কিশোরগঞ্জ করিমগঞ্জ হাওরাঞ্চলে ৩৩ লাখ টাকার রাস্তা দুই মাস না যেতেই পানিতে

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার হাওরাঞ্চলে ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি কংক্রিকেট রাস্তা দুই মাস না যেতেই কাদাপানিতে মিশে গেছে। উপজেলার সুতারপাড়া ইউনিয়নে সুতারপাড়া ও খাকশ্রী গ্রামের মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাটি হাওরের ঢেউয়ের তোড়ে এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন। গ্রামবাসীর অভিযোগ, এতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। রাস্তাটি রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে অপরিকল্পিতভাবে তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ দেখিয়ে প্রকল্পের অর্থ নয়ছয় করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মাটি ফেলে ইটের সলিংয়ের ওপর কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে দুই মাস আগে তৈরি রাস্তাটি এখন প্রায় বিলীন। এলাকাবাসী জানায়, হাওর ঘেঁষা হওয়ায় রাস্তা রক্ষার জন্য পাশ দিয়ে কংক্রিটের স্ল্যাব দেওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি। বর্ষাকালে হাওরের ঢেউয়ে ঘরবাড়ি পর্যন্ত ভেঙে যায়। সেখানে প্রতিরক্ষা প্রাচীর না দিয়ে রাস্তা করায় তা দুই মাসও টেকেনি। সুতারপাড়া ইউনিয়নের আদু মুন্সি ও বাদল মিয়া জানান, ধান মাড়াইয়ের খলা থেকে মাটি কেটে রাস্তায় ফেলা হয়। এখন রাস্তাও টিকল না, খলাও নষ্ট হলো। এ যেন আমও গেল, ছালাও গেল!

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাওরের ঢেউয়ে প্রতিবছর ভাঙনের শিকার হতো সুতারপাড়া ও খাকশ্রী গ্রাম। বেসরকারি সংস্থা কেয়ারের উদ্যোগে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মিত হলে ভাঙনের কবল থেকে রেহাই পায় দুই গ্রামের মানুষ। তবে গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একটি রাস্তার। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি কংক্রিটের রাস্তা নির্মাণের জন্য ৩৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু গ্রামবাসীর মতামত উপেক্ষা করে প্রতিরক্ষা দেয়ালের বাইরের পাশ দিয়ে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়। ফলে তা হাওরের ঢেউয়ের তোড়ে পানিতে মিশে গেছে।

করিমগঞ্জ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের কাবিখা প্রকল্পের আওতায় বালিখলা বাজার থেকে সুতারপাড়া গ্রামের শেষ পর্যন্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তার জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৩৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের সভাপতি করা হয় সুতারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদকে।

খাকশ্রী গ্রামের আবদুল আলী, আবদুল হালিমসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, রাস্তা রক্ষায় পাশ দিয়ে প্লাস্টিকের বস্তা ও বাঁশের বেষ্টনী দেওয়ার কথা বলেছিলেন প্রকল্পের সভাপতি হারুন অর রশিদ। এগুলোর কিছু করা হয়নি। তারপরও কিছু অংশে গ্রামবাসী নিজেদের খরচে বাঁশ ও বস্তার বেষ্টনী দিয়ে রাস্তাটি রক্ষার চেষ্টা করে। তবে এই সামান্য উদ্যোগ কোনো কাজে আসছে না।

সুতারপাড়া ও খাকশ্রী গ্রামে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে অভিযোগ করেছেন, রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের অর্থ হরিলুট হয়েছে। দুর্নীতি করতেই এমন একটি উদ্ভট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এর কারিগরি ও প্রকৌশলগত দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তাছাড়া প্রকল্পের সভাপতির কারিগরি ও প্রকৌশলগত জ্ঞান নেই। তিনি যা ইচ্ছা তাই করেছেন। যে কারণে অবধারিত পরিণতি পেয়েছে রাস্তাটি। এ বিষয়ে খাকশ্রী গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দাখিল করেছেন।

জানতে চাইলে প্রকল্পের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ বলেন, প্রকল্পের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা খুবই সামান্য। এ টাকা দিয়ে হাওরে রাস্তা হয় না। বলা হয়েছিল, রাস্তা সুরক্ষায় আলাদা বরাদ্দ দেওয়া হবে; কিন্তু তাও পাওয়া যায়নি। ফলে রাস্তা টেকানো যায়নি। তিনি দাবি করেন, রাস্তা রক্ষার জন্য নিজের পকেটের টাকা দিয়ে বস্তা কিনে লোকজনকে দিয়েছিলেন। তবে তা যথেষ্ট ছিল না।

করিমগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাস্তায় মাটি কাটার সময় নিজেও প্রকল্পটি পরিদর্শন করেছি। বর্ষা মৌসুম চলে আসা এবং সুরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হাওরের ঢেউয়ে রাস্তাটি ভেঙে গেছে। এখন নতুন বরাদ্দ দিয়ে রাস্তাটি আবার নির্মাণ করা ছাড়া উপায় নেই।

তবে কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোকররম হোসেন বলছেন, রাস্তায় মাটি কাটা মোটামুটি ঠিক থাকলেও প্রকল্প নির্বাচন ও এর কারিগরি দিক ঠিক ছিল না। স্থানীয় জনগণের মতামত নিয়ে তারা কী ধরনের রাস্তা চায়, রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে হবে-এসব মাথায় রেখে প্রকল্প নির্বাচন করা উচিত ছিল। কিন্তু করিমগঞ্জের এই রাস্তাটি নির্মাণে তা হয়নি। ফলে ৩৩ লাখ টাকাই পানিতে গেছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর