হাওর বার্তা ডেস্কঃ ‘কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’-এই মূলমন্ত্রে সারা দেশে কৃষকসমাজকে সংগঠিত করে কৃষক-জনতার সার্বিক উন্নয়ন সাধন করাই কৃষক লীগের মূল নীতি হলেও তা থেকে অনেক দুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই সংগঠনটি।
ক্ষমতাসীন দলের সংগঠন হিসেবে কৃষির উন্নয়নে কিংবা কৃষকদের পাশে কতোটা দাড়াতে পেরেছে কৃষক লীগ; তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ সংগঠনের মধ্যেই। তবে এবার আওয়ামী লীগ তার সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে যে সংষ্কার বিপ্লব শুরু করেছে, তার ঢেউ লাগবে কৃষক লীগেও। এর মাধ্যমে এই সংগঠনের এমন নেতৃত্ব আসবে যারা সত্যিকার অর্থেই কৃষক ও কৃষির উন্নয়নের ভুমিকা রাখবেন-এমনটাই বিশ্বাস করেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
গত মে মাসে ধানের ন্যায্যমুল্য না পাওয়ায় কৃষকদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। এমনকি ধানের দাম না পেয়ে ক্ষেতে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। কৃষকদের প্রতিবাদে যখন সারা দেশে আলোচনা তৈরি হয়, তখন কৃষক লীগের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না রাখার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় এই সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের।
এই বিষয়ে কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল হক রেজা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কৃষকদের অধিকার আদায়ে কৃষক লীগ পিছিয়ে আছে এই কথার সঙ্গে আমি একমত নই। কৃষি ও কৃষকের সবধরনের সংকট বা দাবি আমরা সবসময়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রীকে জানিয়ে আসছি।’
“আওয়ামী লীগের সময়েই কৃষকরা সবচেয়ে বেশি সুবিধা ও সহায়তা পাচ্ছে। কৃষক লীগের এই ব্যপারে সবসময় সক্রিয় রয়েছে।”
কৃষক লীগের কৃষি ও কৃষক সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট থাকার কথা থাকলেও সংগঠনটির নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উঠছে। কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে ভুমিকা রাখার চেয়ে নীতি-নৈতিকতা বিরোধী কর্মকান্ডে বেশি সক্রিয় থাকছেন সংগঠনটির অনেক নেতা। দলীয় দিবস ভিত্তিক কিছু কর্মসূচি থাকলেও কৃষকদের পাশে থেকে জোরালো কোনো কর্মসূচি দিতে দেখা যায়নি এই সংগঠনটিকে। সম্প্রতি কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের চেয়ারম্যান শফিকুল আলমকে ক্লাব থেকে অস্ত্র-গুলি, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে করা হয়েছে। এ নিয়ে দলের বিভিন্ন নেতাদের মধ্যেই ক্ষোভ রয়েছে। প্রশ্নও উঠেছে, তাহলে কৃষক লীগের কাজ কি?
এ সম্পর্কে সংগঠনটির কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কৃষক লীগের বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাবলু রাইজিংবিডিকে বলেন, দৃশ্যত কৃষক লীগের যেই ধরনের কর্মকাণ্ড থাকা উচিত, আমরা সেই ধরনের কর্মসূচিতে নেই, এটা অস্বীকার করা উপায় নেই। এখন কৃষক লীগের কমিটি গঠনেও অর্থ লেনদেন হয়। বিষয়টি খুবই দু:খজনক। ক্যাসিনো কাণ্ডে কৃষক লীগের নেতাদের নাম আসায় সংগঠন কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে তা অনুমেয়।
“এই অবস্থা থেকে সংগঠনকে তার নৈতিক অবস্থানের জায়গায় নিয়ে যেতে আগামী সম্মেলন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক লীগকে তৃনমুল কৃষকের কাছে নিয়ে যেতে সেই ধরনের নেতৃত্ব আসুক সেটাই চাই।”
দেশে কৃষির উন্নয়ন এবং কৃষকের স্বার্থ রক্ষার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল বাংলাদেশ কৃষক লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয় সর্বশেষ ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। ৩ বছরের কমিটির মেয়াদ থাকলেও চলেছে প্রায় ৮ বছর। শুধু কেন্দ্রীয় কমিটি নয়, জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোও বিভিন্ন কারণে ঝিমিয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আগামী ৬ নভেম্বর কৃষক লীগের সম্মেলন হবে।
