জাহান্নাম ও জাহান্নামীর পরিচয়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এসব কাজ করলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনে নিক্ষিপ্ত করবেন। চিরসুখ ও শান্তির নিবাস জান্নাত থেকে আমরা হব বঞ্চিত। কাজগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। একটু সচেতন ও সাবধান হলেই এগুলো থেকে সহজে বাঁচতে পারি, সযতে পরিহার করতে পারি। মুক্তি পেতে পারি জাহান্নামের লেলিহান আগুন থেকে। একই সঙ্গে অর্জন করতে পারি কাক্সিক্ষত ও চিরপ্রত্যাশিত সুখনিবাস জান্নাত

প্রতিটি মানুষেরই প্রকৃত সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ধারিত হবে আখেরাতে। ভালো ও মন্দে মিশ্রিত ইহকালীন সফর শেষে আল্লাহ তায়ালা মানুষের চিরস্থায়ী ফয়সালা করবেন পরকালে। মহান আল্লাহ তায়ালার ইনসাফপূর্ণ নিক্তিতে যাপিতজীবনের আমলনামা আল্লাহর আনুগত্যে ভরপুর হলে জান্নাত লাভ হবে। আর আমলনামা মন্দ ও নাফরমানিযুক্ত হলে ঠিকানা হবে জাহান্নাম। কিন্তু বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, কেমন কাজ করলে আখেরাতের জীবনে চিরসফলতা লাভ করা যাবে এবং কিরূপ কর্ম করলে মহাদুর্ভোগ ও ভয়াবহ শাস্তি গ্রাস করবে, সে কথা আল্লাহ তায়ালা কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন।

এমন নয় যে, তিনি শুধু মানব সম্প্রদায়কে উন্তের মতো ছেড়ে দিয়েছেন, বরং বিষয় উল্লেখপূর্বক এবং খুলে খুলে আনুগত্যের কর্ম পরিসর ও নাফরমানির তালিকা বর্ণনা করে দিয়েছেন। মানবজাতির দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, সেসব আদেশ ও নিষেধ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করে সফলতার ফসল ঘরে তোলা। আল্লাহ তায়ালার হুকুমের অবাধ্যতা ও গোনাহের পাল্লা ভারি হলে মানুষের নিশ্চিত আবাস হবে জাহান্নাম। জাহান্নাম বড় ভয়ানক ও ভয়াবহ শাস্তির ঠিকানা, মর্মন্তুদ ও কুৎসিত আবাস, ভীতিপ্রদ জ্বলন্ত অগ্নিশিখার নাম। যেখানে শুধু শাস্তি আর শাস্তি। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের অসংখ্য স্থানে জাহান্নামের পরিচয় ব্যক্ত করেছেন। শাস্তির চিত্র বর্ণনা করে মানুষকে স্মরণ করে দিয়েছেন জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকার কথা।

কোরআনে জাহান্নামের বর্ণনা
আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আমার আয়াতগুলো অস্বীকার করেছে, আমি তাদের জাহান্নামে ঢোকাব। যখনই তাদের চামড়া জ্বলে সিদ্ধ হয়ে যাবে, তখন আমি তাদের তার পরিবর্তে অন্য চামড়া দিয়ে দেব, যাতে তারা শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাক্ষমতাবান, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা নিসা : ৫৬)। ‘এরা (মোমিন ও কাফের) দুটি পক্ষ। যারা নিজ প্রতিপালক সম্পর্কে বিবাদ করেছে। সুতরাং (এর মীমাংসা হবে এভাবে) যারা কুফর অবলম্বন করেছে তাদের জন্য তৈরি করা হবে আগুনের পোশাক, তাদের মাথার ওপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি। যা দ্বারা তাদের উদরস্থ সবকিছু এবং চামড়া গলিয়ে দেওয়া হবে।’ (সূরা হজ : ১৯-২০)।

‘তার সামনে রয়েছে জাহান্নাম এবং (সেখানে) তাকে পান করানো হবে গলিত পুঁজ। সে তা ঢোক গিলে গিলে পান করবে, মনে হবে যেন সে তা গলা থেকে নামাতে পারছে না। মৃত্যু তার দিকে চারদিক থেকে এসে পড়বে, কিন্তু সে মরবে না এবং তার সামনে (সর্বদা) থাকবে এক কঠিন শাস্তি।’ (সূরা ইবরাহিম : ১৬-১৭)। ‘আমি জালেমদের জন্য আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি। আগুনের প্রাচীর তাদের বেষ্টন করে রাখবে। তারা পানি চাইলে তাদের তেলের তলানিসদৃশ পানীয় দেওয়া হবে, যা তাদের চেহারা ঝলসে দেবে। কতই না মন্দ সে পানীয় এবং কতই না নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল।’ (সূরা কাহাফ : ২৯)।

হাদিসে জাহান্নামের বর্ণনা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জাহান্নামে কিছু লোকের টাখনু পর্যন্ত আগুনে জ্বালিয়ে দেবে। কিছু লোকের কোমর পর্যন্ত পুড়িয়ে দেবে এবং কিছু লোকের গর্দান (গলা) পর্যন্ত লেলিহান আগুনে পুড়িয়ে দেবে।’ (মুসলিম : ২৮৪৫)। ‘উত্তপ্ত পানি কাফেরদের মাথার ওপর ঢেলে দেওয়া হবে। গরম পানি মাথা ভেদ করে পেট পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। পেটের ভেতর যা কিছু আছে সব ছিঁড়েকেটে, গলিয়ে পায়ের উপর নিয়ে ফেলবে। এ শাস্তির পর কাফেরদের আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে।’ (শরহুস সুন্নাহ)। ‘জাহান্নামের সবচেয়ে হালকা শাস্তিযোগ্য ব্যক্তির শাস্তি হলো, তাকে আগুনের জুতা পরিধান করিয়ে দেওয়া হবে। আগুনের তাপে তার মস্তিষ্ক টগবগ করে ফুটতে থাকবে।’ (মুসলিম : ৫১৩)।

যেসব কাজ জাহান্নামে নিয়ে যাবে
কোরআন ও হাদিসের আলোকে জাহান্নামের পরিচয় লাভের পর এসব কাজ করলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনে নিক্ষিপ্ত করবেন। চিরসুখ ও শান্তির নিবাস জান্নাত থেকে আমরা হব বঞ্চিত। কাজগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। একটু সচেতন ও সাবধান হলেই এগুলো থেকে সহজে বাঁচতে পারি, সযতে পরিহার করতে পারি। মুক্তি পেতে পারি জাহান্নামের লেলিহান আগুন থেকে। একই সঙ্গে অর্জন করতে পারি কাক্সিক্ষত ও চিরপ্রত্যাশিত সুখনিবাস জান্নাত।

বাবা-মায়ের নাফরমানি : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তিকে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করবেন, মদপানে ডুবে থাকা ব্যক্তি, বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান ও এমন লম্পট ব্যক্তি যে তার পরিবারের লোকজনকে বেপর্দা ও নির্লজ্জতায় লিপ্ত করে।’ (নাসায়ি : ৫/৮৫)। মুখের অপব্যবহার : হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো কোন ধরনের কাজের কারণে মানুষ জাহান্নামে বেশি নিক্ষিপ্ত হবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন, মুখ ও লজ্জাস্থানের অবৈধ ব্যবহারের কারণে মানুষ বেশি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (তিরমিজি : ৪২৪৬)।

পরনিন্দা : হজরত হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম : ১০৫)। হারাম ভক্ষণ : হজরত আবু বকর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘হারাম খাদ্য দ্বারা পালিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (ইবনু হিব্বান : ৫৫৪১)। মুসলমানের অধিকার হরণ : হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কসমের মাধ্যমে কোনো মুসলমানের অধিকার কেড়ে নেয়, তার জন্য আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামের আগুনকে আবশ্যক করে রেখেছেন এবং জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন।’ (মুসলিম : ২১৮)।

পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন : সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান, দাইয়ুছ ও পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারিণী মহিলা।’ (জামিউস সগীর : ৩/৩৯৫৭)। শাসক কর্তৃক প্রজাদের ধোঁকা : হজরত মাকাল ইবনে ইয়াসার (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কে আমি বলতে শুনেছি, ‘মুসলমান প্রজাদের শাসন পরিচালনাকারী কোনো শাসক যদি প্রজাদের ধোঁকা দেওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বোখারি : ৭১৫১)।

আত্মহত্যা : হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি নিজে নিজে শ্বাসরোধে (গলায় দড়ি, বিষ ইত্যাদির মাধ্যমে) আত্মহত্যা করবে কেয়ামতের দিন সেভাবেই সে মরতে থাকবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি কোনো অস্ত্রের আঘাতে আত্মহত্যা করবে কেয়ামতের দিন সেভাবেই সে নিজেকে অস্ত্রের আঘাত করতে থাকবে।’ (বোখারি : ১৩৬৫)।

সুদ খাওয়া : হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, জিবরাইল ও মিকাইল (আ.) প্রশ্নের উত্তরে আমাকে বললেন, যে ব্যক্তি রক্তের নদীর ভেতরে সাঁতার কাটছে এবং যার মুখে বারবার পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছে, এরা ওইসব লোক যারা দুনিয়াতে সুদ খেত।’ (বোখারি : ৭০৪৭)।

অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা : হজরত আবু সাঈদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আসমান ও জমিনের সবাই যদি একজন মোমিনের হত্যার কাজে অংশগ্রহণ করে, আল্লাহ তায়ালা সবাইকে উল্টো করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (তিরমিজি : ১১২৮)।

হাদিসে বর্ণিত উপরোক্ত আদেশ ও নিষেধগুলো যথাযথভাবে মেনে চললে আমাদের পার্থিব জীবন যেমন হয়ে উঠবে আলোক উদ্ভাসিত ও প্রশান্তিতে পরিপূর্ণ। তেমনি পরকালীন চিরস্থায়ী জীবন হবে রহমত ও শান্তির উদ্যান, সালাম ও প্রশান্তির অবারিত ধারায় ভরপুর।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর