ঢাকা ০২:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে গ্রামে উৎপাদিত হয় বিষমুক্ত শাক-সবজি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:৪৫:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২০
  • ২০৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নীলফামারীর সৈয়দপুরে একটি গ্রামে উৎপাদিত হচ্ছে বিষমুক্ত শাক-সবজি। আর এই শাক-সবজি উৎপাদন করছেন উপজেলার বোতলাগাড়ি ইউনিয়নের সোনাখুলি হিন্দুপাড়ায় গড়ে ওঠা নিরাপদ সবজি গ্রামের কৃষকেরা। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব, রাসায়নিক-বালাইনাশক ছাড়াই নিরাপদ সবজি অবাদ করে আশা জাগিয়েছেন ওই গ্রামের ২০ জন কিষাণ-কিষাণী।

সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, চারদিকে সবুজ আর সবুজ। সৈয়দপুর কৃষি বিভাগের পরামর্শে গ্রামের ছয় একর জমিতে চাষ হচ্ছে বিষমুক্ত নানা রকম সবজি। এরই মধ্যে জমি থেকে আলু তুলে নিয়েছেন। বর্তমানে জমিতে রয়েছে সিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ধনে পাতা, বেগুন ইত্যাদি।

সার্বিক বিষয়ে কথা হয় কৃষক সুভাষ চন্দ্র রায়ের (৩০) সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে আমরা জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক স্প্রে করতাম। এর মাধ্যমে হাইব্রিড জাতের শাক-সবজি আবাদ করেছি। এতে ফলন বেশ ভালো হত। তবে আমরা জানতাম, এসব ফসল বিষাক্ত বলে মানুষজন নানা রোগব্যাধীতে আক্রান্ত হতেন। আমরা কৃষি বিভাগের কাছ থেকে জেনেছি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োগে জমির ফসল বিষে পরিণত হয় এবং মাটি উর্বরা শক্তি হারিয়ে ফেলে। আমরা গেল বছর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আর মানুষকে বিষ খাওয়াবো না। বর্তমানে আমাদের গ্রামের সবাই নিরাপদ সবজি আবাদে হাত বাড়িয়েছে।

গ্রামটির প্রবেশমুখে চাষিরা সম্মিলিতভাবে গর্ত খুঁড়ে গৃহস্থালি বর্জ্য দিয়ে তৈরি করছেন কম্পোস্ট সার। করা হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। এছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে জৈব বালাইনাশক তৈরি করা হচ্ছে। এসব ফসলের জমিতে প্রয়োগ করে মিলছে ভালো ফলাফল।

কিষাণী মায়া রানী রায় (৩৪) কেঁচো সার তৈরিতে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন। মাত্র ১৫দিনের মাথায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করেন তিনি। এ সার জমিতে প্রয়োগ করলে অনেক ভালো ফলন মেলে বলে জানালেন মায়া রানী।

কিষাণী আলো রানী (৪২) জানান, কৃষি বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছি আমরা। ফসলের পরাগায়ন কিভাবে ঘটাতে হয় তা আমরা জানি। প্রকৃতির কাছে আশায় না থেকে পরাগায়ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। এতে ফসল পুষ্ট হচ্ছে।

জমিগুলো ঘুরে দেখা যায়, মাঝে-মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে সেক্সফেরোমন ফাঁদ।’ এটি হচ্ছে কীটপতঙ্গ দম পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিক বক্স ব্যবহার করা হয়। যার দুপাশে তিন কোণা ফাঁক থাকে। পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করতে স্ত্রী পোকার শরীর থেকে নি:সৃত এক রকম রাসায়নিক পদার্থ বা স্ত্রী পোকার গন্ধ ব্যবহার করা হয় ফাঁদে। এর আকর্ষণে পুরুষ পোকা ফাঁদের দিকে ধেয়ে আসে এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। এতে করে জমির ফসল নিরাপদ থাকে। অতীতে এসব কীট দমনে ব্যবহার হতো বিষাক্ত কীটনাশক। সেক্সফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করায় জমির ফসল নিরাপদ থাকছে। খাদ্যমান ও পুষ্টি সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।

সূত্র মতে, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে খরচ একটু বেশি হয়। তবুও ওই গ্রামের কৃষক সুভাষ ১০ শতক জমিতে করলা উৎপাদনে খরচ করেছেন চার হাজার টাকা। এ থেকে ফসল মিলেছে ৫৭০ কেজি করলা। যা বিক্রি করে আয় করেছেন ১৪ হাজার টাকা। ২০ শতক জমিতে টমেটো উৎপাদনে খরচ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার টাকা। এ থেকে উৎপন্ন হবে ১০০ মণ টমেটো। কম করে হলেও প্রতিমণ টমেটোর দাম ১০০০ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা খরচ করে পাওয়া যাবে এক লাখ টাকা।

কৃষি বিভাগ বলছে, নিরাপদ সবজি বাজারজাত করতে সরকার এরই মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঢাকায় গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপদ কৃষি বাজার। শিগগিরই নীলফামারী জেলায় এ ধরনের বাজার সৃষ্টি করা হবে। যাতে করে বারো মাস নিরাপদ সবজি পাওয়া যাবে।

এ নিয়ে কথা হয় সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, নিরাপদ কৃষি গ্রাম হচ্ছে একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। দেশের প্রতিটি উপজেলাতে এ ধরনের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কৃষিকে বিষমুক্ত করতে এ উদ্যোগ। আমরা সৈয়দপুরে গেল বছর থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ওই অর্গানিক কৃষিগ্রাম গড়ে তুলেছি। এতে কৃষকের সাড়া মিলছে প্রচুর।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

যে গ্রামে উৎপাদিত হয় বিষমুক্ত শাক-সবজি

আপডেট টাইম : ০১:৪৫:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২০

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নীলফামারীর সৈয়দপুরে একটি গ্রামে উৎপাদিত হচ্ছে বিষমুক্ত শাক-সবজি। আর এই শাক-সবজি উৎপাদন করছেন উপজেলার বোতলাগাড়ি ইউনিয়নের সোনাখুলি হিন্দুপাড়ায় গড়ে ওঠা নিরাপদ সবজি গ্রামের কৃষকেরা। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব, রাসায়নিক-বালাইনাশক ছাড়াই নিরাপদ সবজি অবাদ করে আশা জাগিয়েছেন ওই গ্রামের ২০ জন কিষাণ-কিষাণী।

সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, চারদিকে সবুজ আর সবুজ। সৈয়দপুর কৃষি বিভাগের পরামর্শে গ্রামের ছয় একর জমিতে চাষ হচ্ছে বিষমুক্ত নানা রকম সবজি। এরই মধ্যে জমি থেকে আলু তুলে নিয়েছেন। বর্তমানে জমিতে রয়েছে সিম, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ধনে পাতা, বেগুন ইত্যাদি।

সার্বিক বিষয়ে কথা হয় কৃষক সুভাষ চন্দ্র রায়ের (৩০) সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে আমরা জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক স্প্রে করতাম। এর মাধ্যমে হাইব্রিড জাতের শাক-সবজি আবাদ করেছি। এতে ফলন বেশ ভালো হত। তবে আমরা জানতাম, এসব ফসল বিষাক্ত বলে মানুষজন নানা রোগব্যাধীতে আক্রান্ত হতেন। আমরা কৃষি বিভাগের কাছ থেকে জেনেছি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক প্রয়োগে জমির ফসল বিষে পরিণত হয় এবং মাটি উর্বরা শক্তি হারিয়ে ফেলে। আমরা গেল বছর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আর মানুষকে বিষ খাওয়াবো না। বর্তমানে আমাদের গ্রামের সবাই নিরাপদ সবজি আবাদে হাত বাড়িয়েছে।

গ্রামটির প্রবেশমুখে চাষিরা সম্মিলিতভাবে গর্ত খুঁড়ে গৃহস্থালি বর্জ্য দিয়ে তৈরি করছেন কম্পোস্ট সার। করা হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার। এছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে জৈব বালাইনাশক তৈরি করা হচ্ছে। এসব ফসলের জমিতে প্রয়োগ করে মিলছে ভালো ফলাফল।

কিষাণী মায়া রানী রায় (৩৪) কেঁচো সার তৈরিতে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন। মাত্র ১৫দিনের মাথায় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করেন তিনি। এ সার জমিতে প্রয়োগ করলে অনেক ভালো ফলন মেলে বলে জানালেন মায়া রানী।

কিষাণী আলো রানী (৪২) জানান, কৃষি বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছি আমরা। ফসলের পরাগায়ন কিভাবে ঘটাতে হয় তা আমরা জানি। প্রকৃতির কাছে আশায় না থেকে পরাগায়ন প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। এতে ফসল পুষ্ট হচ্ছে।

জমিগুলো ঘুরে দেখা যায়, মাঝে-মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে সেক্সফেরোমন ফাঁদ।’ এটি হচ্ছে কীটপতঙ্গ দম পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিক বক্স ব্যবহার করা হয়। যার দুপাশে তিন কোণা ফাঁক থাকে। পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করতে স্ত্রী পোকার শরীর থেকে নি:সৃত এক রকম রাসায়নিক পদার্থ বা স্ত্রী পোকার গন্ধ ব্যবহার করা হয় ফাঁদে। এর আকর্ষণে পুরুষ পোকা ফাঁদের দিকে ধেয়ে আসে এবং ফাঁদে পড়ে মারা যায়। এতে করে জমির ফসল নিরাপদ থাকে। অতীতে এসব কীট দমনে ব্যবহার হতো বিষাক্ত কীটনাশক। সেক্সফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করায় জমির ফসল নিরাপদ থাকছে। খাদ্যমান ও পুষ্টি সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।

সূত্র মতে, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে খরচ একটু বেশি হয়। তবুও ওই গ্রামের কৃষক সুভাষ ১০ শতক জমিতে করলা উৎপাদনে খরচ করেছেন চার হাজার টাকা। এ থেকে ফসল মিলেছে ৫৭০ কেজি করলা। যা বিক্রি করে আয় করেছেন ১৪ হাজার টাকা। ২০ শতক জমিতে টমেটো উৎপাদনে খরচ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার টাকা। এ থেকে উৎপন্ন হবে ১০০ মণ টমেটো। কম করে হলেও প্রতিমণ টমেটোর দাম ১০০০ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে ২০ হাজার টাকা খরচ করে পাওয়া যাবে এক লাখ টাকা।

কৃষি বিভাগ বলছে, নিরাপদ সবজি বাজারজাত করতে সরকার এরই মধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঢাকায় গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপদ কৃষি বাজার। শিগগিরই নীলফামারী জেলায় এ ধরনের বাজার সৃষ্টি করা হবে। যাতে করে বারো মাস নিরাপদ সবজি পাওয়া যাবে।

এ নিয়ে কথা হয় সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, নিরাপদ কৃষি গ্রাম হচ্ছে একটি পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। দেশের প্রতিটি উপজেলাতে এ ধরনের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কৃষিকে বিষমুক্ত করতে এ উদ্যোগ। আমরা সৈয়দপুরে গেল বছর থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ওই অর্গানিক কৃষিগ্রাম গড়ে তুলেছি। এতে কৃষকের সাড়া মিলছে প্রচুর।