দীর্ঘ সময় পর হতে যাওয়া এই সম্মেলনকে ঘিরে এরই মধ্যে বেশ সক্রিয় সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে বিগত কমিটিতে সংগঠনের যে ভগ্নদশা ছিল, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তা থেকে বেরিয়ে এসে কৃষক লীগ শক্তিশালী হবে-এমনটাই প্রত্যাশা করছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীদের আরও প্রত্যাশা, আগামী সম্মেলনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসবে। যার মধ্য দিয়ে সত্যিকারে কৃষকের জন্য কাজ করবে কৃষক লীগ। এছাড়া স্বচ্ছ, সৎ ও ক্লিন ইমেজের নেতারা নেতৃত্বে উঠে আসবে।
সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, কৃষক লীগে প্রায় ৩৫ জনের মতো আইনজীবী রয়েছেন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজা আইনজীবী হওয়ার কারণেই সংগঠনে আইনজীবীদের একটি বলয় তৈরি হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। কৃষক দলের কেউ কৃষিবিদ বা কৃষি সংশ্লিষ্ট না হয়ে কেন আইনজীবী থাকবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। আগামী সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিষয়টি আরো জোরালো হচ্ছে।
সম্মেলনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে প্রকাশ করছেন সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। কৃষক লীগের বর্তমান সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজা আগামী কমিটিতেও নেতৃত্বে আসতে চান। সর্বশেষ সম্মেলনের আগে বর্তমান সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, আর সামসুল হক রেজা ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তবে সংগঠনকে সচল করতে না পারার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ জন্য তাদের বিদায় নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই বিষয়ে তাদের ভাষ্য, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) চাইলে থাকবেন। তা না হলে থাকবেন না।’
অন্যদের মধ্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি পদে আলোচনায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক, সহ-সভাপতি শরীফ আশরাফ হোসেন, সহ-সভাপতি কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা, সহ-সভাপতি শেখ মো. জাহাঙ্গীর আলম। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সমীর চন্দ্র, সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিশ্বনাথ সরকার বিটু, কৃষিবিদ সাখাওয়াত হোসেন সুইট, আসাদুজ্জামান বিপ্লব, আবুল হোসেন, গাজী জসিম উদ্দিন, কাজী জসিম, আতিকুল হক আতিকের নাম শোনা যাচ্ছে।
সম্মেলন ও নেতৃত্ব বাছাই প্রসঙ্গে বিশ্বনাথ সরকার বিটু রাইজিংবিডিকে বলেন, কৃষি প্রধান বাংলাদেশে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কৃষক লীগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেজন্য ভবিষ্যতে এমন নেতৃত্ব আসতে হবে যারা কৃষকদের সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে। যাতে কৃষক লীগ সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।
“আমরা চাই, আমাদের নেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেমন নেতৃত্ব চান তেমন। স্বচ্ছ, সৎ ও যোগ্য কৃষক নেতা। যারা ক্লিন ইমেজের নেতা হবে। তবে আমাদের নেত্রী যাকেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বানাবেন তাদের মাধ্যমেই আমরা সারা বাংলাদেশে কৃষকদের সংগঠিত করতে কাজ করে যাব।”
সাখাওয়াত হোসেন সুইট রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সম্মেলন হলে নেতৃত্বের পরিবর্তন আসবে এমনটাই স্বাভাবিক। তা না হলে সম্মেলনের তো কোনো প্রয়োজন নেই। তবে আমাদের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে নেতৃত্বে নিয়ে আসবেন সেটাই চূড়ান্ত। এ জন্য নেতৃত্বে কারা আসবেন এটা নেত্রীর একক সিদ্ধান্ত।’
সাধারণ সম্পাদক সামসুল হক রেজা জানান, কৃষক লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জেলার জনসংখ্যার অনুপাত প্রতি ২০ হাজারে একজন করে আমাদের কাউন্সিলর আসবে। সেই হিসেবে ১০ হাজারের মত কাউন্সিলর হওয়ার কথা রয়েছে। তবে ডেলিগেটের কোন হিসেব নেই। সবাই আসতে পারবে।