হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশের ২৯টি প্রধান নদ–নদীর দূষণমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এগুলোর পানির দূষণ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। মৎস্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ দেশের মাছের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৯টি নদী নিয়ে আরেকটি সমীক্ষা করেছে। তাতে দেখা গেছে, মাছের এসব উৎস মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এসব নদীর পানিতে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মাত্রার ভারী ধাতু পাওয়া যাচ্ছে।
আজ বিশ্ব পানি দিবস। এবারের দিবসের প্রধান প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য পানির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে’। দেশের নদীর পানি ধারাবাহিকভাবে দূষণের কিছু অভিন্ন কারণ ওই দুই সমীক্ষায় উঠে এসেছে। মূলত নদীগুলোর তীরে গড়ে ওঠা বেশির ভাগ শিল্পকারখানা তাদের বর্জ্য পরিশোধন না করে নদী ফেলছে। কারখানাগুলোতে বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র থাকলেও তার বেশির ভাগই চালানো হচ্ছে না। কৃষিকাজে ব্যবহৃত হওয়া মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশকও সেচের পানির সঙ্গে ধুয়ে নদীতে পড়ছে। হাটবাজার, শহর ও বস্তি এলাকার গৃহস্থ বর্জ্য ফেলার সবচেয়ে বড় ভাগাড়ও এই নদী।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষাটি করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। সারা দেশে প্রধান নদ–নদীগুলোর পানির মান পরীক্ষার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ১৩২টি পর্যবেক্ষণকেন্দ্র আছে। গত দুই বছরে সমীক্ষায় এসব কেন্দ্রসহ আর কোথায় কোথায় দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে, তা দেখা হয়। একই সঙ্গে ভূ-উপগ্রহের ছবি ও মাঠ জরিপের মাধ্যমে নতুন দূষণ এলাকাও চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ২৯টি প্রধান নদ–নদীর পানির দূষণ বিপজ্জনক স্তরে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মহসীন চৌধুরী সাংবাদিককে বলেন, ‘এত দিন আমরা দেশের পানি, মাটি ও বায়ুদূষণ রোধে আলাদা প্রকল্প ও উদ্যোগ নিতাম। কিন্তু পরিবেশের এই সব কটি উপাদানের দূষণ পরস্পর সম্পর্কিত। যেমন মাটি দূষিত হলে তা নদীকেও দূষিত করে। বায়ু সবকিছুকেই দূষিত করে। তাই সামগ্রিকভাবে পরিবেশদূষণ রোধে একটি বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোতে সাড়ে ৪ হাজার টন বর্জ্য ও ৫৭ লাখ গ্যালন দূষিত পানি গিয়ে পড়ছে। এ ছাড়া রাজধানীর বাইরে আশুলিয়া, সাভার, নতুন চামড়াশিল্প নগরী, টঙ্গী এলাকায় শিল্পকারখানা বাড়ছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর তীরে, পদ্মায় মাওয়া ঘাটের পাশে, মেঘনার তীরে দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে। এসব কারখানার বেশির ভাগই বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র ব্যবহার করছে না বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
গত বছরের অক্টোবরে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ ৯টি নদীর ১১টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে। রাজধানীর চারপাশের পাঁচটি নদী অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার পানি এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে যে সেখানকার বেশির ভাগ স্থানে মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। পদ্মার শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের পাশে ইছামতী নদীতেও প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর অ্যামোনিয়ার পরিমাণ মানমাত্রার চেয়ে বেশি। তা ছাড়া এসব নদীতে ক্রোমিয়াম, আয়রন ও জিংকের মতো ভারী ধাতু মানমাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে মানমাত্রা প্রতি লিটারে দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম। অথচ এসব নদীতে পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে দশমিক ৮ থেকে ৮ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিককে বলেন, ‘নদী–জলাশয় রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু আমরা দেখছি, আমাদের নদীগুলো দূষণের পর্যায় থেকে এখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর নদী মরে যাওয়া মানে মানুষের খাওয়ার পানি, মাছ ও জলজ প্রাণীর বাসস্থান হারিয়ে যাওয়া। তাই অন্তত নদী রক্ষায় সরকার তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ।’