হাওর বার্তা ডেস্কঃ পদ্মার প্রবল স্রোত আর আছড়ে পড়া ঢেউ দেখিয়ে বৃদ্ধ মোতালেব হোসেন বলছিলেন, ‘দেহেন ক্যামনে ঢেউ ভাঙছে। বালুর বস্তা না থাকলে এবার মুলফৎগঞ্জের চিহ্নও থাকত না। স্রোতে সব গাঙের পেটে লইয়া যাইতো।’ হাত বাড়িয়ে মধ্য পদ্মার দিকে ইশারা করে ষাটোর্ধ্ব মোতালেব বলেন, ঠিক ওই জায়গায় তার বসতি ছিল। হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘গত বছর জমিজমার সঙ্গে বাড়িঘর পদ্মায় খাইছে। অহন মসজিদে থাকি।’ মোতালেব হোসেন পেশায় মসজিদের ইমাম। গত বছরের আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ও মুলফৎগঞ্জে পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে অনেকের সঙ্গে তার জমিজমা ও বাড়িঘরও নদীর পেটে গেছে। এক বছর পর সম্প্রতি নদীর তীরঘেঁষা মুলফৎগঞ্জ বাজারে কথা হয় মোতালেব হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। বাজার থেকেও কানে আসছিল আছড়ে পড়া ঢেউ ও ঘূর্ণি স্রোতের আওয়াজ। গতবারের সঙ্গে পার্থক্যটা হলো এবার নতুন করে দীর্ঘশ্বাস নেই তাদের। রয়েছে আশাবাদ। গতবারের ভাঙনে সব হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন। কেননা দীর্ঘ তীরজুড়ে বালুর বস্তা ও কংক্রিটের ব্লক দিয়ে বাঁধ দেওয়ায় চলতি বর্ষা মৌসুমে নদী নতুন করে পাড় ভাঙতে পারেনি।
মোতালেব হোসেনের মতো গতবারের ভাঙনে সবকিছুই হারিয়েছেন নাজমুল হাসান নিজাম। বাজারে তার বড় দোকান ছিল। সেটিও গেছে পদ্মায়। এখন নদীর তীরেই ছোট্ট একটি দোকান পেতেছেন। হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, গতবার বালুর বস্তা (জিও ব্যাগ) ফেললে তাকে পরিবার নিয়ে উদ্বাস্তু হতে হতো না। তার মতো একই আফসোস পদ্মাপাড়ের ঘর হারানো মানুষদের। তাদের অভিযোগ, ‘আগে শুধু ভেঙেছে। ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই ছিল না। বস্তা তো দূরের কথা, একমুঠো বালুও কেউ ফেলেনি। শামীম সাব মন্ত্রী (পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম) হওয়ার পর তারা আশায় বুক বেঁধেছেন। তার উদ্যোগে এবার আর ভাঙেনি।’
গত বছর বর্ষা মৌসুমে নড়িয়া পৌরসভা, কেদারপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের অন্তত আট কিলোমিটার এলাকায় প্রবল ভাঙন হয়। এতে অন্তত সাড়ে ছয় হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। নদীতে বিলীন হয়ে যায় তিনটি বাজার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন, সরকারি-বেসরকারি পাকা ভবন, পাকা সড়কসহ অসংখ্য স্থাপনা। নিশ্চিহ্ন হয় দুইশ’ বছরের পুরনো জনপদ, বিত্তশালীরাও হয়ে পড়েন ভূমিহীন। অথচ এলাকাবাসীর দুঃখ গত বছর বর্ষার আগে জানুয়ারিতে সরকার নড়িয়া-জাজিরার ভাঙনরোধে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে। সময় মতো সেই প্রকল্প শুরু না হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ শুধু চেয়ে দেখেছেন পদ্মার ভয়াল গ্রাসের চিত্র, দেখেছেন নিজেদের স্বপ্নের সমাধি। ওই সময়ে ভাঙন ঠেকাতে তাৎক্ষণিকভাবে সাত কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও তা নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে।
ওই এলাকার স্থানীয় লোকজন ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় বছরই পদ্মার তীর ভাঙনে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। এরপরও স্থানীয় প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা তা প্রতিরোধে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছিলেন না। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে শরীয়তপুর-২ আসনে (নড়িয়া-সখিপুর) নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম। তিনি পদ্মার তীর রক্ষায় প্রকল্পের কাজ চালু করতে দৌড়ঝাপ শুরু করেন। উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ভাঙন ঠেকাতে আরও উদ্যোগী হন তিনি।
শরীয়তপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গত আগস্ট পর্যন্ত ৩১ লাখ জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে পদ্মায়। এ ছাড়া ভাঙনপ্রবণ এলাকায় ব্লক ও জিও ব্যাগ দিয়ে তীর বাঁধাই করা হয়েছে। পাশাপাশি নদী ড্রেজিংয়ের কাজও চলছে। বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে রাতদিন প্রকল্পের কাজ চলেছে। এতে এবার রক্ষা হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান।
এনামুল হক শামীম সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি পদ্মার ভাঙন ঠেকাতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন। এলাকার মানুষ হিসেবে সবার ঘরবাড়ি, হাটবাজার, সড়কের ভাঙন রোধ তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ জন্য বারবার ছুটে গেছেন প্রকল্প এলাকায়। কখনও প্রটোকল নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজের তদারকিতে। আবার কখনও সন্ধ্যায় কিংবা রাতে নিজের পরিচয় গোপন করে, মুখ ঢেকে প্রকল্প এলাকায় গেছেন কাজের দেখভাল করতে। যাতে কাজটা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তা স্পষ্ট বোঝা যায়। নড়িয়ায় পদ্মাপাড়ের মানুষ এবার এসবের ফল পেয়েছে। গোটা এলাকায় স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধে তিনি কাজ করে যাবেন।
এনামুল হক শামীম বলেন, গত বছরও পদ্মাতীরের মানুষের বেদনা ছিল, হাহাকার ছিল। এখন মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে শিখছে। নদীতীরে স্থাপিত জিও ব্যাগ ও ব্লকে হেঁটে মানুষ এখন নদী দেখতে আসে। নিরাপত্তার জন্য পুরো তীর এলাকায় সোডিয়াম লাইট স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি তীরে বিশ্রামাগারও তৈরি করা হবে।
গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে বেশ কয়েকদিন সমকালের এ প্রতিবেদক পদ্মার তীরে ভাঙনকবলিত এলাকা ঘুরেছেন। তখন সেখানে বাড়িঘর হারা হাজারো মানুষের হাহাকার ছিল। ফসলি জমি হারিয়ে, বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে দিশেহারা ছিলেন তারা। ভাঙন আতঙ্ক ছিল গোটা এলাকায়। সম্প্রতি ওই এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। এখনও পদ্মাপাড়ের মানুষের মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক থাকলেও তীর রক্ষায় স্থাপন করা সারি সারি বালুর বস্তায় তারা আশ্বস্ত হচ্ছেন। গেল এক বছরেও অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলেও তারা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন।
ভাঙন রোধে ব্যবস্থা ও পদ্মার তীর রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন কেদারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইমাম হোসেন দেওয়ান। গতবারের ভাঙনে দেওয়ান পরিবারটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েন। মুলফৎগঞ্জ বাজারে ছয়তলা প্রাইভেট ক্লিনিক, মার্কেটসহ অন্তত ২০টি দোকানের সঙ্গে তারা বসতভিটাও হারিয়েছেন।
ইমাম হোসেন দেওয়ান সমকালকে বলছিলেন, উপমন্ত্রীর দ্রুত পদক্ষেপে এবার আর নদী ভাঙেনি। তবে ভাঙনের ফলে তাদের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে। এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। তাদের এ অবস্থা হলে সাধারণ পরিবারগুলোর যে কী অবস্থা তা বুঝতে পারছেন।
ওই পরিবারের আরেক সদস্য সোহেল হোসেন দেওয়ান বাড়িঘর ও বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে গোটা পরিবার নিয়ে উপজেলা হাসপাতাল কমপ্লেক্সের একটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। হাসপাতালের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু না হওয়ায় এখনও সেখানেই বসবাস করছেন। তিনি বলেন, পদ্মা তাদের কাছে এক হাহাকার। এখন উদ্বাস্তু হয়ে কোনো রকমে জীবন ধারণ করছেন। হাসপাতাল ছেড়ে দিতে হলে কোথায় যাবেন তাও জানেন না। তবুও চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়ানোর। বাঁধ রক্ষার এমন উদ্যোগ গতবার নিলে তাদের আর বাড়ি ছাড়া হতে হতো না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।