ঢাকা ০৩:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমানতের সুদ ইসলামী ধারার ব্যাংকের ক্ষেত্রে কী হবে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৫৮:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ মার্চ ২০২০
  • ১৯৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল স্থান হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টর। কোনোভাবেই এ সেক্টরের অবস্থার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ঘটানো যাচ্ছে না। এ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য কর্তৃপক্ষীয় পর্যায়ে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ বা আইনি সংস্কার সাধন করা হচ্ছে তা দীর্ঘ মেয়াদে কী ফল বয়ে আনবে, এ নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে।

এমনই এক অবস্থায় ব্যাংক কমিশন গঠনের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

অবশেষে ব্যাংক কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ব্যাংক কমিশন গঠনের এ উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত একটি সিদ্ধান্ত।

দেশের বেসরকারি খাতের অন্যতম থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ব্যাংক কমিশন গঠনের সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করেছে। তবে তারা বলেছেন, রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া ব্যাংক খাত ঠিক হবে না। আগে ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো ছিল অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কিত, পরে তা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যায় রূপ নেয়। এখন তা পুরোপুরি রাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

কাজেই রাজনৈতিক সমর্থন ও সদিচ্ছা ছাড়া ব্যাংক খাত ঠিক হবে না। তারা আরও বলেছেন, প্রস্তাবিত ব্যাংক কমিশন যদি যোগ্য, সৎ ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত না হয় এবং তারা যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে তাহলে এ কমিশন কোনো কাজে আসবে না। ব্যাংকিং সেক্টর কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে ভঙ্গুর স্থান হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টর। ব্যাংকিং সেক্টরের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। ফলে এ সেক্টরের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের সুদের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উচ্চতম পর্যায়ে রয়েছে। খেলাপি ঋণের হার দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ধারণকারী কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম। মূলত খেলাপি ঋণের প্রবল উপস্থিতির কারণেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমে আসছে না। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ গ্রহণীয় বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ১১ শতাংশের কাছাকাছি।

বিভিন্ন আইনি মারপ্যাঁচে সম্প্রতি খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে। এ কাজটিই প্রশংসনীয় হতো যদি কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা যেত।

সংশোধিত পুনঃতফসিলিকরণ নীতিমালা অথবা অবলোপন নীতিমালা প্রয়োগ করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বুকের মাঝে প্রচণ্ড কষ্ট চেপে রেখে মুখে কৃত্রিম হাসি হেসে ভালো আছি বলার যেমন কোনো মানে হতে পারে না ঠিক তেমনি কিস্তি আদায় না করে আইনি মারপ্যাঁচের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর মধ্যেও কোনো বাহাদুরি নেই। সমস্যা জিইয়ে না রেখে বরং সময়মতো সমস্যার মুখোমুখি হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আইনি সংস্কার সাধন করা হয়েছে তা নিয়ে নানামুখী সমালোচনা হচ্ছে। এ মুহূর্তে ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের ওপর আরোপিত সুদের হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণের সুদের হার অত্যন্ত বেশি। উচ্চ সুদ হারের কারণে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের ব্যয় বেশি হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্য ক্রমেই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে। তাই বিভিন্ন মহল থেকেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর দাবি উঠেছে। এ দাবি এখন সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। খুব কম মানুষই খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি চান ব্যাংক ঋণের সুদের হার বর্তমান পর্যায়ে অব্যাহত থাকুক।

সবাই চান ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনা হোক। ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে, আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। একই সঙ্গে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের বেলায় এটা হবে ৬ শতাংশ।

একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, তাদের কস্ট অব ফান্ড হচ্ছে প্রায় ৮ শতাংশ। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ প্রদান করলে তাদের লাভ খুব বেশি থাকবে না। গত কয়েকদিনে আমি বেশ ক’জন অর্থনীতিবিদ এবং খ্যাতিমান ব্যাংকারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা করেছি। তারা এ বিষয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন।

দেশের মূল্যস্ফীতির হার অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে আমানতের সুদহার কমলে ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখার ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ কমতে থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দিতে যাচ্ছে। কিন্তু ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সুদের হার কত হবে? দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। তাদের ব্যবসায়ের মূল কথাই হচ্ছে ‘প্রফিট অ্যান্ড লস শেয়ারিং।’

প্রচলিত ধারার সনাতনী ব্যাংকগুলো তাদের আমানতকারীদের বছরান্তে নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। ব্যাংকের লাভ হল নাকি লোকসান হল এটা আমানতকারীদের দেখার বিষয় নয়। কিন্তু ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে অর্জিত লাভের ওপর ভিত্তি করে আমানতকারীদের মুনাফা দিতে হয়। একটি ইসলামী ধারার ব্যাংক যদি নির্দিষ্ট বছরে ১০ শতাংশ মুনাফা করে তাহলে সেই ব্যাংক তার আমানতকারীদের কত শতাংশ মুনাফা দেবে?

তারা যদি চলমান নিয়ম বজায় রাখতে চায় তাহলে আমানতকারীদের ১০ শতাংশ হারে মুনাফা দিতে হবে। তাহলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ৬ শতাংশ সুদ হারের শর্তের ব্যত্যয় ঘটবে। আবার যদি ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকেও ৬ শতাংশ হারে লভ্যাংশ প্রদান করতে বাধ্য করা হয় তাহলে সেই ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা বলা যাবে না। তাহলে কি সরকারের আইন অনুসরণ করতে গিয়ে দেশ থেকে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা উঠে যাবে?

আবার ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে যদি তাদের অর্জিত প্রকৃত মুনাফার ওপর আমানতকারীদের লভ্যাংশ প্রদানের অনুমতি দেয়া হয় তাহলে সব আমানত চলে যাবে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং সেক্টরে। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম যখন ২৬০ থেকে ৩০০ টাকায় উন্নীত হয়েছিল তখন টিসিবি’র ট্রাকের পেছনে যেভাবে মানুষ লাইনে দাঁড়াত ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে তাদের অর্জিত প্রকৃত মুনাফার ভিত্তিতে লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ দেয়া হলে আমানতকারীদের ভিড় তেমনই হবে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে। আবার মুনাফার হার নির্ধারণ করে দিলে সেটা আর ইসলামী ব্যাংকিং থাকবে না, সেটা হবে সুদী ব্যাংকিং।

ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। এরা মুনাফাও করছে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের চেয়ে উচ্চহারে। ব্যাংকিং সেক্টরে সরাসরি ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংক আছে যারা ইসলামী ব্যাংকিং উইং পরিচালনা করছে। সব মিলিয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে মোট আমানতের ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ যা টাকার অঙ্কে ২ লাখ ৬২ হাজার ১১০ কোটি টাকা। তাদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৩২২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং সেক্টরের মোট বিনিয়োগের ২৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।

এদের উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ হচ্ছে ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদ হার কত হবে তা নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে। ইস্যুটি নিয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকে কর্মরত উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছি। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার না পাওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করা যাবে না। তবে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো তাদের অর্জিত মুনাফার পরিমাণ কমিয়ে দেখাতে পারে। যদি এটা করা হয় তাহলে তা এক ধরনের প্রতারণা বলে গণ্য হবে।

আমাদের দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে এখানে অর্থনীতির অধিকাংশ সূত্র যথাযথভাবে কার্যকর আছে কিনা এটা এক বড় প্রশ্ন। স্বাভাবিক অবস্থায় এখনও ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণের ওপর সুদের হার ১২-১৩ শতাংশ। ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সংকট থাকলেই কেবল সুদের হার এত বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে কোনো তারল্য সংকট নেই। বরং উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে।

একটি সূত্র মতে, বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার তারল্য রয়েছে। এছাড়া ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট (সিআরআর) এবং স্ট্যাটুইটুয়ারি লিকুইডিটি রিজার্ভ (এসএলআর) বাবদ আরও ১ লাখ ৫ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা রিজার্ভ রয়েছে।

এ মুহূর্তে ব্যাংকিং সেক্টরের বিনিয়োগ চাহিদা মেটানোর জন্য ২ লাখ ৫ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা তারল্য থাকলেই চলে। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকে তেমন একটা আসছে না। এ অবস্থায় এমনিতেই ঋণের সুদের হার কমে আসার কথা কিন্তু তা হচ্ছে না। বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনতে হচ্ছে।

সরকার ব্যাংকিং সেক্টর থেকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে। পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ গ্রহণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ মাসেই তা অতিক্রম করে গেছে। সরকার যে ঋণ গ্রহণ করে তা সাধারণত অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ব্যক্তি খাতে যে ঋণ প্রদান করা হয় তা উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয় এবং দেশে ব্যাপক মাত্রায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহ এবং সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ প্রবাহ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো না গেলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

