পদোন্নতিতে আইন মানছে না বিআরডিবি

আদালতের নির্দেশ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জেষ্ঠ্যতার নীতি লঙ্ঘন করে পদোন্নতি ও কর্মকর্তাদের জেষ্ঠ্যতার তালিকা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড-বিআরডিবি কর্তৃপক্ষ। এই তালিকা ধরেই পদোন্নতি দেয়ার সব পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছে তারা। এতে বঞ্চিত হচ্ছে বিআরডিবি কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ।

সূত্র জানায়, অবৈধভাবে পদোন্নতি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা যেন প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সালেও অবৈধভাবে কোনো রূপ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়মিতকরণ না করে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের ফিডার পদে কোনো অনুমোদিত জ্যেষ্ঠতার তালিকা ছাড়াই শর্তসাপেক্ষে পদোন্নতি দেয়া হয়।

২০১২ সালের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক রায়ে দেখা যায়, ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিআরডিবির ১৪২ জন সহকারী পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তাকে অবৈধভাবে ও কোনো রূপ নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা/সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ওই কর্মকর্তারা রহস্যজনকভাবে একদিনের মধ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কিভাবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে যোগদান করলেন তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।

এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ’২৮ ডিসেম্বর পদোন্নতির আদেশ জারি হয়। একই দিনে ওই কর্মকর্তারা কীভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে যোগদান করলেন। কীভাবে তারা এই আদেশ পেলেন বা দায়িত্ব হস্তান্তর করলেন। যেখানে ঢাকা থেকে এক জায়গায় যেতেই এক থেকে দুইদিন সময় লাগে। পুরো বিষয়টি রহস্যাবৃত্ত।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিআরডিবির প্রবিধান মালার ১৪ (১) অনুযায়ী কোন পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মচারীর জেষ্ঠ্যতা সেই পদে যোগদানের তারিখ থেকে হিসাব করা হয়। পদোন্নতপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ২০১২ সালের জানুয়ারিতে যোগদান করেও কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে কাগজে কলমে যোগদানের তারিখ দেখানো হয়েছে ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১। অর্থাৎ ২০১১ সালে জুলাইতে সরাসরি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের বঞ্চিত করাই ছিল বিআরডিবি কর্তৃপক্ষের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা।’

অবৈধভাবে ১৪২ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি দেয়ার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা ২০১২ সালের জানুয়ারিতে বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনলে আদালত পদোন্নতির আবেদন বাতিল করে দেয়।

আদেশে বলা হয়, অসৎ উদ্দেশ্যে বিআরডিবি ১৪২ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। ফিডার পদের জেষ্ঠ্যতাসংক্রান্ত রিট নিষ্পত্তি না করেই আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে বলেও রায়ে উল্লেখ করা হয়।

২০১২ সালের ১৯ জুন রায় প্রকাশিত হয়্। তাদের পদোন্নতির আদেশ বাতিল রায় বহাল থাকা অবস্থায়ই বিআরডিবি কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ফিডার পদে জেষ্ঠ্যতার তালিকা না করে সরাসরি প্রথম শ্রেণির পদের খসড়া জৈষ্ঠ্যতার তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেটি আদালতের রায় অবমাননার শামিল বলে মনে করছেন পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা।

প্রথম শ্রেণির পদের খসড়া জেষ্ঠ্যতার তালিকার বিষয়ে বিআরডিবির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের আপত্তি থাকায় তারা কর্তৃপক্ষ বরাবর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লিখিত অভিযোগ/ আপত্তি দাখিল করে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এসআরও নং ১০৮ এর বিধি ৯ উপবিধি ২ ও ৩ অমান্য করে অভিযোগ/আপত্তি আমলে না নিয়ে ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর বিআরডিবির ৮৩০৯ নং স্মারকে চূড়ান্ত জেষ্ঠ্যতার তালিকা প্রনয়ণ করে। এই তালিকা কোনো মাধ্যমে প্রকাশ না করে অত্যন্ত গোপনীয় রাখা হয়। অথচ আইনে এই তালিকার প্রকাশের বাধ্যবাধতা রয়েছে।

যে তারিখে জেষ্ঠ্যতার চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করা হয় সেই তারিখে হাইকোর্ট বিভাগের বর্ণিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির আদেশ বাতিলের রায় বলবৎ ছিল।

এছাড়া বঞ্চিত কর্মকর্তারা জানান, ‘চূড়ান্ত জেষ্ঠ্যতার তালিকায় তাদেরকে বঞ্চিত করার আশঙ্কা থাকায় তারা হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। ২০১৫ সালে দায়ের করা পিটিশন নম্বর ১০৭৬৬।

রিট পিটিশন শুনানিতে আদালত বলেন, ‘জেষ্ঠ্যতা বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অভিযোগ/ আপত্তির বিষয় শুনানি না করে এবং রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত জেষ্ঠ্যতার তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ করা যাবে না।’ এই রিট পিটিশনের নির্দেশনাও অমান্য করা হয়েছে জেষ্ঠ্যতার চূড়ান্ত তালিকায় প্রণয়নে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, রিট পিটিশনের আদেশের তারিখের পরে তারা প্রথম শ্রেণির চূড়ান্ত জেষ্ঠ্যতার তালিকা প্রণয়ন করলেও তারিখ দেখানো হয়েছে আদেশের সাত দিন আগের।

বিআরডিবির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, অনিয়ম করে প্রণয়নকৃত চূড়ান্ত জেষ্ঠ্যতার তালিকা অনুযায়ী খুব শিগগিরই উপপ্রকল্প পরিচালক ও উপপরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। এলক্ষ্যে অনেক দূর এগিয়েছে প্রশাসন। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে এই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হতে পারে।

তবে এটি বাস্তবায়ন হলে ২০১১ সালে সরাসরি প্রথম শ্রেণি পদে নিয়োগ পাওয়া ৭৯ জন কর্মকর্তা চাকরিজীবনে চরম বৈষম্যের শিকার হবেন। শুধু তাই নয়, একই পদে তাদেরকে ১৫- ২০ বছর চাকরি করতে হবে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরডিবির মহাপরিচালক আব্দুল কাইয়ূম বলেন, ‘আমি আদালতের রায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ পদোন্নতিতে আইন মানা হচ্ছে না বলে যে অভিযোগ ওঠেছে তাও অস্বীকার করেন তিনি।

এবিষয়ে জানতে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব প্রশান্ত কুমার রায়ের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এরপর তাকে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর