ঢাকা ০৪:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউরিক এসিড বাড়ে কেন, বাড়লে কী খাবেন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৮:১৫:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ জুন ২০১৯
  • ২৮৫ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইউরিক এসিড এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া” এই সমস্যাটি কমবেশি সবাই জানেন এবং অনেকের এর সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই বলে খাবার বাছাই নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পরেন। তাই এই বিষয়ে বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই জানতে হবে ইউরিক এসিড কি এবং কেন এর মাত্রা বেড়ে যায়? আমাদের দেহে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, বাইকার্বনেট বা এলকালাইন অর্থাৎ ইলেকট্রোলাইটস এর ব্যালেন্স রক্ষায় ইউরিক এসিড এর ভুমিকা আছে। সবার রক্তে এটি খুব অল্প পরিমানে থাকে যা মূলতঃ দেহের ডেড সেল এবং খাদ্যের উপাদান পিউরিন থেকে উৎপন্ন হয়। তবে এটি আমাদের দেহের একটি টক্সিক উপাদান। আমরা যা খাই তার যতটুকু পুষ্টি উপাদান দেহের প্রয়োজন, শোষন ও বিপাক এর মাধ্যমে তার চাহিদা পূরণের পর বাকিটা দেহ থেকে বর্জ্য হিসাবে মল,মূত্র, ঘাম, শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। ইউরিক এসিড ও এমন একটি উপাদান যা দেহের নির্দিষ্ট পরিমানের বেশি হলে দেহ থেকে অপসারণের মাধ্যমে আমাদের দেহে সামঞ্জস্যতা থাকে।

স্বাভাবিকভাবে ইউরিক এসিড, পিউরিন সমৃদ্ধ গৃহীত খাদ্য থেকে আমাদের দেহের যকৃতে উৎপন্ন হয়ে রক্তে মিশে যায় এবং রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে কিডনিতে পৌছায়। কিডনি একে দেহ থেকে বের করে দেয়।

মূলতঃ আমাদের দেহের অভ্যন্তরে তিন ভাগের দুই ভাগ ইউরিক এসিডই যকৃত বা লিভারে তৈরি হয়। বাকিটা অর্থাৎ এক ভাগ খাবার থেকে গৃহীত হয়। যকৃতে উৎপন্ন বাড়তি ইউরিক এসিড কিডনির কার্যকারিতায় মূত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে অপসারণ হয়। কিন্তু মূত্রের মাধ্যমে যা বের হয় এবং যকৃতে যা উৎপন্ন হয়, খাবার থেকে অতিমাত্রায় পিউরিন গৃহীত হলে, এর ঘনত্ব বেড়ে, বেশি মাত্রায় উৎপন্ন হলে তখন রক্তে ইউরিক এসিড এর মাত্রা বেড়ে যায়।

এখন বলব, মাত্রাতিরিক্ত ইউরিক এসিড আমাদের দেহে কি কি ক্ষতি করে? ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে দেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অংগ বিশেষ করে কিডনির উপরে দীর্ঘদিন জমলে রেনাল স্টোন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। ফলে কিডনি ঠিক মত কাজ করে না এবং মুত্রের মাধ্যমে ইউরিক এসিড ও অন্যান্য বর্জ্য শরীর থেকে বের হতে পারে না। কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয় এবং কিডনি ড্যামেজ ও হয়। এছাড়াও বাড়তি ইউরিক এসিড শরীরের হাড়ের বিভিন্ন জয়েন্টে ক্রিস্টাল এর মত হয়ে জমে যায়, যাতে করে অনেক রোগীর হাড়ের সন্ধিস্থলে ফুলে যায় এবং খুব ব্যাথা হয়। এই রোগের নামই গাউট বা গেটে বাত। সোডিয়াম এর মাত্রা নিয়ন্ত্রনে এর ভুমিকা থাকায় হাইপ্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়াও অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতাসহ হার্ট ডিজিজ এর সম্ভাবনা ও বেড়ে যায়।

এখন জেনে নেই, আমাদের শরীরে ইউরিক এসিড কতটুকু থাকা প্রয়োজন? সাধারণত এর পরিমাণ পূর্ন বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ৭ মিলিগ্রাম এবং নারীদের ৬ মিলিগ্রাম থাকা উচিত। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এর মাত্রা জেনে নেয়া উচিত। স্বাভাবিক এর চাইতে মাত্রাটা বেড়ে গেলে শীঘ্রই ডাক্তার দিখিয়ে ওষুধ গ্রহন করতে হবে এবং অবশ্যই খাবার গ্রহনে কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।

এখন আসি কোন কোন খাবার থেকে ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যায়? যদি দেহে অতিমাত্রায় পিউরিনযুক্ত প্রানীজ প্রোটিন এর বিশ্লেষণ বেশি হয় এবং বিশেষ করে লাল মাংস যেমনঃ গরু, খাসী, ষাড় এর মাংস, মাছের ডিম, কলিজা ইত্যাদি যদি বেশী খাওয়া হয় তবে ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেক বেশী হয়। এছাড়াও পিউরিন সমৃদ্ধ শাক-সবজি ও বীচি জাতীয় খাবার যেমনঃ বিভিন্ন ডাল, বীচি, মাশরুম, পালং শাক, সীম, বরবটি, ফলের মধ্যে আম, কলা, সফেদা, খেজুর, কিসমিস, আখ, তাল ইত্যাদি।

এছাড়াও অতিরিক্ত চিনি খেলেও ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার প্রবনতা ত্বরান্বিত হয়। তাছাড়াও যারা ওবেসিটি স্টেজে আছেন তাদের ক্ষেত্রে ও ইউরিক এসিড বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। ক্যান্সারের রোগীদের ও ইউরিক এসিড বেড়ে যেতে পারে। যারা খুব অনিয়মের মধ্যে খাওয়া দাওয়া করেন এবং অনেক বেশি সময় না খেয়ে থাকেন, তাদেরও ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এখন বলছি, ইউরিক এসিড বেশি হলে কি কি খাওয়া যাবে? সাধারণত প্রানীজ খাবারের মধ্যে সব ধরনের বড় ও ছোট মাছ, মুরগীর মাংস, ডিম, লো ফ্যাট দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার এবং শস্যের মধ্যে জটিল কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ লালচাল, লাল গমের আটা, ওটস, সাগু, ভুট্টা, চিড়া ইত্যাদি শাক-সবজির মধ্যে লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, আলু, মিষ্টি আলু, পটল, ঝিংগা, চিচিংগা, করলা, কাকরোল, ঢেড়শ, কলার থোড়, মোচা, সবুজ কলমি শাক, লাউ/কুমড়ো শাক, গাজর, মূলা, বিটরুট, ক্যাপ্সিকাম, বাধাকপি, টমেটো, শসা ইত্যাদি, ফলের মধ্যে সাইট্রাস (টক) যুক্ত ফলগুলো যেমনঃ কমলা, মাল্টা, লেবু, আমলকি, জাম্বুরা, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি, আঙুর, আমড়া, আনারস, জাম, বেদানা, খেজুর ইত্যাদি খাওয়া যাবে।

লেখকঃ সোনিয়া শরমিন খান
নিউট্রিশনিস্ট ও ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান
সিটি হেলথ সার্ভিসেস লিমিটেড।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

ইউরিক এসিড বাড়ে কেন, বাড়লে কী খাবেন

আপডেট টাইম : ০৮:১৫:২৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ জুন ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইউরিক এসিড এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া” এই সমস্যাটি কমবেশি সবাই জানেন এবং অনেকের এর সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই বলে খাবার বাছাই নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পরেন। তাই এই বিষয়ে বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই জানতে হবে ইউরিক এসিড কি এবং কেন এর মাত্রা বেড়ে যায়? আমাদের দেহে পটাশিয়াম, সোডিয়াম, বাইকার্বনেট বা এলকালাইন অর্থাৎ ইলেকট্রোলাইটস এর ব্যালেন্স রক্ষায় ইউরিক এসিড এর ভুমিকা আছে। সবার রক্তে এটি খুব অল্প পরিমানে থাকে যা মূলতঃ দেহের ডেড সেল এবং খাদ্যের উপাদান পিউরিন থেকে উৎপন্ন হয়। তবে এটি আমাদের দেহের একটি টক্সিক উপাদান। আমরা যা খাই তার যতটুকু পুষ্টি উপাদান দেহের প্রয়োজন, শোষন ও বিপাক এর মাধ্যমে তার চাহিদা পূরণের পর বাকিটা দেহ থেকে বর্জ্য হিসাবে মল,মূত্র, ঘাম, শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। ইউরিক এসিড ও এমন একটি উপাদান যা দেহের নির্দিষ্ট পরিমানের বেশি হলে দেহ থেকে অপসারণের মাধ্যমে আমাদের দেহে সামঞ্জস্যতা থাকে।

স্বাভাবিকভাবে ইউরিক এসিড, পিউরিন সমৃদ্ধ গৃহীত খাদ্য থেকে আমাদের দেহের যকৃতে উৎপন্ন হয়ে রক্তে মিশে যায় এবং রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে কিডনিতে পৌছায়। কিডনি একে দেহ থেকে বের করে দেয়।

মূলতঃ আমাদের দেহের অভ্যন্তরে তিন ভাগের দুই ভাগ ইউরিক এসিডই যকৃত বা লিভারে তৈরি হয়। বাকিটা অর্থাৎ এক ভাগ খাবার থেকে গৃহীত হয়। যকৃতে উৎপন্ন বাড়তি ইউরিক এসিড কিডনির কার্যকারিতায় মূত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে অপসারণ হয়। কিন্তু মূত্রের মাধ্যমে যা বের হয় এবং যকৃতে যা উৎপন্ন হয়, খাবার থেকে অতিমাত্রায় পিউরিন গৃহীত হলে, এর ঘনত্ব বেড়ে, বেশি মাত্রায় উৎপন্ন হলে তখন রক্তে ইউরিক এসিড এর মাত্রা বেড়ে যায়।

এখন বলব, মাত্রাতিরিক্ত ইউরিক এসিড আমাদের দেহে কি কি ক্ষতি করে? ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে দেহের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অংগ বিশেষ করে কিডনির উপরে দীর্ঘদিন জমলে রেনাল স্টোন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। ফলে কিডনি ঠিক মত কাজ করে না এবং মুত্রের মাধ্যমে ইউরিক এসিড ও অন্যান্য বর্জ্য শরীর থেকে বের হতে পারে না। কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট হয় এবং কিডনি ড্যামেজ ও হয়। এছাড়াও বাড়তি ইউরিক এসিড শরীরের হাড়ের বিভিন্ন জয়েন্টে ক্রিস্টাল এর মত হয়ে জমে যায়, যাতে করে অনেক রোগীর হাড়ের সন্ধিস্থলে ফুলে যায় এবং খুব ব্যাথা হয়। এই রোগের নামই গাউট বা গেটে বাত। সোডিয়াম এর মাত্রা নিয়ন্ত্রনে এর ভুমিকা থাকায় হাইপ্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়াও অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতাসহ হার্ট ডিজিজ এর সম্ভাবনা ও বেড়ে যায়।

এখন জেনে নেই, আমাদের শরীরে ইউরিক এসিড কতটুকু থাকা প্রয়োজন? সাধারণত এর পরিমাণ পূর্ন বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ৭ মিলিগ্রাম এবং নারীদের ৬ মিলিগ্রাম থাকা উচিত। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এর মাত্রা জেনে নেয়া উচিত। স্বাভাবিক এর চাইতে মাত্রাটা বেড়ে গেলে শীঘ্রই ডাক্তার দিখিয়ে ওষুধ গ্রহন করতে হবে এবং অবশ্যই খাবার গ্রহনে কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে।

এখন আসি কোন কোন খাবার থেকে ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে যায়? যদি দেহে অতিমাত্রায় পিউরিনযুক্ত প্রানীজ প্রোটিন এর বিশ্লেষণ বেশি হয় এবং বিশেষ করে লাল মাংস যেমনঃ গরু, খাসী, ষাড় এর মাংস, মাছের ডিম, কলিজা ইত্যাদি যদি বেশী খাওয়া হয় তবে ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেক বেশী হয়। এছাড়াও পিউরিন সমৃদ্ধ শাক-সবজি ও বীচি জাতীয় খাবার যেমনঃ বিভিন্ন ডাল, বীচি, মাশরুম, পালং শাক, সীম, বরবটি, ফলের মধ্যে আম, কলা, সফেদা, খেজুর, কিসমিস, আখ, তাল ইত্যাদি।

এছাড়াও অতিরিক্ত চিনি খেলেও ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার প্রবনতা ত্বরান্বিত হয়। তাছাড়াও যারা ওবেসিটি স্টেজে আছেন তাদের ক্ষেত্রে ও ইউরিক এসিড বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। ক্যান্সারের রোগীদের ও ইউরিক এসিড বেড়ে যেতে পারে। যারা খুব অনিয়মের মধ্যে খাওয়া দাওয়া করেন এবং অনেক বেশি সময় না খেয়ে থাকেন, তাদেরও ইউরিক এসিড বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

এখন বলছি, ইউরিক এসিড বেশি হলে কি কি খাওয়া যাবে? সাধারণত প্রানীজ খাবারের মধ্যে সব ধরনের বড় ও ছোট মাছ, মুরগীর মাংস, ডিম, লো ফ্যাট দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার এবং শস্যের মধ্যে জটিল কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ লালচাল, লাল গমের আটা, ওটস, সাগু, ভুট্টা, চিড়া ইত্যাদি শাক-সবজির মধ্যে লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, আলু, মিষ্টি আলু, পটল, ঝিংগা, চিচিংগা, করলা, কাকরোল, ঢেড়শ, কলার থোড়, মোচা, সবুজ কলমি শাক, লাউ/কুমড়ো শাক, গাজর, মূলা, বিটরুট, ক্যাপ্সিকাম, বাধাকপি, টমেটো, শসা ইত্যাদি, ফলের মধ্যে সাইট্রাস (টক) যুক্ত ফলগুলো যেমনঃ কমলা, মাল্টা, লেবু, আমলকি, জাম্বুরা, পেয়ারা, আপেল, নাশপাতি, আঙুর, আমড়া, আনারস, জাম, বেদানা, খেজুর ইত্যাদি খাওয়া যাবে।

লেখকঃ সোনিয়া শরমিন খান
নিউট্রিশনিস্ট ও ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান
সিটি হেলথ সার্ভিসেস লিমিটেড।