সব উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে রাখুন তরুণদের

হাওর বার্তা ডেস্কঃ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন এবং উন্নত দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশের দরকার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি। তা সম্ভব হবে দক্ষ তরুণ জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে। এ জন্য তরুণদের রাখতে হবে সব উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আগামী বাজেট হতে হবে তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে। তরুণ উদ্যোক্তাদের সহজে ব্যবসা করার জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় নীতি উদ্যোগ থাকতে হবে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে শনিবার সমকাল ও জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই) বাংলাদেশ আয়োজিত ‘তারুণ্যের বাজেট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এমন মতামত দিয়েছেন। রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে এ আলোচনায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। ধন্যবাদ জানান জেসিআই বাংলাদেশের জাতীয় সভাপতি ইরফান ইসলাম।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে তরুণই বেশি। এ কাঠামোর সুবিধা নিতে তরুণদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। তরুণরা যারা উদ্যোক্তা হিসেবে আসতে চাইছেন, তাদের সহজে ব্যবসা শুরু করার সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য বাজেটে উদ্যোগ থাকা দরকার।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সহজে ব্যবসা করার সূচকে পিছিয়ে থাকার কারণে বাংলাদেশের বদনাম রয়েছে। এ সূচকে লক্ষণীয় উন্নতির জন্য বন্দরের সেবা, আইন-কানুনের জটিলতা এবং সুশাসনের মতো অনেক বিষয় রয়েছে, যেখানে ব্যাপক সংস্কার দরকার। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার জন্য সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণদের অনেক কিছু করার আছে। কারণ, তরুণরা অনেক গতিশীল। সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই অনেক বিষয় নজরদারি করছেন। তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর অনেক সুবিধা থাকবে না বলে আলোচনা হচ্ছে। অনেকে ভয়ও পাচ্ছেন। তবে যখন যে কাজ করার কথা, তখন সেটা করলে ভয়ের কিছু নেই। উন্নত দেশ হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই।

আলোচনায় বিশেষ অতিথি উইমেন চেম্বারের সভাপতি সেলিমা আহমাদ এমপি বলেন, বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। এখানে মানব সম্পদের উন্নয়ন ছাড়া উপায় নেই। তরুণদের এগিয়ে নিতে সব ক্ষেত্রে শিক্ষার মান সমান হতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য চামড়া, আইসিটি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণদের দক্ষতা বাড়াতে কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ দরকার। তিনি বাজেটে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ৫০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেন।

বিশেষ অতিথি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা মোজাফফর হোসেন বলেন, ওভেন গার্মেন্টের প্রয়োজনীয় কাপড়ের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। এ খাতে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এতদিন গ্যাস ও জমির সমস্যা ছিল। সরকার তার সমাধান করলেও এখন সমস্যা ব্যাংক ঋণের সুদহার। সুদহার কম হলে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়বে।

আরেক বিশেষ অতিথি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ বলেন, বর্তমান সরকার মনে করে, তারুণ্যের শক্তিই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি। তবে কর্মসংস্থানের অভাব তরুণদের জন্য বড় সমস্যা। সরকার চলতি মেয়াদে দেড় কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েছে। শিল্প স্থাপনে ইকোনমিক জোন করা হচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা নীতিমালা করা হচ্ছে। তরুণদের দক্ষতা বাড়াতে সরকার দুটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

বিজিএমইএ পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, দেশের সামনে ২০২১ সালের লক্ষ্য অর্জন, এসডিজি অর্জন এবং উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার মতো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তরুণরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তরুণদের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সহজ ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কর অব্যাহতি, সহজে ব্যবসা করা, সুদহার কমানো, ভেনচার ক্যাপিটাল গঠন ও করপোরেট কর কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কর্মসংস্থান সৃষ্টি। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারলেই কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ অনেকদিন ধরেই এক জায়গায় আটকে আছে। বিনিয়োগ বাড়াতে সহজে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার ভর্তুকি দিয়ে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে, যা বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি বিদেশে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ করার সুযোগ উন্মুক্ত করার দাবি জানান।

আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান বলেন, তরুণরাই ভবিষ্যৎ। তরুণরা চাকরি চাইলে চাকরি দিতে হবে। ব্যবসা করতে চাইলে অর্থায়ন করতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য জামানতবিহীন ঋণের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা হওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের মূলধন সহায়তা দিতে ভেনচার ক্যাপিটাল গঠন করা দরকার। তিনি বলেন, দেশে করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। অনলাইনে কর পরিশোধ ব্যবস্থা আরও সহজ করতে হবে। যারা ব্যবসা শুরু করছে তাদের জন্য পাঁচ বছরের কর অব্যাহতি সুবিধা দিতে হবে।

সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান অনুষ্ঠানে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, সার্বিক বাজেট কাঠামোর বাইরে গিয়ে তরুণদের জন্য কিছু করা সম্ভব নয়। আর বর্তমান বাজেট কাঠামোতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আহরণ। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমজীবী তরুণ রয়েছেন। সকলের জন্যই সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে তরুণদের। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত সেবা দিতে হবে। তিনি বলেন, এসএমই খাতে নতুন শিল্প হচ্ছে না, যদিও বড় শিল্প সম্প্রসারিত হচ্ছে। কর্মসংস্থানের জন্য এসএমই খাতে শিল্প স্থাপনে প্রণোদনা দিতে হবে।

বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, তরুণরা আইসিটিতে আগ্রহী। এটা মেধার ব্যবসা। এর জন্য বড় অফিস বা কলকারখানা দরকার হয় না। দরকার সুলভ মূল্যে মানসম্পন্ন ইন্টারনেট। তিনি বলেন, বর্তমানে আইসিটি উত্তরণ পর্যায়ে রয়েছে। সমস্যা দক্ষ লোকের অভাব। সরকারের পরিকল্পনায় এখানে নজর দিতে হবে।

ইস্টার্ন ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান ও. রশিদ বলেন, সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে বেশি সুদ দিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো কম সুদে আমানত পাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমছে। ফলে নতুন উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগও কমছে।

অ্যামটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৯৪ ভাগই মোবাইল ব্যবহার করেন; কিন্তু মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারে ১১ দশমিক ২ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। ইন্টারনেট কম দামে দিতে হবে।

কনফিডেন্স গ্রুপের পরিচালক ইমরান করিম বলেন, সব খাতের বিনিয়োগের বাধা হচ্ছে উচ্চ সুদহার। আর সুদহার বেশি থাকার কারণ হচ্ছে খেলাপি ঋণ। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মাঝে মধ্যে এমন নীতিমালা করে, যা ব্যাংকবান্ধব নয়। সিটি ব্যাংক এনএর হেড অব করপোরেট ব্যাংকিং শামস জামান বলেন, বাংলাদেশের যুব সমাজের সবাই উদ্যোক্তা নন। অভিবাসী শ্রমিকও রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি দরকার দক্ষতা। বেসরকারি খাতকে দক্ষতা উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে হবে।

কার্ডিয়াক সার্জন সোসাইটি বাংলাদেশের মহাসচিব আশরাফুল হক সিয়াম সরকারি হাসপাতালে অনারারি চিকিৎসকদের বিশেষ ভাতা দেওয়ার দাবি জানান। প্রাইম ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান চৌধূরী বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সুশাসন নিশ্চিত করা। সুশাসন ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশেরই উন্নয়ন টেকসই হয়নি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি বলেন, দৈনিক সমকাল সব সময়ই তারুণ্যের পক্ষে। এজন্য তারুণ্যনির্ভর বাজেট চায় সমকাল, যা হবে কর্মসংস্থান, উন্নয়ন ও ব্যবসাবান্ধব। সর্বোপরি বাজেটকে হতে হবে মানবিকও। তরুণদের অনেক দূর যেতে হবে। ইতিমধ্যে অনেক অর্জন হয়েছে, তবে তা নিয়ে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। সব খাতকে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সরকারের পরিকল্পনাও হতে হবে তেমন।

আলোচনায় আরও অংশ নেন বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ নাজমুস সাদাত, মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাভিদ হক, নগদের সিএফও আমিনুল হক এবং এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল আমিন বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া ভাইয়া গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সাখাওয়াৎ হোসেন মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিফাত ফারহাত আনোয়ার, পরামর্শক কামরুল হক, ওয়ালটনের পরিচালক সিফাত বিন আমিন, মুদ্রণ শিল্প সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান মেহেদি হাসান, জেসিআই বাংলাদেশের ন্যাশনাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাত জাহান, জেসিআই ঢাকা নর্থের প্রেসিডেন্ট মাহিরা হাবিব প্রমুখ। আয়োজন সমন্বয় করেন সমকালের বিজনেস ডেভলপমেন্ট এন্ড ইভেন্ট ইনচার্জ ইমরান কাদির।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর