Exif_JPEG_420

পৌর নির্বাচন: জাতীয় নির্বাচনের মিনিপ্যাক সংস্কর । অধ্যক্ষ আসাদুল হক

যখন লিখছি তখন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে দেশ। তবে কুয়াশার হিম খুব একটা কাবু করতে পারেনি জনমানুষকে। পৌরসভা নির্বাচন যে উত্তাপ ছড়াচ্ছে, তা থেকেই উষ্ণতা খুঁজে নিচ্ছেন ভোটাররা। রাজনীতির মাঠ এখন সরগরম পৌর ভোটের লড়াইয়ে। এবার পৌর নির্বাচনে বাড়তি উত্তাপ যোগ করেছে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক। এবারই প্রথমবারের মতো পৌর নির্বাচনে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীক ব্যবহার হচ্ছে। নৌকা ও ধানের শীষ মাঠে নামা মানে, স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের ‘মিনিপ্যাক’ স্বাদ পাওয়া। ভোটাররা এই স্বাদ সব দিক বিবেচনাতেই পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এরই মধ্যে তাদের মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। বিএনপির দিক থেকেও মনোনয়ন চূড়ান্ত। বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতাও শেষ হয়েছে। পৌরসভা নির্বাচন দলীয়ভাবে হবে, এই সিদ্ধান্ত হওয়ার থেকেই বলা হচ্ছিল, সেখানে তৃণমূল নেতারা কতটা মূল্যায়িত হবেন। স্থানীয় সরকার বিশ্লেষক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা শঙ্কা প্রকাশ করে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, আর্থিকভাবে প্রভাবশালী, কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী এবং শীর্ষ নেতাদের পরিবার-পরিজনরা অগ্রাধিকার পাবেন মনোনয়ন লাভে। তৃণমূল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই নয় বছর পর দুটি দল যখন মুখোমুখি হচ্ছে, তখন দলের ভেতর থেকে অনেকেই নিজের আমলনামার ওপর ভরসা রেখে মনোনয়নের দাবিদার ছিলেন। এক পৌরসভা থেকে একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন চেয়েছেন দলের ভেতর থেকেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল বহিরাগত প্রার্থীদের ইচ্ছা বা দখলের আগ্রাসী আচরণ। তৃণমূলের শক্তি এই চাপ সইতে পারছিল না। তারা মনোনয়নের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের ওপর চাপিয়ে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। উভয় দলের ভেতরকার খবর হলো, যেহেতু নয় বছরে বিরতিতে ভোটের মাঠে নৌকা ও ধানের শীষ মুখোমুখি, সেহেতু কেন্দ্র কোনোভাবেই মনোনয়নের দায়িত্ব তৃণমূলের হাতে ছেড়ে দেওয়ার উদারতা দেখাত না। তৃণমূলের দিক থেকে সৌজন্যতাবশত কেন্দ্রের কাছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার নিয়ে আসা একটি রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। কেন্দ্রের কাছে মনোনয়নের চূড়ান্ত দায়িত্ব আসার পর বরাবরের মতোই তৃণমূল বঞ্চিত হয়েছে। তৃণমূলের সক্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের ত্যাগ করে দলগুলো নানা বিবেচনায় প্রভাবশালীদেরই মনোনয়ন দিয়েছে। ফলে দলীয়ভাবে পৌরসভা নির্বাচন হলে তৃণমূলের নেতারা মূল্যায়িত হবেন, নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে, দল গোছানো ও সংগঠিত হবে এই জাতীয় সুবচনগুলোর জলাঞ্জলি ঘটল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল থেকেই শোনা গেল বিদ্রোহী প্রার্থীদের হুঙ্কার।

আওয়ামী লীগ মনোনয়ন নিয়ে বিস্ময় ও ক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটেছে তৃণমূল থেকে যেমন তেমনি কেন্দ্রীয় নেতারাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুষ্ট হতে পারেননি। শরীয়তপুরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি রফিক কতোয়ালকে নাকি ডেকে এনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ফেনীতে এক বাসমালিক জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েই টিকিট পেয়ে গেছেন। নেত্রকোনায় জনপ্রিয় মেয়রকে বাদ দিয়ে একজন শিল্পপতিকে দেওয়া হয়েছে। রূপগঞ্জে শিল্পপতি সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজীর স্ত্রী মনোনয়ন পেয়েছেন। মানিকগঞ্জে জেলা সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন পাননি। সোনারগাঁ পৌরসভার বর্তমান মেয়র সাদেকুর রহমানের নাম তৃণমূল থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু আড়াইহাজারের সাংসদ নজরুল ইসলাম ওরফে বাবু নিজে জমা দেন তার বোন জামাই ফজলে রাব্বির নাম। বোন জামাই শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পেয়েছেন। ঈশ্বরদীতে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের মেয়ের জামাই আবুল কালাম আজাদ মনোনয়ন পেয়েছেন। নোয়াখালীর বসুরহাটে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা মনোনয়ন পেয়েছেন। ভাঙা-ফরিদপুর আসনের সাংসদ মকবুল হোসেনের ছেলে মনোনয়ন পেয়েছেন।

মনোনয়ন সন্তুষ্ট করতে পারেনি বিএনপির নেতা-কর্মীদেরও। অসন্তুষ্টির যৌক্তিকতাও মেলে। মাদারীপুরের শিবিচর পৌরসভায় বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন জাহাঙ্গীর কামাল। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার খুলনা সফরের পথে কাওড়াকান্দি ফেরিঘাটে গাড়িবহরে হামলার অভিযোগে যে মামলা করা হয়েছিল সেই মামলার সে ১৫ নম্বর আসামি। অন্যান্য পৌরসভার বেলাতেও তৃণমূলের সুপারিশ ও দাবি বিবেচনায় আনা হয়েছে কম। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মনোনয়ন বিশৃঙ্খলার সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন- দল এখন যে পর্যায়ে আছে, তাতে মনোনয়ন বোর্ড গঠন করার সুযোগ পাওয়া যায়নি। দলের নেতা-কর্মীরা একপ্রকার ছত্রভঙ্গ অবস্থায় রয়েছেন। কে নির্বাচন করবেন আর কে করবেন না এ নিয়েও তৃণমূলে বিভক্তি আছে। সেই থেকে তৃণমূলের পাঠানো প্রস্তাব ছিল ত্রুটিযুক্ত। তাই কেন্দ্রীয়ভাবে সেই ত্রুটি সারানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আবার সব নেতা আবার মনোনয়ন দেওয়ার গুরুভার নিতে চাননি। অনেকেই নিরাপদ দূরত্বে থেকে গেছেন। ফলে মনোনয়নের যোগ্য দাবিদার কেউ কেউ বঞ্চিত থেকে যাবেন। এই বঞ্চিতরা যে বসে থাকবেন, তা নয়। তারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে নেমে পড়েছেন।

যেখানে লড়াই হওয়ার কথা ছিল নৌকা ও ধানের শীষের। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীরা অনেক পৌরসভাতেই ভিন্ন মেরুকরণ তৈরি করবে। নৌকা প্রতীকের সঙ্গে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীর লড়াই তীব্র হয়ে উঠতে পারে। এর সুযোগ ধানের শীষ বা তার বিদ্রোহী প্রার্থী নেবেন। আবার ধানের শীষেরও নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মূল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে। কোথাও দুই পক্ষের বিদ্রোহী মূল প্রার্থীদের টেক্কা দিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনের সারিতে চলে আসতে পারেন। ভোট ও ভোটকেন্দ্র দখলের লড়াই, ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার বেলাতেও নৌকা যতটা না ধানের শীষ নিয়ে এবং ধানের শীষ নৌকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবে, তার বেশি তাদের নজর থাকবে নিজেদের বিদ্রোহী প্রার্থীদের দিকে। মেয়র প্রার্থীদের এই লড়াইয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতোই আড়ালে পড়ে যাচ্ছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। মনে রাখতে হবে, কোথাও কোথাও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যেও তীব্র লড়াই দেখতে পাওয়া যাবে। পৌর প্রশাসনে তারা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, সে কথাটিও রাখতে হবে বিবেচনায়। সব মিলিয়ে পৌর ভোটের মাঠ এ মুহূর্তে যতটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে তা থেকে পূর্বাভাস দেওয়াই যায়, পৌর নির্বাচন মাঠে গড়িয়েছে ভোটারদের জাতীয় নির্বাচনের ‘মিনিপ্যাক’ স্বাদ দিতে। লেখক: হাওরবার্তা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর