হাওর বার্তা ডেস্কঃ অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন (১৯৪৫-২০১৬) বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন এবং কৃষি বিষয়ে গত প্রায় চার দশক ধরে নিরলস এবং অবিস্মরণীয় কাজের জন্য দেশে-বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত ও সম্মানিত। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দীর্ঘকালীন সময় দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি প্রায় ১৩টি বইয়ের লেখক ও সহলেখক এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে তার প্রায় ১৫০টিরও বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২ ও ৩ জানুয়ারি ২০১৯ ছিল যথাক্রমে তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিন। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে তার বিশাল গবেষণালব্ধের ওপর ভিত্তি করেই লেখাটি তৈরি করেছেন ।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো গ্রাম নিয়ে কোনো ভিনদেশি পণ্ডিত হিসেবে প্রথমবারের মতো বেটসি হার্টম্যান ও জেমস কে. বয়েস ১৯৭৪ সালে বিস্তৃতভাবে গবেষণা করেন। পরবর্তীতে সেই গবেষণা অ য়ঁরবঃ ারড়ষবহপবঃ : ারবি ভৎড়স ধ ইধহমষধফবংয ারষষধমব শিরোনামে ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। সাড়া জাগানো সেই বইটিতে তৎকালীন গ্রামের বাস্তব চিত্র করুণভাবেই ফুটে উঠেছে; অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতীকী মেঠোপথে গরুরগাড়ি, সনাতন কৃষি ব্যবস্থাপনা, তীব্র খাদ্য সংকট, চরম দারিদ্র্য, সেচ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ শ্রেণির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, শোষণমূলক বর্গাব্যবস্থা, কৃষিনির্ভর জীবন, তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি। বহু বছর ধরে সেই চিত্রই বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের প্রধান পরিচয় ছিল।
কিন্তু সময়ের বিবর্তনে গ্রামের সেই করুণ চিত্র অনেকাংশে ধূসর হয়ে আসছে। এখন পিচঢালা মসৃণ পথে মোটরগাড়িতে চড়ে অনেক গ্রামের ভেতরেই সরাসরি যাওয়া যায়, যেটা দু’দশক আগেও প্রায় অসম্ভব ছিল। উচ্চ ফলনশীল ধান উফশি আগমনের ফলে কৃষি উৎপাদনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয় এবং এর ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি রপ্তানিতেও বাংলাদেশ সাফল্য পেয়েছে। এছাড়া, স্বল্প জমিতে অধিক এবং বহু ফলনশীল শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি অকৃষি ক্ষেত্রেও কৃষকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি হয়েছে। অবকাঠামোগত ও বৈদ্যুতিক খাতে উন্নতির পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে শোষণমূলক বর্গা ব্যবস্থার ওপর কৃষকের নির্ভরশীলতা কমেছে। এসব পরিবর্তন কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর প্রচলিত চিত্রকল্পে ভিন্নমাত্রা নিয়ে এসেছে এবং জীবনযাত্রায় বড় রকমের প্রভাব রাখছে।
বর্তমানের গ্রাম
এখনকার সময়ে গ্রামে ছনের ঘরের সংখ্যা ব্যাপকহারে কমে আসছে। কুপির বাতি বিদায়ের প্রহর গুনছে। গ্রামের ৫০-৬০ শতাংশের ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং প্রায় প্রতিটি ঘরের জন্য সুপেয় পানির বন্দোবস্ত আছে। অনেক পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ এসে গেছে এবং সেই সূত্রে টিভি, ফ্রিজ আর অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের ঘরে রঙিন টিভি ও দামি ফার্নিচার। যেসব ঘরে বিদ্যুৎ আসেনি যেমন চরাঞ্চল ও দুর্গম গ্রাম সেখানে সোলার প্যানেল লাগানো আছে। গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে যাত্রা, পালাগান, জারিগান এবং পুঁথিপাঠ। কারণ টিভি আর মোবাইলফোনে খুব সহজে বিনোদনের খোরাক পাওয়া যাচ্ছে।
দুদশক আগেও দোকান বলতে গ্রামের কোন ছোট একটা ঘরে চাল-ডাল, নুন আর তেলের পসরাকে বোঝাত। অথচ বর্তমানে অধিকাংশ গ্রামগুলোতে গড়পড়তা ৪-৫টি দোকান এবং সেই সঙ্গে কোথাও টিভি ও ফ্রিজ। চা, চানাচুর, চিপস, সাবান ও প্রসাধনী, আইসক্রিম, কোমল পানীয় এমনকি প্রক্রিয়াজাত মসলা দ্রব্য ঐ সমস্ত দোকানে পাওয়া যায়। নাটকীয়তা এসে গেছে দরিদ্রের জীবনেও। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর দিনমজুর সন্ধ্যার পর বিছানায় শরীর না এলিয়ে এখন চা, পান ও সিগারেটসহ মধ্যরাত পর্যন্ত গ্রামের দোকানে টিভির সামনে বসে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিদ বা খেলোয়াড়রা এখন গ্রামেও বেশ সুপরিচিত। এভাবে, কয়েক দশক আগেও অচেনা, অজানা পুরো বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ এখন গ্রামে থাকা ওই ছোট দোকানঘরটিতে এক নিমিষেই উপস্থিত হয়। বাংলাদেশের গ্রামের ইতিহাসে এটি এক নতুন রূপান্তর।
পরিবর্তনের বৈচিত্র্য
কিন্তু এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ভূ-প্রকৃতি ও জীবিকা কৌশলের কারণে গ্রাম ভেদে ভিন্নতর হয়। বেশির ভাগ গ্রামে প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে কিছু গ্রামে এই হার বেশি। ফলে, সেসব পরিবারে উপার্জনকারীর ওপর ভোক্তার নির্ভরশীলতার অনুপাত অপেক্ষাকৃত বেশি। কোনো গ্রামীণ পরিবারে আয়ের সিংহভাগ আসে বৈদেশিক রেমিট্যান্স থেকে আবার অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্স কোনো পরিবারের প্রধান উৎস। কোন গ্রামে বর্ষামৌসুমে ৮০ ভাগ জমিতে পানি জমে না অথচ কোনটি প্রায় ৬ মাস পানির নিচে থাকে। অধিকাংশ গ্রামে উফশি ধান কৃষকের প্রাণ হলেও কিছু গ্রামে উফশির উচ্ছিষ্টও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বলে সেসব গ্রামের মানুষ দরিদ্র নয়। সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোতে ভারত থেকে আসা ধানের বীজ ও সেখানকার কৃষিজ্ঞান চাষিকে পথ দেখায় অথচ বাংলাদেশের অন্য কোথাও তেমনটি দেখা যায় না। তবে এত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও গ্রামগুলোর মধ্যে উন্নয়নের অভিযাত্রায় বড় রকমের হেরফের করেনি ।
পরিবর্তনের স্বরূপ
বাংলাদেশের গ্রামের এই বিস্ময়কর উন্নয়ন নিয়ে বহু রকমের গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। ২০১৪ সালে এক গণবক্তৃতায় প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মাইকেল লিপটন ক্রম হ্রাসমান প্রজনন হার, ক্রমবর্ধিষ্ণু খাদ্য উৎপাদন এবং অব্যাহতভাবে উন্নীত খামার ব্যবস্থাপনাকে গ্রামীণ দরিদ্রের উন্নয়ন ব্যাখ্যায় উল্লেখযোগ্য উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে বাংলাদেশের গ্রাম নিয়ে চিত্তাকর্ষক, ব্যতিক্রমী, পরিপূর্ণ এবং মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে দীর্ঘকালীন সময় নিয়ে বিস্তৃত গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন। বাংলাদেশের গ্রাম নিয়ে গবেষণাগুলোর অধিকাংশই বিদ্যমান কৃষি ও অ-কৃষি খাতের বিবর্তন ব্যাখ্যা করেছে। ড. মাহবুবেব নেতৃত্বে গবেষণায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বশীল তথ্য নিয়ে কৃষি ও অ-কৃষি কর্মকাণ্ডের মিথস্ক্রিয়া এবং এই মিথস্ক্রিয়ার ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রভাব নির্ণয়ের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। প্রায় দুদশক ধরে তিনটি সময়কাল (১৯৮৮, ২০০০ এবং ২০০৪) ধরে বাংলাদেশের ৬২টি গ্রামের একই খানার ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে এরকম প্রচেষ্টা এটাই প্রথম। এ ছাড়াও গত চার দশকে বাংলাদেশের বিশটি গ্রামের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর নিয়ে তার নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় ব্যবহৃত ‘ওর্যাল হিস্ট্রি’ পদ্ধতিও এর আগে কেউ ব্যবহার করেনি।
পরিবর্তনের অনুঘটক
ক. প্রধানত, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ধারায় পরিবর্তনে ‘সবুজ বিপ্লবে’র বড় রকমের অবদান রয়েছে। ‘সবুজ বিপ্লবে’র প্রধান উপাদান হচ্ছে ‘নয়া ধান’ বা উফশি ধান। বিশেষত সেচের সুবিধা আছে এমন অঞ্চলের গ্রামগুলোতে জমি, লিঙ্গ ও শিক্ষাভেদে সকলের কাছে উচ্চফলনশীল উফশির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ, শুষ্ক মৌসুমে এই ‘নয়া ধান’ গ্রামবাংলায় নবদিগন্তের সূচনা করেছে। সবুজ বিপ্লবের চাদরে ঢাকা সেচ ও সার-নির্ভর উচ্চফলনশীল ধান আসার পূর্বে এসব গ্রামের কৃষিজমি ছিল প্রধানত একফসলি আর খাদ্য যোগানের একমাত্র উপায় ছিল সনাতন জাতের ধান। উফশির কারণে এখন আর সেসব ধানের চাষ কমে গেছে। উফশির কারণে (যেমন বিআর ১১, ব্রিধান ২৮, ২৯) বর্তমানে ২ থেকে ৩ বিগা জমিতে যত ধান হয় দুই তিন দশক কিংবা তারও আগে ৫-৬ বিঘা জমিতে তার চেয়ে কম পরিমাণ ধান উৎপাদন হতো। এই নতুন প্রযুক্তির ফলে একরপ্রতি ধানের উৎপাদন ৪০৩ কেজি থেকে এখন ১১০০ কেজি অর্থাৎ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, এর ফলে এখন অন্য জমিতে ধানবহির্ভূত অধিক লাভজনক ফসলও রোপণ করা যায়।
খ. এর পাশাপাশি গ্রামের যে বিবর্তন হয়েছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ অবকাঠামো; যথা পাকা রাস্তা, সেতু, স্কুল, বিদ্যুৎ ও সেচ সুবিধা। রাস্তাঘাট পাকা, সুপ্রশস্ত হওয়ার ফলে গ্রাম-শহর দূরত্ব দ্রুত হ্রাস পেয়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে অভিবাসন। এর ফলে উৎপাদন ও উপকরণ বিনিময় সহজ ও ব্যবসাশ্রয়ী হতে পেরেছে। অন্য আরেকটি কারণ, সেচ সম্প্রসারণ। সেচ, সার ও আধুনিক বীজের কারণে জমির উৎপাদিকা শক্তি বেড়ে গেছে, যেমন উন্নত জাতের ধান ২৮, ২৯ বিঘাপ্রতি উৎপাদন দেয় ২০-২৫ মণ। প্রায় প্রতিটি খানাতেই সেচযন্ত্র আছে। এসব কারণে এখন একফসলি জমি বহুফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বেশিরভাগ গ্রাম এখন ঐতিহ্যগত জীবননির্বাহ (সাবসিসটেন্স) কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উত্তরিত হচ্ছে। অতীত ও বর্তমানের পার্থক্য হচ্ছে, আগে কৃষক শুধু পেটের দায়ে ফসল বুনলেও এখন পেট ও বাজার উভয়েরই যোগান দেয়।
গ. এসবের পাশাপাশি বিদ্যুতের কারণে গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পল্লী জীবনে এসেছে আলোর হাতছানি। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও সবুজ বিপ্লব বিস্তৃত করেছে অকৃষিজ কর্মকাণ্ড বিশেষত; রেমিট্যান্স থেকে আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩ সালে ড. মাহবুব হোসেনের জরিপ থেকে দেখা যায়, মোট আয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে অকৃষিজ খাত এবং এক-তৃতীয়াংশ আসে কৃষি থেকে। ১৯৯৯ সালে চাষাবাদ মোট আয়ের ৫৩ ভাগ অবদান রাখত; ২০০৬ সালের মধ্যে তা ৩৪ শতাংশে নেমে যায়, একই সময়ে অকৃষিজ আয়ের অবদান বেড়েছে ৩৬ থেকে ৫১ শতাংশতে। তবে, গ্রামীণ রূপান্তরে এনজিওদের বিপুল অবদান অনস্বীকার্য। ২০১৩ সালের এক শুমারিতে দেখা যায়, বাংলাদেশের গ্রামের গড়পড়তা প্রায় ৪০ শতাংশ খানা কোনো না কোনো এনজিওর সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যদিকে, অবকাঠামো ও মানবপুঁজিগত বাজেটের পাশাপাশি সরকার অনুসৃত উদার আমদানি নীতি ও বিনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নত বীজ, সার ও সেচযন্ত্র যথাসময়ে চাহিদামতো এবং অনেকটা যথাযথ দামে কৃষকের হাতে পৌঁছেছে।