আমানতের সুদ ইসলামী ধারার ব্যাংকের ক্ষেত্রে কী হবে

আপডেট টাইম : ১১:৫৮:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ মার্চ ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল স্থান হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টর। কোনোভাবেই এ সেক্টরের অবস্থার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ঘটানো যাচ্ছে না। এ সেক্টরের উন্নয়নের জন্য কর্তৃপক্ষীয় পর্যায়ে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ বা আইনি সংস্কার সাধন করা হচ্ছে তা দীর্ঘ মেয়াদে কী ফল বয়ে আনবে, এ নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে।

এমনই এক অবস্থায় ব্যাংক কমিশন গঠনের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য শক্তিশালী ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

অবশেষে ব্যাংক কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ব্যাংক কমিশন গঠনের এ উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত একটি সিদ্ধান্ত।

দেশের বেসরকারি খাতের অন্যতম থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ব্যাংক কমিশন গঠনের সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করেছে। তবে তারা বলেছেন, রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া ব্যাংক খাত ঠিক হবে না। আগে ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো ছিল অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কিত, পরে তা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যায় রূপ নেয়। এখন তা পুরোপুরি রাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

কাজেই রাজনৈতিক সমর্থন ও সদিচ্ছা ছাড়া ব্যাংক খাত ঠিক হবে না। তারা আরও বলেছেন, প্রস্তাবিত ব্যাংক কমিশন যদি যোগ্য, সৎ ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত না হয় এবং তারা যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে তাহলে এ কমিশন কোনো কাজে আসবে না। ব্যাংকিং সেক্টর কতিপয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে ভঙ্গুর স্থান হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টর। ব্যাংকিং সেক্টরের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। ফলে এ সেক্টরের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের সুদের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উচ্চতম পর্যায়ে রয়েছে। খেলাপি ঋণের হার দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ ধারণকারী কয়েকটি দেশের মধ্যে অন্যতম। মূলত খেলাপি ঋণের প্রবল উপস্থিতির কারণেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমে আসছে না। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ গ্রহণীয় বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের হার প্রায় ১১ শতাংশের কাছাকাছি।

বিভিন্ন আইনি মারপ্যাঁচে সম্প্রতি খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে। এ কাজটিই প্রশংসনীয় হতো যদি কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা যেত।

সংশোধিত পুনঃতফসিলিকরণ নীতিমালা অথবা অবলোপন নীতিমালা প্রয়োগ করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বুকের মাঝে প্রচণ্ড কষ্ট চেপে রেখে মুখে কৃত্রিম হাসি হেসে ভালো আছি বলার যেমন কোনো মানে হতে পারে না ঠিক তেমনি কিস্তি আদায় না করে আইনি মারপ্যাঁচের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর মধ্যেও কোনো বাহাদুরি নেই। সমস্যা জিইয়ে না রেখে বরং সময়মতো সমস্যার মুখোমুখি হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আইনি সংস্কার সাধন করা হয়েছে তা নিয়ে নানামুখী সমালোচনা হচ্ছে। এ মুহূর্তে ব্যাংকিং সেক্টরে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের ওপর আরোপিত সুদের হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণের সুদের হার অত্যন্ত বেশি। উচ্চ সুদ হারের কারণে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের ব্যয় বেশি হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্য ক্রমেই প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে। তাই বিভিন্ন মহল থেকেই ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর দাবি উঠেছে। এ দাবি এখন সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। খুব কম মানুষই খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি চান ব্যাংক ঋণের সুদের হার বর্তমান পর্যায়ে অব্যাহত থাকুক।

সবাই চান ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনা হোক। ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে, আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। একই সঙ্গে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের বেলায় এটা হবে ৬ শতাংশ।

একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, তাদের কস্ট অব ফান্ড হচ্ছে প্রায় ৮ শতাংশ। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ প্রদান করলে তাদের লাভ খুব বেশি থাকবে না। গত কয়েকদিনে আমি বেশ ক’জন অর্থনীতিবিদ এবং খ্যাতিমান ব্যাংকারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা করেছি। তারা এ বিষয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন।

দেশের মূল্যস্ফীতির হার অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে আমানতের সুদহার কমলে ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখার ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ কমতে থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দিতে যাচ্ছে। কিন্তু ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সুদের হার কত হবে? দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। তাদের ব্যবসায়ের মূল কথাই হচ্ছে ‘প্রফিট অ্যান্ড লস শেয়ারিং।’

প্রচলিত ধারার সনাতনী ব্যাংকগুলো তাদের আমানতকারীদের বছরান্তে নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। ব্যাংকের লাভ হল নাকি লোকসান হল এটা আমানতকারীদের দেখার বিষয় নয়। কিন্তু ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে অর্জিত লাভের ওপর ভিত্তি করে আমানতকারীদের মুনাফা দিতে হয়। একটি ইসলামী ধারার ব্যাংক যদি নির্দিষ্ট বছরে ১০ শতাংশ মুনাফা করে তাহলে সেই ব্যাংক তার আমানতকারীদের কত শতাংশ মুনাফা দেবে?

তারা যদি চলমান নিয়ম বজায় রাখতে চায় তাহলে আমানতকারীদের ১০ শতাংশ হারে মুনাফা দিতে হবে। তাহলে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ৬ শতাংশ সুদ হারের শর্তের ব্যত্যয় ঘটবে। আবার যদি ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকেও ৬ শতাংশ হারে লভ্যাংশ প্রদান করতে বাধ্য করা হয় তাহলে সেই ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা বলা যাবে না। তাহলে কি সরকারের আইন অনুসরণ করতে গিয়ে দেশ থেকে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা উঠে যাবে?

আবার ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে যদি তাদের অর্জিত প্রকৃত মুনাফার ওপর আমানতকারীদের লভ্যাংশ প্রদানের অনুমতি দেয়া হয় তাহলে সব আমানত চলে যাবে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং সেক্টরে। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম যখন ২৬০ থেকে ৩০০ টাকায় উন্নীত হয়েছিল তখন টিসিবি’র ট্রাকের পেছনে যেভাবে মানুষ লাইনে দাঁড়াত ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে তাদের অর্জিত প্রকৃত মুনাফার ভিত্তিতে লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ দেয়া হলে আমানতকারীদের ভিড় তেমনই হবে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে। আবার মুনাফার হার নির্ধারণ করে দিলে সেটা আর ইসলামী ব্যাংকিং থাকবে না, সেটা হবে সুদী ব্যাংকিং।

ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। এরা মুনাফাও করছে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের চেয়ে উচ্চহারে। ব্যাংকিং সেক্টরে সরাসরি ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংক আছে যারা ইসলামী ব্যাংকিং উইং পরিচালনা করছে। সব মিলিয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে মোট আমানতের ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ যা টাকার অঙ্কে ২ লাখ ৬২ হাজার ১১০ কোটি টাকা। তাদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৩২২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং সেক্টরের মোট বিনিয়োগের ২৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।

এদের উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ হচ্ছে ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আমানতের ওপর প্রদেয় সুদ হার কত হবে তা নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে। ইস্যুটি নিয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকে কর্মরত উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছি। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার না পাওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করা যাবে না। তবে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো তাদের অর্জিত মুনাফার পরিমাণ কমিয়ে দেখাতে পারে। যদি এটা করা হয় তাহলে তা এক ধরনের প্রতারণা বলে গণ্য হবে।

আমাদের দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে এখানে অর্থনীতির অধিকাংশ সূত্র যথাযথভাবে কার্যকর আছে কিনা এটা এক বড় প্রশ্ন। স্বাভাবিক অবস্থায় এখনও ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণের ওপর সুদের হার ১২-১৩ শতাংশ। ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সংকট থাকলেই কেবল সুদের হার এত বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে কোনো তারল্য সংকট নেই। বরং উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে।

একটি সূত্র মতে, বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার তারল্য রয়েছে। এছাড়া ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট (সিআরআর) এবং স্ট্যাটুইটুয়ারি লিকুইডিটি রিজার্ভ (এসএলআর) বাবদ আরও ১ লাখ ৫ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা রিজার্ভ রয়েছে।

এ মুহূর্তে ব্যাংকিং সেক্টরের বিনিয়োগ চাহিদা মেটানোর জন্য ২ লাখ ৫ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা তারল্য থাকলেই চলে। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকে তেমন একটা আসছে না। এ অবস্থায় এমনিতেই ঋণের সুদের হার কমে আসার কথা কিন্তু তা হচ্ছে না। বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঋণের সুদের হার কমিয়ে আনতে হচ্ছে।

সরকার ব্যাংকিং সেক্টর থেকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে। পুরো অর্থবছরের জন্য ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ গ্রহণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ মাসেই তা অতিক্রম করে গেছে। সরকার যে ঋণ গ্রহণ করে তা সাধারণত অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ব্যক্তি খাতে যে ঋণ প্রদান করা হয় তা উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয় এবং দেশে ব্যাপক মাত্রায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহ এবং সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগ প্রবাহ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো না গেলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।