হাওর বার্তা ডেস্কঃ ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী মিতু আক্তার। বাবা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কনস্টেবল। ছয় বছর ধরে নিখোঁজ মানসিক ভারসাম্যহীন বাবা। তিনি জানতেনই না তার বাবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা! পুলিশের চাকরি থেকে অবসরের পর পেনশনের টাকা তোলার আগেই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন মিতুর বাবা আব্দুল মোনায়েম।
দরিদ্র পরিবারের গৃহবধূ মোনায়েমের স্ত্রী নাজমা বেগম মানুষের কাছে ধারদেনা করে, অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করে মিতুসহ তার ছোট ভাই ফুলপুর ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আদনান মিয়া ও ব্রাইটকান্তি স্কুল ও কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আরাফাত মিয়ার লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছিলেন। স্বামী নিখোঁজ হওয়ায় তার অবসরকালীন পেনশনের টাকাও তোলা যাচ্ছিল না। একদিকে স্বজন হারানোর চাপাকান্না, অপরদিকে অর্থকষ্টে খেয়ে-না খেয়ে দিন কাটছিল নাজমার। স্বামী আর তার চাকরির পেনশনের টাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু একজন পুলিশ কর্মকর্তার আন্তরিকতায় তার মুখে হাসি ফোটে। স্বামীকে ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি সম্ভব হয়েছে তার পেনশনের টাকা তোলাও। তাইতো দীর্ঘদিন পর সাবেক পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল মোনায়েম ও তার স্বজনদের মুখে হাসি ফুটেছে।
মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর বছরের পর বছর রেললাইন, বাসস্ট্যান্ড আর পথে-প্রান্তরে দিন কেটেছে পুলিশ কনস্টেবল মোনায়েমের। বৃদ্ধা মায়ের ভিক্ষার টাকায় জুটেছে খাবার। দীর্ঘ ছয় বছরেও মনে হয়নি স্ত্রী-সন্তানের কথা। এ অবস্থা থেকে তুলে এনে তাকে চিকিৎসা দিয়ে অনেকটা সুস্থ করেছেন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার)। এ মানুষটির অকৃত্রিম সহযোগিতা আর আন্তরিকতায় শোকে কাতর আর দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারটি পেয়েছে আলোর দিশা।
ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার গুয়াভাঙা গ্রামের মীর মুক্তার মুন্সির ছেলে আব্দুল মোনায়েম। ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন। ২০১১ সালের ৩ মে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশে বদলি হন। একই বছরের ৯ মে তাকে পাকুন্দিয়া থানায় পদায়ন করা হয়। কিন্তু যোগদানের দিনই জানা যায় মোনায়েম মানসিকভাবে অসুস্থ।
পাকুন্দিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাম্মাদ হোসেন এ দিনই মোনায়েম মানসিক ভারসাম্যহীন উল্লেখ করে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে একটি প্রতিবেদন দেন। ২০১২ সালের ৭ আগস্ট তার মানসিক পরীক্ষার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে অক্ষমতাজনিত কারণে কনস্টেবল মোনায়েমকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ৫ মার্চ পরিবারের সদস্যসহ তার কাছে লাম্পবিল ও জিপিএফ বিল প্রদান করা হয়। একই বছরের ২৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে তার পেনশন দাখিল করা হয়।
এরপর থেকেই নিখোঁজ হন পুলিশ কনস্টেবল মোনায়েম। অনেক খোঁজাখুজির পরও তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। স্বামীকে হারিয়ে যেন অকূলে ভাসতে থাকেন তিন সন্তানের জননী নাজমা বেগম। স্বামী নিখোঁজ থাকায় পেনশনের টাকাও তোলা যাচ্ছিল না। তবে দমে যাননি। কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ অফিসে এসে বিষয়টি জানানোর পর সে সময়কার পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন, বিপিএম তাকে নিজের তহবিল থেকে প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা করে অর্থ সহযোগিতা করে আসছিলেন।
বর্তমান পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ কিশোরগঞ্জে যোগদানের পর নাজমা তার কাছে দুই হাজার টাকা নিতে আসেন। এ সময় পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল মোনায়েমের বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। সেই থেকে মোনায়েমকে খুঁজে বের করার মিশনে নামেন পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ।
দীর্ঘ প্রায় দেড় বছরের চেষ্টায় গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলার গুয়াডাঙা গ্রামে ভিক্ষুক মায়ের ঘর থেকে মোনায়েমকে উদ্ধার করা হয়। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় তাকে আনা হয় কিশোরগঞ্জে। পুলিশ লাইনে রেখে চিকিৎসা, নতুন কাপড়-চোপড় ও সেবা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলা হয়। ভোটার আইডি কার্ড তৈরি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করে তার অ্যাকাউন্টে পেনশেনের টাকা জমা করা হয়।
বৃহস্পতিবার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সঙ্গে মুখোমুখি হন সাবেক পুলিশ কনস্টেবল মোনায়েম, তার বৃদ্ধা মা হালিমুন্নেছা, স্ত্রী নাজমা বেগম, ভাই মীর মোশারফ হোসেন, বোন খুশি আক্তার, মেয়ে মিতু আক্তার, দুই ছেলে আদনান মিয়া ও আরাফাত মিয়া। এ সময় কান্নার রোল পড়ে। এ কান্না আনন্দের! হারিয়ে পাওয়ার!
মোনায়েমের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, এতদিন পর বুকের ভেতর থেকে একটা বড় পাথর সরে গেছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কী যে কষ্ট করেছি! কিন্তু এখন আমার আর কোনো কষ্ট নেই। এসপি স্যার যেন আমাদের জন্য ফেরেশতা হয়ে দেখা দিয়েছেন। আল্লাহ তার ভালো করুক।
মেয়ে মিতু বলেন, বাবাকে কাছে পেয়েছি। এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কী হতে পারে। বাবাকে আর হারাতে দেব না!
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল ইসলাম সোপান বলেন, এসপি স্যারের আন্তরিক সহযোগিতার ফলেই একটি পরিবার তার স্বজনকে ফিরে পেয়েছে। কষ্টের সংসারে সম্ভব হয়েছে একজন পুলিশ সদস্য অবসর নেয়ার পর সরকারের দেয়া পেনশন সুবিধা ভোগের। এ কৃতিত্ব একভাবে এসপি স্যারের।
তিনি বলেন, মোনায়েম এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। তাই তার পেনশনের ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৯০ টাকা ব্যাংকে ফিক্সট ডিপোজিট করে রাখা হয়েছে। এ টাকার লাভ থেকে মা, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে আনুপাতিক হারে পাবেন। মোনায়েম নিজেও তার ইচ্ছেমতো একটি অংশ খরচ করতে পারবেন। পরিবারের সবার সম্মতিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) বলেন, মোনায়েমের স্ত্রীর কাছে বিষয়টি জানার পর থেকে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। নিজের কাছে খারাপ লাগছিল। একটি মানুষ পাগল হতে পারে। কিন্তু তার কোনো হদিস পাওয়া যাবে না, এটা কেমন কথা? তাই প্রায় দেড় বছর ধরে মোনায়েমের বিষয়ে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম। এ নিয়ে আমার অনেক সহকর্মী ও রিজার্ভ অফিসের স্টাফদের সঙ্গে রাগারাগি করেছি। তাদের বলেছি যে করেই হোক তাকে খুঁজে বের করতে হবে। অবশেষে ওই এলাকার চাকরিরত পুলিশ সদস্য ও আমার অফিসের সদস্যদের সহায়তায়, বিশেষ করে কিশোরগঞ্জে ছিলেন, বর্তমানে ফুলফুরের এএসপি দ্বীপক কুমার সরকারের আন্তরিকতায় তার খোঁজ পাই।
তিনি বলেন, মোনায়েম পথে-ঘাটে, রেলস্টেশনে ঘুরে বেড়াত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যেত। আবার কিছুদিন পর এলাকায় এসে ফুলপুরের চকবেদাধর গ্রামে মায়ের খুপড়ি ঘরে থাকত। বৃদ্ধা মা ভিক্ষা করে তাকে খাওয়াত। এ অবস্থা থেকে নিজের অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে তাকে কিশোরগঞ্জ নিয়ে আসি।
এমন একটি ভালো কাজ করতে পেরে নিজের কাছে ভালো লাগছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, দরিদ্র পরিবারে কিছু টাকা হাতে পাওয়ার পাশাপাশি তার স্বজনদের মুখে যে হাসি ফোটাতে পেরেছি এটাই অনেক আনন্দের। যতদিন সম্ভব এমন ভালো কাজ করে যেতে চাই।