সুরমায় ভাঙনে, হুমকিতে সুনামগঞ্জের ৭ গ্রাম

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ‘গাঙ্গের ভাঙ্গন কেউ আর থামাইতে পারে না, খালি ভাঙ্গে আর ভাঙ্গে। ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি, দোকানপাট-জায়গা-জমি হারিয়ে এখন আর সরে যাওয়ার জায়গাও নাই। বর্ষায় প্রবল স্রোত নদীর পাড়ের মাটি ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে যায়। গাঙ্গ ভাঙ্গে আর ভাঙ্গে’ এভাবেই নদী ভাঙনের কথা বলছিলেন মংলারগাঁও গ্রামের শরীফ উদ্দিন। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মংলারগাঁও গ্রামের একজন স্বচ্ছল কৃষক ছিলেন তিনি। কিন্তু টানা নদী ভাঙনের কবলে পড়ে এখন সর্বশান্ত। সবশেষ তার বসতভিটাও নদী গর্ভে বিলীনের অপেক্ষায়। এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- দোয়ারাবাজার উপজেলার সদর, নৈনংগাঁও, মংলারগাঁও, মাঝেরগাঁও, মুরাদপুর, পূর্ব মাছিমপুর ও পশ্চিম মাছিমপুরের ৭ গ্রামের বিভিন্ন এলাকা এখন নদীর ভাঙনে ভাঙনে রীতিমতো বিপর্যস্ত।

মংলারগাঁও গ্রামের কৃষ্ণ মোহন দাস জানান, গত ১২ বছরে নদী কমপক্ষে ১০০ মিটার ভেঙেছে। মূল নদী তাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে ছিল। কিন্তু এখন নদীর দক্ষিণ পাড়ে বিশাল চর জেগে উঠেছে। নদী চলে এসেছে তাদের বাড়ির আঙিনায়। কিন্তু এতদিন পেরিয়ে গেলেও ভাঙন রোধে কেউ কোনও উদ্যোগ নেয়নি। ফলে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব সময় নদী ভাঙছে। এখন নদী ভাঙন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। মংলারগাঁও গ্রামের দক্ষিণ দিকে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। কিছুদিন পরপর এসব ফাটল নদী গর্ভে ধসে যায়। মংলারগাঁও গ্রামের শেলী দাস বলেন, ‘এক সময় আমাদের ঘরবাড়ি-জায়গা-জমি, ফলের বাগান অনেক কিছু ছিল। কিন্তু এখন কিছুই নেই। সব নদী গর্ভে চলে গেছে। পাড়ার আরও ১৫টি বসতঘর নদীতে হারিয়ে যাওয়ার পথে।’

দোয়ারাবাজার মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র তাহমিদ মোহাম্মদ মাহদী জানায়, তাদের চলাচলের সড়কটি নদীতে ভেঙে যাওয়ায় স্কুলে আসা-যাওয়া করতে অসুবিধা হয়। গাড়ি তো দূরের কথা, রিকশাও এ সড়ক দিয়ে চলাচল করতে পারে না।

একই স্কুলের ছাত্রী ফাহমিদা আক্তার জানায়, নদী ভাঙনের কারণে তারা পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা করে। বর্ষাকালে অসুবিধা অনেক বেড়ে যায়। সড়কের পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। মুরাদপুর গ্রামের সিএনজি চালক ইয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘সুরমা নদীর ভাঙনে ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়ক ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। অনেক দোকানপাট নদী গর্ভে চলে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা পথে বসেছে। আমি ব্যবসায়ী ছিলাম। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অবশেষে সিএনজিচালকের খাতায় নাম লিখিয়েছি। এখন সড়ক ভেঙে যাওয়ায় গাড়ি চালাতেও সমস্যা হচ্ছে। এতদিন ধরে নদী ভাঙন চলতে থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা রোধে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।’

দোয়ারাবাজার উপজেলার স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী মোঃ আশিক মিয়া জানান, তাদের বাড়ি নৈনগাঁও গ্রামে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা নদী। তাই তাদের গ্রামেও ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘যেভাবে ভাঙন দেখা দিয়েছে তাতে প্রতিরোধ করা না গেলে দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। ইতোমধ্যে উপজেলা পরিষদের বেশ কয়েকটি ভবন ভাঙনের হুমকির মুখে পড়েছে। উপজেলা পরিষদের প্রধান সড়ক প্রতি বছর নদীতে ভেঙে পড়ে যায়। পরে শুধু বিকল্প সড়ক তৈরি করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়। কিন্তু ভাঙন প্রতিরোধে আজ পর্যন্ত কোনও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি সরকার। উপজেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি সদরুল ইসলাম বলেন, ‘নদী ভাঙনে প্রতি বছর ৫০টিরও বেশি ঘরবাড়ি বিলীন হচ্ছে। মসজিদ, মাদ্রাসা সব নিয়ে গেছে নদী। আগামী বর্ষায় উপজেলা পরিষদের বেশ কয়েকটি ভবন নদী গর্ভে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দোয়ারাবাজার নদী ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম জানান, অনেকদিন ধরে তারা আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনও কাজ হচ্ছে না। মানববন্ধন,বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু কারো ঘুম ভাঙেনি। দ্রুত ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

গত ১২ বছরে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় সুরমা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে ঘরবাড়ি, কৃষি, অকৃষি জমি, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও দোকানপাট। নদী ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে উপজেলা পরিষদের বেশ কয়েকটি ভবন।উপজেলাবাসীর অভিযোগ, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলার কারণে ১২ বছরেরও নদী ভাঙন প্রতিরোধে কোনও প্রকল্প নেওয়া হয়নি। সুরমা নদী বেস্টিত জনপদ দোয়ারাবাজার উপজেলা। নদী ভাঙনের ফলে উপজেলার নৈনংগাঁও, মংলারগাঁও, মাঝেরগাঁও, মুরাদপুর, পূর্ব মাছিমপুর ও পশ্চিম মাছিমপুরসহ সাত গ্রামের অধিকাংশ ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন,  উপজেলা সদরের সড়ক, ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়কসহ বেশ কিছু স্থাপনা নদী ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। নদী ভাঙনে ৪৫৮টি পরিবারের ২ হাজার ৬৭১ জন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, নদী ভাঙনের ফলে আড়াইশো বিঘা কৃষি জমি ও ১৭০টি বসতবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে স্থানীয়দের দাবি, ৫০০ বিঘা কৃষি জমি ও আড়াই শতাধিক বাড়িঘর বিলীন হয়েছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভাঙনের তীব্রতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। উপজেলা সদরের প্রধান সড়কের ১০০ মিটারের মতো পাকা সড়ক নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়ক। স্থানীয়রা জানান, মূল সড়কের ভাঙন রোধে বাঁশের আড়া দিয়ে কিছু বস্তা ফেলা হয়েছিল। সেগুলোও এখন ভেঙে যাচ্ছে। দোকানের পাশে থাকা পাকা খেয়াঘাটটিও নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়্যারম্যান মোঃ ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীক বলেন, ‘নদীতে চর পড়ার কারণে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। মূল নদীর পুরোটা এখন চর হয়ে গেছে। দুটো চর কেটে নেওয়ার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। ভাঙন রোধে ব্লক স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছি। দাবির প্রেক্ষিতে সরকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস জানান, গত মাসে নদী ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতির একটি পরিসংখ্যান প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হয়েছে।

তাতে বলা হয়েছে, উপজেলার ৪৫৮টি পরিবার নদী ভাঙনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের ২ হাজার ৬৭১ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ২০টি পরিবারকে খাসজমি বন্দোবস্তের মাধ্যমে পুর্নবাসনের জন্য জেলা অফিসে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এটি অনুমোদন পেলে ২০টি পরিবারকে পুর্নবাসন করা যাবে। এছাড়া নদী ভাঙনের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে লিখিতভাবে একাধিকবার জানানো হয়েছে। ভাঙন কবলিত স্থান বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক পরিদর্শন করেছেন। ভাঙন প্রতিরোধে বিভিন্ন সময় কাজ হয়েছে।

গত বছরও ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সটি রক্ষায় বালির বস্তাসহ ডেলপিং করা হয়। কিন্তু ভাঙনের তীব্রতা বেশি এবং বরাদ্দ অপর্যাপ্ত হওয়ায় ফুল প্রটেকশনে যাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, ‘শুরুতে ভাঙন সীমিত আকারে থাকলেও সম্প্রতি তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে দেড় থেকে দুই কিলোমিটার জায়গায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এই ভাঙন প্রতিরোধ করতে হলে সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। এজন্য বড়ো ধরনের বাজেটের প্রয়োজন। এটি না থাকায় প্রটেকটিভ ওয়ার্ক করা যাচ্ছে না। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ভাঙন প্রতিরোধে তারা বড় ধরনের প্রকল্প জমা দিয়েছে। অনুমোদন পেলে তারা কাজ শুরু করবে। এটি মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলে পূর্ব মাছিমপুর থেকে নৈনগাঁও গ্রাম পর্যন্ত পুরো এলাকা রক্ষা করা যাবে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জুলফিকার আলী হাওলাদার বলেন, ‘নদী ভাঙন রোধে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে কাজ শুরু করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর