২০১৫ সালটা বাংলাদেশের জন্য একটা ব্যতিক্রম বছর । এ বছরে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে অনেক কিছু প্রমাণ করেছে ।যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ছিটমহল বিনিময় চুক্তি থেকে পদ্মা সেতু। এটা শুধু সরকারের অর্জনই নয়, ঐতিহাসিক সাক্ষীও। বিভিন্ন পট পরিবর্তনের মধ্যেও মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়ন, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জাতির কলঙ্কমোচন অন্যতম শুভবোধের বর্হিপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ কিংবা ক্রিকেটে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ধারাবাহিক সাফল্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অনন্য সেরা অর্জন।
ইতিহাসের সাক্ষী ছিটমহল বিনিময় চুক্তি :
চলতি বছরের ১ আগস্ট বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকরের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ ৬৮ বছর পর নিজেদের পরিচয় ফিরে পান প্রায় ৫৪ হাজার ছিট্মহুল মানুষ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ৪৪ বছর পর ফিরে পায় প্রায় ১০ হাজার একর ভূমি। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পান ৪০ হাজার ৪৭০ জন। ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকর হওয়ায় দুই দেশের মানচিত্র ও জনসংখ্যায় পরিবর্তন আসে।
আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে দুই দেশের সীমানার নতুন মানচিত্র তৈরি হওয়ার কথা রয়েছে।
পদ্মা সেতু চ্যালেঞ্জ :
অবশেষে বাংলাদেশের বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে।এখন পুরোদমে চলছে নির্মাণ কাজ। গত ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর মূল অংশের নির্মাণ কাজ ও নদী শাসন কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতি কলঙ্কমুক্তে আরেক ধাপ :
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২২ নভেম্বর। এর আগে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল একই অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
চার দেশের মধ্যে যান চলাচলে চুক্তি :
বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে সড়ক পথে যান চলাচলে চুক্তি হয় চলতি বছরের ১৫ জুন। ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে ঐতিহাসিক এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। চার দেশের মন্ত্রীরা প্রতিবেশী চার দেশে সড়ক পরিবহনের একটি রূপরেখায় স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির অধীনে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলতে পারবে চারদেশের মধ্যে। শুল্ক ও অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে নিজ নিজ দেশের আইনে। তবে ট্রানজিট ও চলাচলের অনুমতি-সংক্রান্ত ফি নির্ধারণ আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ‘সেঞ্চুরি’ :
গত ৮ অক্টোবর আশুগঞ্জের ৩টি ইউনিট উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের শততম বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ওই ৩টি ইউনিট উদ্বোধন করেন তিনি। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি।
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন :
এবছরের ৬ জুলাই জাতিসংঘ ঘোষিত পনের বছর মেয়াদের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজি শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে, বাংলাদেশ ক্ষুধা ও দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্যমাত্রা সফলভাবে পূরণ করেছে।
ক্রিকেটে সাফল্য :
ক্রিকেটে এই বছর বাংলাদেশ দল যতগুলো একদিনের আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেছে সবগুলোতেই জয় পেয়েছে । বাংলাদেশের কাছে পরাজিতের তালিকায় রয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পরাক্রমশালী দল।
মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি :
বাংলাদেশ এখন আর নিম্ন আয়ের দেশ নয়। মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে তৈরি করা ২ জুলাইয়ের এক রিপোর্টে বাংলাদেশকে এবার মধ্য আয়ের দেশের স্বীকৃতি দেয় বিশ্বব্যাংক। তবে মধ্যম আয়ের দেশের দু’টি ভাগ করেছে বিশ্ব ব্যাংক। একটি উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ অপরটি নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ। বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে।
৪১ বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি :
মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে ৪১ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে ১২ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। চলতি বছরের জুলাই থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
নতুন বেতন স্কেল :
দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে হয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত অষ্টম বেতন স্কেলের গেজেট। ১৫ ডিসেম্বর রাতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গেজেটের মোড়ক উন্মোচন করেন। আর এর মাধ্যমে অবসান হয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার।
গৃহকর্মী সুরক্ষা আইন অনুমোদন :
‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’-এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ২১ ডিসেম্বর সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক নিয়মিত বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। নীতির মূল কথা-গৃহ শ্রমিকদের জন্য শোভন কাজ, নিরাপদ বিশ্রাম, বিনোদন ছুটি ও মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা। জেনেভা কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই নীতিমালা অনুমোদন করেছে।
বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির পর নূর হোসেনই প্রথম ব্যক্তি, যাকে এ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ভারত সরকার অনুপ চেটিয়ার বিনিময়ে নূর হোসেনকে ফেরত দিতে রাজি হয়।
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ :
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রসহ অন্যান্য পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার জন্য একটি কোম্পানি গঠন ও এ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে বিধান করে জাতীয় সংসদে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিল-২০১৫ পাস করা হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন।
গত ৬ সেপ্টেম্বর বিলের ওপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়।
ওমরাহ ভিসার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার :
৯ মাস বন্ধ রাখার পর বাংলাদেশিদের জন্য ওমরাহ ভিসার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে সৌদি সরকার। গত ১৪ ডিসেম্বর রয়েল অ্যাম্বাসি অব সৌদি আরব বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে ওমরাহ ভিসা খুলে দেয়ার তথ্য জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করেছে বলে জানিয়েছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হুসাইন।ওমরাহ ভিসার নামে মানবপাচারের অভিযোগ এবং নিয়মিত হজ পালনের পরে দেশে ফিরে না আসার কারণে গত মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশিদের ওমরাহ ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছিল সৌদি আরব।
‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ :
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পলিসি লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার পান শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে তার নেয়া বলিষ্ঠ পদক্ষেপই তাকে এ পুরষ্কারের অন্যতম দাবিদার করেছে। চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান। পরিবেশ বিষয়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।