ঘ. গ্রামীণ এই উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্যের প্রভাবও স্পষ্ট হচ্ছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। দরিদ্রের সম্পদ কমছে। তবে সৃষ্ট আয় বৈষম্যের পেছনে কাজ করেছে রেমিট্যান্স, মাছ চাষ ও ব্যবসা-বাণিজসহ অ-কৃষিজ কর্মকাণ্ড যেখানে পুঁজি ও শিক্ষার গুরুত্ব বেশি। অন্য হিসেবে দেখলে, আয়-বহির্ভূত নির্দেশিকার মানদণ্ডে বৈষম্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে অন্তর্ভুক্তি, ঋণের বাজারে সুযোগ, স্বাস্থ্যকর্মী ও কমিউনিটি ক্লিনিকের কল্যাণে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, বিনোদন ও সেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ঙ. গ্রামীণ বাংলাদেশের এই বিবর্তনের পেছনে প্রধানতম কৃতিত্ব হচ্ছে কৃষির সাফল্য। যেমনÑ ভালো ফসল, দামের ওঠানামা কম, বাজারজাত সুবিধা। এরপর হচ্ছে; ক্রমবর্ধিষ্ণু কর্মসংস্থান/ মজুরি। তৃতীয়ত, রেমিট্যান্সের প্রবাহ। চতুর্থত, ছোট খানা তথা প্রজনন হারের হ্রাস। সর্বশেষ, পঞ্চমত, সাক্ষরতা তথা শিক্ষার হার বৃদ্ধি। অধ্যাপক মাইকেল লিপটনের পর্যবেক্ষণেও এই বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে, গ্রামীণ অনেক পরিবারের অবনতি হওয়ার পেছনে যেসব অনুঘটকের অবদান রয়েছে, তারমধ্যে প্রথম হচ্ছে; বড় খানা। অর্থাৎ, এসব পরিবারে প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। ফলে আয়ের অনুপাতে নির্ভরশীলতার পরিমাণ বেড়ে যায়। অনেক সময় উপার্জনকারীর মৃত্যু, অসুস্থতা বা অনুপস্থিতি এসব পরিবারকে দুরবস্থায় পতিত করে। তাছাড়া চিকিৎসা খরচ বহনে অক্ষমতাসহ ইত্যাদি কারণে কিছু পরিবারের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এ আলোচনা থেকে বোঝা যায়, অর্জিত সম্পদ ও উদীয়মান সুযোগের মধ্যে যারা সমন্বয় সাধন করতে পারে তাদের ভাগ্যে উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। এর বিপরীতে, অপারগতা ডেকে এনেছে অবনতি ও দুর্গতি।
কল্পচিত্রের পটপরিবর্তন
সময়ের বিবর্তনে গ্রামবাংলার কৃষি কাঠামোতে যে চিহ্ন দৃশ্যমান তা হলো জমি কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ১৯৮৮ সালে প্রতি ১০০ খানার ভেতর ৫ একরের ওপর জমি নিয়ে বড় চাষি খানা ছিল ৮টির মতো যা ২০১৩ সালে এসে কমে ২টিতে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, সময়ের বিবর্তনে এই শ্রেণির মালিকানায় থাকা জমির পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে, অথচ তুলনীয় সময়ে ৫০ শতক পর্যন্ত জমির মালিক খানা ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬০ ভাগে উন্নীত হয়। এ থেকে বোঝা যায় জমির বণ্টন ধনী কৃষক থেকে মধ্যম মানের কৃষকদের কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষকরা আগের মতোই ভূমিহীন রয়েছে এবং কার্যত ভূমিহীন খানার সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে।
এ বিশালসংখ্যক প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকরা মূলত কৃষিতে আমূল পরিবর্তনের সুবাধে টিকে আছে। উফশির কল্যাণে কম জমি দিয়ে খাদ্য ঘাটতি পূরণ হচ্ছে আর তারই পাশাপাশি সরকারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও এনজিওগুলো খামারবহির্ভূত কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ধনী অথবা দরিদ্র কারও জীবনই এখন আর জমিকেন্দ্রিক নয়। বড় ও মাঝারি চাষি উদ্বৃত্ত হস্তান্তর করছে অধিক লাভজনক অকৃষিজ কর্মকাণ্ডে এবং তাদের জমি বর্গায় চাষ করছে কৃষি শ্রমিক বা দরিদ্র আত্মীয়স্বজন। দরিদ্র শ্রেণি একদিকে বর্গায় জমি চাষ করে, অন্যদিকে ফাঁকে ফাঁকে অকৃষিজ কর্মকাণ্ডে ঢুকে পড়ে নতুবা মৌসুমি অভিবাসন ঘটায়। ফলে শিক্ষা আর শ্রমই হয়ে উঠছে জীবিকার প্রধান নিয়ামক।
