আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস কাল সাক্ষরতা বাড়ছে শুধু সংখ্যার হিসাবেই

 

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে দেশ নিরক্ষরমুক্ত করতে হবে। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গত এক বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছে মাত্র ০.৮০ শতাংশ। সাক্ষরতা বাড়ানোর একমাত্র প্রকল্পটি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাক্ষরতার হার নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি তথ্যে এখনো বড় ফারাক। এমনকি সাক্ষরতার আন্তর্জাতিক সংজ্ঞার সঙ্গেও আমাদের সাক্ষরতা কার্যক্রমের মিল নেই। ফলে গতিহীন সাক্ষরতা কার্যক্রমে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার পরিকল্পনা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এ অবস্থায়ই আগামীকাল মঙ্গলবার পালিত হবে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২০’। এবারের প্রতিপাদ্য ‘কভিড-১৯ সংকট : সাক্ষরতা শিক্ষায় পরিবর্তনশীল শিখন-শেখানো কৌশল এবং শিক্ষাবিদদের ভূমিকা’। দেশে এই দিবসটি নানা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করা হলেও সারা বছর খোঁজ থাকে না। ফলে সাক্ষরতার হার বাড়ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের হিসাবে দেশে তখন পর্যন্ত গড় সাক্ষরতার হার ৭৩.৯০ শতাংশ। গতকাল রবিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭০ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছে ০.৮০ শতাংশ।

গণসাক্ষরতা অভিযান ২০১৬ সালে সাক্ষরতার হার নিয়ে সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, সাক্ষরতার হার ৫১.৩০ শতাংশ। বর্তমানে বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) কোনো জরিপ না থাকলেও বেসরকারি হিসাবে সাক্ষরতার হার প্রায় ৬০ শতাংশ বলে মত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে, দেশের তিন-চতুর্থাংশই সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। এটা গড় হিসাব। গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষ বিবেচনা করলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যাবে। আর আমরা এখন যে তথ্য পাচ্ছি, সেটা খানা জরিপের তথ্য নয়। সাক্ষরতার হার ও সংজ্ঞা নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে। ইউনেসকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী যদি জরিপ করা যায়, তাহলে আমরা প্রকৃত চিত্র জানতে পারব। আমি বলব, সাক্ষরতা বাড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবদানই বেশি। প্রকল্প দিয়ে সাক্ষরতা বাড়ানোর চিত্র সন্তোষজনক নয়।’

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিবিএস সাক্ষরতার হার নিয়ে জরিপ করার সময় মানুষের কাছে জানতে চায়, আপনি লিখতে পারেন কি না? সে বলল পারি। হয়তো সে সাক্ষর করতেও জানে। কিন্তু তাকে যদি এক পৃষ্ঠা লিখতে দেওয়া হয়, তাহলে সে পারবে না। আর বেসরকারি জরিপে একজন মানুষ লিখতে ও পড়তে পারে কি না, তা যাচাই করা হয়। ফলে সরকারি-বেসরকারি তথ্যে বড় ফারাক থেকে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, সাক্ষরতা হচ্ছে পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে এবং লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা, যোগাযোগ স্থাপন করা এবং গণনা করার দক্ষতা। অর্থাৎ সাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝানো হয়। সাক্ষরতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি বাংলাদেশের পঞ্চম শ্রেণি পাস করা শিক্ষার্থীর সমমানের হতে হবে বলে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

গণসাক্ষরতা অভিযানের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাক্ষরতার ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হলেও তা ধীরগতিসম্পন্ন, বছরে মাত্র ০.৭ শতাংশ। অগ্রগতির হার পঠন ও লিখন দক্ষতার ক্ষেত্রে তুলনামূলক ভালো হলেও গাণিতিক দক্ষতা এবং দক্ষতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা খুবই কম। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে অগ্রগতি যদি এই হারে চলতে থাকে, তাহলে সাক্ষরতা দক্ষতার প্রাথমিক স্তরে পৌঁছতেই বাংলাদেশের সব নাগরিকের আরো ৪৪ বছর এবং অগ্রসর পর্যায়ে উন্নীত হতে ৭৮ বছর লাগবে।

অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায় সাক্ষরতার হার প্রায় ৯২ শতাংশ। ভারতেও কেরালাসহ কিছু রাজ্যে সাক্ষরতার হার ৯০ শতাংশের ওপরে। তবে তাদের গড় হার প্রায় ৭৪ শতাংশ। নেপাল, ভুটানসহ আশপাশের দেশে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭০ শতাংশ।

গত এক বছরে সাক্ষরতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে না বাড়লেও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোতে একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে এ ব্যাপারে কাজ করছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁদের পরিকল্পনা আর দক্ষতার অভাবে সাক্ষরতা বাড়ানোর একমাত্র প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশের ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী প্রায় সাড়ে তিন কোটি নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করতে ২০১৪ সালে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয়েছিল মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা)। দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ছয় বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে চরম হতাশ সংসদীয় কমিটি ও আইএমইডি (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ)। তারা এই প্রকল্পকে ব্যর্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সংসদীয় কমিটি এই প্রকল্পের মেয়াদ আর না বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন নেওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু ‘মুজিববর্ষ’ উপলক্ষে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ২১ লাখ নিরক্ষরকে সাক্ষর করতেই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাক্ষরতা প্রকল্পে পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তিরা কেন তাঁদের পেশা বাদ দিয়ে সাক্ষরজ্ঞান নিতে আসবেন? এ ছাড়া আট থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রকল্পে’ মূলত নাম লিপিবদ্ধের মাধ্যমে সাক্ষরতা বাড়ানোর কাজ চলছে।

সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত গতকালের সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২১ লাখ নিরক্ষরকে সাক্ষরতা প্রদানের কার্যক্রম চলমান আছে। পিইডিপি-৪-এর আওতায় আট থেকে ১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয়বহির্ভূত ১০ লাখ শিশুকে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসডিজি-৪ অর্জনের লক্ষ্যে নন-ফরমাল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রগাম নামে একটি কর্মসূচিভিত্তিক প্রকল্প প্রস্তাবও প্রস্তুত করা হয়েছে।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর