হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ আকস্মিকভাবে ঘটেনি- এই সশস্ত্র যুদ্ধ বছর বছর ধরে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সুবর্ণ ফল। যার একক নেতৃত্বের কারণে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের রূপান্তর ঘটেছিল, যার একক নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তার প্রধান সূত্রধর ও মধ্যমনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মহান নেতার রাজনৈতিক অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরঅক্ষরে লেখা থাকবে। রামবিহীন রামায়ণ যেমন হয় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশ হতে পারে না-এই সত্য ও বাস্তবতাকে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্বের স্বার্থে দল মত সবাইকেই স্বীকার করে নিতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর সবসময় ঢাকার ধানমন্ডি ময়দানে ঈদের নামাজ পড়তেন।
এমনি এক ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি পরে জাতির পিতা ধানমন্ডি ময়দানে আসেন। নেতার গাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি ও তার সামনে ট্রাফিক পুলিশের গাড়ি। বঙ্গবন্ধুর গাড়ির সামনের আসনে ছিলেন বাবা। ধানমন্ডি ময়দানে এসে নামাজের কাতারে দাঁড়াতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তার সব সিকিউরিটি অফিসারদের ধমক দিয়ে বললেন, আপনারা এখানে আমার আশেপাশে কেন? আপনারা এখানে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? নামাজ পড়তে কি নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে? আমি সবার সাথে মিলে নামাজ পড়তে চাই। আপনারা এখান থেকে সরে দাঁড়ান।
বঙ্গবন্ধুর ধমক খেয়ে বাবাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা সরে দাঁড়ায়। একসময় জামাত শুরু হতেই তারা নেতার আশেপাশে ঘিরে বসে পড়েন। তবে বঙ্গবন্ধু নামাজের যে কাতারে ছিলেন সেই কাতারে আর কেউ বসতে সাহস করেনি। বঙ্গবন্ধু ধমক খেয়েও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা তাদের দায়িত্ব ঠিকই সেদিন পালন করেছে। অবশ্য অন্যভাবে, যেভাবে করা প্রয়োজন ছিল সেভাবে নয়। এই সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে নেতার কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলও পাশে ছিল।
আজকের গণভবনে যেখানে আমাদের বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকেন সেখানে চারিদিকে যে বড় বড় ডাব গাছ দেখছেন সেই ডাবের চাড়াগুলো লাগিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতির এই নেতা গাছকে খুব ভালো বাসতেন। বাবার মুখে শুনেছি সময় পেলে গণভবনের ভেতরে গাছের পরিচর্যা নিজ হাতেই করতে ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু। সময় হলে মাঝে মধ্যে পায়ে হেঁটে হেঁটে বাগান ঘুরে বেড়াতেন, গাছের যত্ন করতেন। কখনো কখনো নিজের হাতে গাছের চাড়াতে পানিও দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হাতে লাগানো সেই গাছগুলো এখন কত বড় হয়ে গণভবনের সৌন্দর্য রক্ষা করছে।
১৪ আগস্ট বিকালে তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধু সাথে দেখা করতে গণভবনে আসেন। তাকে বঙ্গবন্ধু আদর করে ডাকতেন সাংবাদিক ঠাকুর। ওইদিন সন্ধ্যায় গণভবনের ফুলের বাগানে হেঁটে হেঁটে তারা দুজনে কথা বলেছেন। দূর থেকে বাবা সবই লক্ষ্য করেছেন। সারাদিন তারা কী কথা বলেছেন তা আজও কারও জানা নেই। তবে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর যে একজন সাংঘাতিক ঠাকুর তা তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত থেকে প্রমাণ করেছেন। অথচ তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে জাতির জনক কত স্নেহ করতেন।
বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকেই বলেছেন নেতাকে গণভবনে এসে থাকার জন্য। কিন্তু নেতা তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। বাঙালির প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। তিনি বলতেন, পাকিস্তানের জেলে থাকাকালীন ফাঁসির নির্দেশ থেকে যখন আমাকে আল্লাহ রক্ষা করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে নিয়ে এসেছেন এখানে আমার দেশে আমাকে আর কে মারবে। আমি বাঙালি, আমি বাঙালিদের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি। বাঙালিরা আমাকে কখনো মারবে না।
বাঙালি জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর কী অসাধারণ বিশ্বাস। কিন্তু সবচেয়ে বড় দুঃখ ও কষ্ট হলো পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাহস না করলেও বাঙালি হয়ে আমরা জাতির পিতাকে হত্যা করলাম! এর চেয়ে বড় কলঙ্ক, এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কী হতে পারে! বিশ্বাস ঘাতকেরা আবারও প্রমাণ করলো মীরজাফরের রক্ত এখনো বাঙালির শিরা উপশিরায় বহমান।
বঙ্গবন্ধুর ২৪ বছরের পাকিস্তান আমলে ১২ বছর কাটিয়েছেন জেলে। কারারুদ্ধ হয়েছেন নয়বার। ১৮টি মিথ্যা মামলা ও দুইবার ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে তাকে ইতিহাস থেকে নির্বাসন দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যা ছিল সীমাহীন ধৃষ্টতার পরিচয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান একটি যমজ শব্দ। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির কথা কল্পনা করা যায় না।
তিনি বাংলাদেশের স্থপতি-এই সত্য যারা অস্বীকার করে, তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি। তারাই সেদিন পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাঙালি হয়ে বাঙালিকে হত্যা করেছে। এরাই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শকে নস্যাৎ করার লক্ষে আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা এই আদর্শের বিরোধিতা আগাগোড়াই করে আসছে। এসব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কারণেই এই মহান নেতার মরদেহ রাজধানী ঢাকায় সমাহিত না করে করা হয়েছিল টুঙ্গিপাড়ায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্র দর্শনের রূপকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেওয়া হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল্যবোধকে ধ্বংস করা হয়।
লেখক: গ্রুপ লিডার, সুইডিশ লেফট পার্টি স্টকহলম হেঁসেলবি ভেলেংবি লোকাল কাউন্সিল।