বর্তমানে প্রায় সবগ্রামেই খানার মোট আয়ের সিংহভাগ আসে অকৃষিজ খাত থেকে। পতিত জমির ব্যবহার বাড়ছে। গ্রামে বাসতভিটার আকার ছোট হয়ে আসছে। খালি জায়গায় গড়ে উঠছে নার্সারি বা গবাদিপশুর ঘর। ভূমি ব্যবহারের এই পরিবর্তন নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়াছে এবং ফলশ্রুতিতে ক্ষমতায়ন হচ্ছে। খানাগুলোতে মোট শ্রমে নারীর অবদান প্রায় ৩০ শতাংশ। ফলে আমরা দেখছি যে, একদিকে চাষকৃত জমি বাড়ছে এবং বর্গাবাজারও বিস্তৃত হচ্ছে। অন্যদিকে বর্গাচাষের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের ঝুঁকির পরিবর্তে অধিকতর বাজারমুখী নির্দিষ্ট খাজনা, লিজ বা বন্ধক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এই দুই পরিবর্তনের ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া গ্রামীণ কৃষি কাঠামোর প্রচলিত চিত্রটাই পাল্টে দিয়েছে।
ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন
স্বাধীনতার প্রথম দু’দশকেও বাংলাদেশের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্রে ছিল জমির মালিকানা। তখন কৃষিতে উৎপাদিত ফসল বা জমিতে অংশগ্রহণ ছিল সচ্ছলতার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু, আমরা জানি, বর্তমানে এনজিওদের উদ্যোগ, সরকারি সুবিধা এবং রেমিট্যান্সের ফলে গ্রামীণ শ্রমবাজারে নতুন গতি এসেছে। জমি না থাকলেও এখন জীবন চলে। এনজিও অপেক্ষাকৃত কম সুদে ঋণ দেয়। এনজিও না থাকলেও রেমিট্যান্স আছে। আছে বিভিন্ন সরকারি সহায়তা। ফলে ক্ষমতা কাঠামো থেকে জমি সরে গেছে এবং একই সঙ্গে ‘আনুগত্য-সুবিধা সম্পর্ক’ও। বরং, গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে জমির মালিকানার চেয়ে ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে শিক্ষা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একসময় মুরুব্বিদের দ্বারা গ্রামের বিচার সালিশ এখন ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলার সদরে বন্দোবস্ত হয়।
ভালোর মন্দ
তবে গ্রামীণ এই আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের কিছু নেতিবাচক মাত্রাও লক্ষণীয়। একদিকে জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে মনে করে কৃষক জমিতে আরও বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করছে, অন্যদিকে অত্যধিক সার ব্যবহারের কারণে উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পাচ্ছে। এদিকে গবাদিপশুর অভাব ও চারণভূমি হ্রাস পাওয়ায় জৈব সারের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। কৃষি উপকরণের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের কারণে ছোট ও প্রান্তিক চাষি বর্গাচাষে ও উফশি ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহিত বোধ করছে। এছাড়া, পানির নিম্নস্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তন এই উন্নয়নের জন্য প্রধান হুমকি। তবে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনমন, অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, মাদকের বিস্তার এবং দখলদারিত্ব বাংলাদেশের গ্রামের বিবর্তনের একটি কালো অধ্যায়।
জীববিজ্ঞানের ভাষায় বিবর্তন মানে হচ্ছে, জীবের বৈশিষ্ট্যে কয়েক প্রজন্ম ধরে চলমান একটি পরিবর্তন। কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশের গ্রামের আর্থ-সামাজিক এই পরিবর্তন এখনও চলমান। এই পরিবর্তনকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি এবং ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে আরও নিবীড় গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ দরকার। গবেষণা বড় অনুপ্রেরণাদায়ক।
তথ্যসূত্র
বায়েস, আ ও মাহবুব হোসেন (২০০৭), গ্রামীণ মানুষ গ্রামীণ অর্থনীতি, ঢাকা, রাইটার্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও স্বরাজ।