বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু

সুলতানা বেগম। বাড়ি নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে। তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সামান্য কৃষি জমি আছে বাবার। কৃষিতেই চলে তাদের সংসার। অভাবের তাড়নায় বাবা-মা এবং পাড়া-প্রতিবেশীর চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয় সুলতানা। তখন ছিলেন মাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বছর না ঘুরতেই কোল জুড়ে আসে ছেলে সন্তান। কিন্তু যৌতুকের চাপ আর সাংসারিক জটিলতায় কপাল পোড়ে তার।

স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হন সুলতানা। বাবার অভাবের সংসারে এসে বাড়তি বোঝা হতে চাননি। স্থানীয় একটি এনজিও’র মাধ্যমে চেষ্টা করছেন স্বাবলম্বী হওয়ার। সংসার বুঝার আগেই তার সংসার ভেঙে গেল। স্বপ্নের জাল বোনার বয়সেই রঙিন স্বপ্ন ভেঙে-চুরে খান খান হয়ে গেল। ভয়ঙ্কর এই স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে ফিরবে সারাজীবন। এমন অনেক সুলতানারই গল্প রয়েছে এক সময়ের মঙ্গাকবলিত এলাকা হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের হারের দিক থেকে সবার উপরে রংপুর বিভাগ। দেশের সর্বোচ্চ বাল্য বিয়ের হার এই বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলায়, যেখানে ৯১ শতাংশ বিয়েই হচ্ছে বাল্য বিয়ে। তারপরই নীলফামারী জেলার নাম। এই জেলায় বাল্য বিয়ের হার ৯০ শতাংশ। মঙ্গা বিদায় হয়েছে, এখন বাল্য বিয়েও বিদায় হবে এ অঞ্চল থেকে, এমন লক্ষ্য নিয়ে তাই ইতোমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছে সরকার।

বাল্য বিয়ে বন্ধে রংপুর বিভাগে শুরু হয়েছে মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রথমে এ বছরের শুরুর দিকে সরকারিভাবে কুড়িগ্রামে এটি পাইলট প্রকল্প আকারে শুরু হয়। উদ্বোধন করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। বর্তমানে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় রংপুর বিভাগের আরো চারটি জেলাকে আনা হয়েছে এই প্রকল্পের আওতায়।

ওই অঞ্চলে এখন যে কেউ বিয়ে করতে গেলে যারা বিয়ে পড়াবেন বা বিয়ে নিবন্ধন করবেন তারা প্রথমেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাত্র-পাত্রীর বয়স যাচাই করে নেবেন। এটি বাধ্যতামূলক। কাজটি করা হচ্ছে খুব সহজ উপায়ে। সেখানে গ্রামাঞ্চলের মানুষ চাইলে নিজেও যাচাই করে নিতে পারেন নিজের বয়স ও জন্ম নিবন্ধন সনদ। তার জন্য যা করতে হয়, তা হচ্ছে মোবাইলে *১৬১০০# নাম্বারে ডায়াল করলেই সেখানে বয়স যাচাইয়ের একটি অপশন দেয়া হয়। সেখানে জন্ম নিবন্ধন সনদ, শিক্ষা সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার দিলেই চলে আসবে সঠিক বয়স। যদি জন্ম নিবন্ধনটি ভুয়া হয়, সেক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়বে ভুয়া জন্মনিবন্ধন ব্যবহারকারী।

নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল হক প্রধান বলেন, ২০১৫ সালে জলঢাকাকে বাল্য বিয়ে মুক্ত উপজেলা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নানা কায়দা কৌশলে এখানে বাল্য বিয়ে হচ্ছে। দায়িত্ব নেয়ার পর গত আট মাসে অন্তত ১শ’ বাল্য বিয়ে আমি বন্ধ করেছি, বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তার মতে, মোবাইলে বয়স যাচাইয়ের পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে মানুষ অনেক সতর্ক হয়ে গেছে। কারণ এখন তারা বুঝতে পারছে ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ জোগাড় করে কোনো লাভ নেই। তারপরও যে বাল্য বিয়ে হচ্ছে না তা নয়। তবে সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সাধ্যমত চেষ্টা করছি সত্যিকার অর্থেই জলঢাকাকে বাল্য বিয়ে মুক্ত উপজেলায় পরিণত করার।

এ বিষয়ে রংপুর জেলা কাজী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদেরকে বিয়ে নিবন্ধনের জন্য ডাকা হয় সব আয়োজনের একেবারে শেষ মুহূর্তে। তখন জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। মোবাইলে এই বয়স যাচাই পদ্ধতি চালু হওয়ার ফলে আমরা অনেক বিড়ম্বনা থেকে বেঁচে গেছি। কারণ এখন আমরা মোবাইলে বয়স যাচাই করে যদি দেখি পাত্রীর বয়স ১৮ বা পাত্রের বয়স ২১ এর নিচে, তখন সোজা বলে দেই এই বিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তখন দুই পক্ষই বুঝতে পারেন, আসলে কিছু করার নেই। সর্বশেষ ১০টি বিয়ে নিবন্ধনেন মধ্যে দু’টি বিয়ে এই কারণে বন্ধ হয়েছে বলেও জানান কাজী। সামাজিকভাবে হেয় না হওয়া এবং পাত্র-পাত্রীদের কলংকের কালিমা যেন না লাগে সেজন্য আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করবো শেষ মুহূর্তে নয়, বিয়ের আলোচনা শুরু হওয়ার সময়ই বয়স যাচাই করে নিন। তাহলে কাউকেই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।

প্রকল্পের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ১৫ মার্চ ২০১৭ থেকে ১৫ মে ২০১৭ পর্যন্ত এই দুই মাসে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ৫৩ হাজার ৫শ’ মানুষের বয়স যাচাই করা হয়েছে মোবাইল সার্ভিসের মাধ্যমে। যার মধ্যে রয়েছে রংপুর জেলার ২৫,১৭৬ এবং নীলফামারীর ১৮,৮৭৩ জন। তিন জেলার ১৪ উপজেলা থেকে এই বয়স যাচাই করা হয় এবং অনলাইনে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয় ২০৭টি।

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা প্লান ইন্টারন্যাশনালের বিভাগীয় ম্যানেজার আব্দুল কুদ্দুস জানান, সরকারের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট থেকে নেয়া বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে এই প্রযুক্তি ব্যবহার প্রকল্পে পার্টনার হিসেবে কাজ করছেন তারা। এখনকার সময়ে জন্মনিবন্ধন সনদ জোগাড় করা খুব সহজ এবং এর যত্রতত্র ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করে থাকি। কিন্তু মোবাইলে বয়স যাচাইয়ের ফলে সেই দিন ফুরিয়ে গেছে। এখন আর ভুল তথ্য দিয়ে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যখনই বিয়ের জন্য বয়স যাচাই হচ্ছে, সেই তথ্য সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে মেসেজ আকারে চলে যাচ্ছে যারা বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত তাদের কাছে। কাজেই সবাই সাবধান হয়ে যাচ্ছেন। আমরা ইতোমধ্যেই রংপুর বিভাগের চার জেলায় প্রায় ৯ হাজার ঘটক, ইমাম/পুরোহিত এবং কাজীকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এর সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি ইতোমধ্যেই।

রংপুর বিভাগের এই কার্যক্রম সারা দেশেই ছড়িয়ে দেয়া হবে জানিয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সারা দেশের প্রায় ৮৫ হাজার কাজী, ঘটক এবং ইমাম/পুরোহিত অর্থাৎ যারা বিয়ে পড়ানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের একটি তথ্য ভা-ার তৈরি করেছি। জন্মনিবন্ধন সনদগুলোও সার্ভারে চলে আসছে। কাজেই বয়স লুকিয়ে বিয়ে করা বা দেয়ার সুযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা আশা করছি, আগামী বছরেই সারা দেশে এই কার্যক্রম আমরা ছড়িয়ে দিতে পারবো। এজন্য এই বাজেটে অর্থ বরাদ্দও চেয়েছি আমরা। প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার- ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছর বয়সের নিচে বাল্য বিয়েকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা ও ১৫-১৮ বছরের মধ্যে বিয়ের হার এক তৃতীয়াংশ কমানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে বাল্য বিয়ে মুক্ত করা। এই অঙ্গীকার অবশ্যই বাস্তবায়ন হবে এবং সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। – বাসস।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর