বাঙালির ইতিহাসের সংগ্রহশালা

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে এই অঞ্চলের বহুমাত্রিক ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যেই জামালপুরের মেলান্দহে মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটি নির্মিত হয়। এর পুরো নাম গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর। এ নামই বলে দেয় এটি ইতিহাস আর সংগ্রাম-আন্দোলনের পরম্পরার এক ঐতিহাসিক স্মারক।
ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে গান্ধীর স্বদেশি চেতনাকে ধারণ করে তত্কালীন জামালপুর মহকুমা কংগ্রেসের সম্পাদক নাসিরউদ্দিন সরকার ১৯৩৪ সালে এই আশ্রম গড়ে তোলেন। এই আশ্রমে তিনি গ্রামের মানুষদের স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, লেখাপড়া, চরকায় সুতা তৈরি ও শরীরচর্চা কার্যক্রম চালাতেন।
বিভিন্ন সময় এ আশ্রমে এসেছেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আন্দামান ফেরত কমরেড রবি নিয়োগী, কমরেড মণি সিংহ, বারীণ দত্ত, কমরেড আশুতোষ দত্ত, খোকা রায়, অনীল মুখার্জী, প্রফেসর শান্তিময় রায়, নগেন মোদক, বিধুভূষণ সেন, সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ, নরেন নিয়োগী, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, মন্মথনাথ দে, খন্দকার আবদুল বাকী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কৃষক নেতা হাতেম আলী খান ও হেমন্ত ভট্টাচার্যসহ অনেক বিশিষ্টজন। দেশমাতৃকা রক্ষায় এই গুণিজনেরা বিভিন্ন সময় এই আশ্রমে গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন।
মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের নিভৃত একটি গ্রামের নাম কাপাশহাঁটিয়া। এ গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ঝিনাই নদী। একসময় এ নদী ছিল তীব্র খরস্রোতা।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে গান্ধীর স্বদেশি মন্ত্রে তখন দীক্ষা নিয়েছে ভারতবর্ষের মানুষ। ব্রিটিশদের অত্যাচার আর নিপীড়ন থেকে ভারতবর্ষকে রক্ষার জন্য পুরো ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তখন গড়ে ওঠে গান্ধী আশ্রম। এ সময়টাতেই নিভৃত গ্রাম ঝাউগড়ার নাসিরউদ্দিন সরকার নামের এই গান্ধীভক্ত স্বউদ্যোগে গড়ে তোলেন গান্ধী আশ্রম।
ভারতবর্ষের ব্রিটিশপূর্ব ও ব্রিটিশপরবর্তী, পাকিস্তানি শাসনকাল, ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের নানা ঘটনাকে তুলে ধরতে এই গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর এখনও কাজ করে যাচ্ছে।
আশ্রম এলাকাটি খুবই নির্জন আর প্রত্যন্ত হওয়ায় যেকোনো ধরনের বৈঠক এখানে নিরাপদে সম্পন্ন করা যেত। পরবর্তী সময়ে দেশভাগের পর মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা ১৯৪৮ সালে এই আশ্রম ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এ সময় তারা আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা নাসিরউদ্দিন সরকারকে বেধড়ক মারধর করে তাকে মৃত ভেবে জঙ্গলের পাশে ফেলে রেখে যায়। এ হামলায় নাসিরউদ্দিন সরকারের বুকের পাঁজর ভেঙে যায়। এর পর থেকে এই আশ্রমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে ২০০৬ সালে স্থানীয় এলাকাবাসীর সহায়তায় ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে আশ্রমের সেই পুরনো অফিস ঘরটিকে কেন্দ্র করে পুনরায় গড়ে তোলা হয় গান্ধী আশ্রমটি। এ সময় এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটি।
বর্তমানে এই গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর নতুন প্রজম্মের শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে উঠেছে ইতিহাস শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। এ জাদুঘরে প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্তর থেকে ছুটে আসা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে ।
এখানে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে সংরক্ষিত আছে স্বদেশি আন্দোলনের সময়কার আশ্রমে ব্যবহূত চরকা, পুরনো সিন্দুক, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, আশ্রমের সেই সময়কার ছাত্রীদের তৈরি নানান সূচিকর্ম ও পাঠাগারের দুর্লভ বই। এ ছাড়াও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটিতে রয়েছে মুক্তি সংগ্রামের নানা স্মৃতচিহ্নের ছবি, বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি, মুক্তিযুদ্ধের নানা তথ্য-উপাত্ত, আলোকচিত্র ও দলিলপত্রসহ নানা উপকরণ। এখানে প্রতিদিন নিয়মিত প্রদর্শন করা হয় ইতিহাসের প্রামাণ্যচিত্র।
আশ্রমের মূল আদর্শকে ধারণ করে কর্তৃপক্ষ এখানে গ্রামের দরিদ্র ছেলেমেয়েদের স্বনির্ভর করতে বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে।
এক একর জমির ওপর নির্মিত মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটির ভবনের নকশা নির্মাণ করেন স্থপতি মহুয়া নাহাজ খলিল। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কাউকেই আকৃষ্ট করবে।
গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালক উত্পলকান্তি ধর বলেন, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে এই অঞ্চলের বহুমাত্রিক ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যেই গান্ধী আশ্রমের পাশাপাশি এখানে মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এ অঞ্চলের লড়াই সংগ্রামের স্মারক, তথ্য-উপাত্ত, আলোকচিত্র, দলিলপত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে এই মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরটিকে সমৃদ্ধ এক সংগ্রহশালায় পরিণত করার লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘরের ট্রাস্টি হিল্লোল সরকার বলেন, এই গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর তরুণ প্রজম্মসহ দেশবাসীকে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাসের যথার্থ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে ।
তিনি বলেন, এই দুটি প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণ ও দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে আমাদের বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর