হাসনাত। এমতাবস্থায় ভোটাররা শংকিত।’

বিএনপির প্রার্থী মোশারফ হোসেন বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে আমি এবং আমার সমর্থক নেতাকর্মীরা নানা চাপে আছি। তিনি বলেন, পারিবারিক এক অনুষ্ঠানের জন্য আমাকে নির্বাচন কমিশন শোকজ নোটিশ করেছে। অথচ সরকারদলীয় প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করে মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের গাড়ির বহরের প্রচারণার কারণে জনমনে আতংকও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো মাথা ব্যথা নেই।

এদিকে উল্লিখিত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থী অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র দখলের প্রশ্নই আসে না। কারণ, আমি যে বিজয়ী হব তা সুনিশ্চিত।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তার ছোট ভাই ইকবাল বালু সন্ত্রাসী নন।’ তবে তার পিতা রাজাকার ছিলেন কিনা- এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। (সংগৃহীত)

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর