প্রত্যাশার চাপে পিষ্ট শিশুরা

কোমলমতি শিশু-কিশোর। কারো হয়তো সময় কাটার কথা ছিল দাদা-দাদি-নানা-নানুদের কোলে। কারো বা পড়াশোনার পাশাপাশি ছুটার কথা ছিল খেলার মাঠে। কিন্তু এই সময়ে এসে শিশু-কিশোররা প্রতিযোগিতার চাপে পিষ্ট হচ্ছে। স্কুল, হোমওয়ার্ক, ক্লাস টেস্ট, মডেল টেস্ট, প্রথম, দ্বিতীয় সাময়িক, বার্ষিক পরীক্ষা, প্রথম হওয়া, জিপিএ ফাইভ। চাওয়া-পাওয়ার কোনো শেষ নেই। শেষ নেই চাপেরও। প্রায় প্রতিটা মুহূর্তই ব্যস্ত শিশুরা।
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ইমতিয়াজ মাহমুদ ফারদিন প্রায় প্রতিদিন রাতেই ঘুমানোর আগে মাকে বলে বাসায় স্যারকে বলে দেয়ার জন্য যেন আরো কম পড়া দেয়। প্রতিদিন স্কুলের পড়া শেষ করতেই হাঁপিয়ে পড়ে ফারদিন। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করতে হবে এরকম কথা থাকলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্রুত সিলেবাস শেষ করার জন্য প্রতিদিনই অনেক হোমওয়ার্ক দেয়া হয় স্কুল থেকে। ফারদিনের মা নাসরিন সুলতানা বলেন, বুঝতে পারছি ওর কষ্ট হচ্ছে। তবে এ বছর যদি কষ্ট না করে তাহলে জিপিএ ফাইভ পাবে না। পরে অন্য বন্ধুদের ভালো রেজাল্ট দেখে ওর মন ভেঙে যাবে। এছাড়া, সব বাবা-মাই তো চায় তাদের সন্তান ভালো রেজাল্ট করুক। ফারদিনের দিন শুরু হয় সকাল ৭টা থেকে আর শেষ রাত সাড়ে ১১টায়। খেলার জন্য কোনো সময় বরাদ্দ নেই। তবে খাওয়ার সময় কিছুক্ষণ কার্টুন দেখে ফারদিন। সপ্তাহে শুক্রবার ছুটি পেলেও প্রতি শনিবার টিউটোরিয়াল পরীক্ষা এবং কোচিং থাকায় সেদিনও পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়।
শিক্ষা যদি আনন্দের না হয় তবে তা কোনো শিক্ষাই নয়। শিশুরা গল্প মনে রাখে ঠিকই, কিন্তু পাঠ্যবইয়ের পড়া বারবার পড়েও মনে রাখতে পারে না। দেশে শিক্ষাকে এতটা কঠিন করা হয়েছে যে, শিশুরা হাঁপিয়ে উঠছে। জোর করে লেখাপড়া চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তাদের ওপর। কথাগুলো বলছিলেন সেলবেশন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর মা শাহজাদি বেগম। তিনি বলেন, বাচ্চাদের ওপর চাপ না দিয়ে আমাদেরও কোনো পথ নেই। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকে থাকতে হলে চাপ দিতেই হবে। এছাড়া ভালো রেজাল্ট না করলে তো ভবিষ্যতে ওদেরই সমস্যায় পড়তে হবে। জিপিএ ফাইভ না থাকলে তো অনেক প্রতিষ্ঠানেই ভর্তির জন্য আবেদন করা যায় না।
ছোট্ট শিশু ধরিত্রী দিয়াড়ী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। ধরিত্রী জানায়, পড়ালেখার পাশাপাশি গান, নাচ, ছবি আঁকা, আবৃত্তি সবই শিখছে সে। কারণ বাবাই বলেছেন, সব কিছুতে প্রথম হতে হবে। তাহলেই সবাই ভালোবাসবে। রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া শৈলি বলে, এখন অনেক পড়ার চাপ। কোচিংয়ে যেতে হয়, বাসায় স্যারের পড়া আর পরীক্ষা তো আছেই। মা বলেছেন এবার আমাকে এ+ পেতেই হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সকালে কোচিং, কোচিং থেকে স্কুল, স্কুল থেকে আবার কোচিং। বাসায় এসে ফের পড়ার টেবিল। ঢাকায় শিশুদের রুটিন মোটামুটি এমনই। খেলার মাঠ অপর্যাপ্ত, উঠোন কী জিনিস তা হয়তো চেনেই না। অ্যাপার্টমেন্টের খাঁচাবন্দি জীবনে অতিরিক্ত লেখাপড়ার চাপ শিশুদের আরো দুর্বল করছে, অসহিষ্ণু করে তুলছে, মেজাজ করছে খিটমিটে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. মেখলা সরকার বলেন, ছোট বয়সেই শিশুদের উপর বেশি চাপ দেয়ায় তাদের ভবিষ্যতে চাপ মোকাবিলার ক্ষমতা কমে যায়। বাবা-মা শিশুদের ব্যর্থতা মেনে নিতে না পারায় ভবিষ্যতে দেখা যায় শিশুরা অল্পতেই হার মেনে যায়। অতিরিক্ত পড়ালেখার কারণে সামাজিক মেলামেশা কমে যাচ্ছে। যে কারণে সামাজিক স্কিলগুলো শিশুরা পায় না। মেখলা সরকার বলেন, শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকায় শিশুদের জীবনে আনন্দ নেই। চাপের কারণে এক সময় তাদের মধ্যে একঘেঁয়েমি চলে আসে। তখন অন্যকোনো নেগেটিভ কিংবা রোমাঞ্চকর বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। যেটা অনেক সময় শিশুদের জন্য ভালো নাও হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, সব বাবা-মা চায় সন্তান প্রতিষ্ঠিত হোক। সন্তানরা বাবা-মায়ের পুঁজি। তবে প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বেশি হয় নিম্ন মধ্য এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকদের মধ্যে। এই দুই শ্রেণির অভিভাবকরা সবসময় চায় তাদের সন্তান অন্য সবার চেয়ে ভালো করুক। তাই শুরু থেকেই একটা চাপের মধ্যেই থাকে শিশুরা। যেটা অনেক শিশু মেনে নিতে পারে আবার অনেকে খেই হারিয়ে ফেলে। তবে আমি বলবো সব বয়সে শিশুদের উপর চাপ না দিয়ে একটা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে যেন বিকাশটা গড়ে তোলা যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে। তবে দুঃখের বিষয় হলো অধিকাংশ মা-বাবাই তাদের শিশুকে নৈতিক শিক্ষা দিতে পারছে না। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন সবাই। কেউ বলে না তাদের শিশুর মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হোক। সবাই শুধু প্রতিষ্ঠিত হোক- এটাই চায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর