ঢাকা ০৭:৫৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেভাবে হিজরি সনের প্রচলন হলো

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:০০:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫
  • ৫৩১ বার

তারিখ শব্দটি আরবি। এর প্রচলিত অর্থ ইতিহাস, বছরের নির্দিষ্ট দিনের হিসাব। আল্লামা ইবনে মানজুর (রহ.) তাঁর বিখ্যাত আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ লিখেছেন : ‘তারিখ হলো, সময়কে নির্দিষ্ট করা, সময়ের চিত্র তুলে ধরা, সময়ের ঘটনাপ্রবাহ শব্দবদ্ধ করা।’ আল্লামা আইনি (রহ.) লিখেছেন : “সায়দাভি (রহ.) বলেছেন, ‘তারিখ’ শব্দটি ‘আরখুন’ থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ নবজাতক, সদ্যপ্রসূত শিশু। ইতিহাসের সঙ্গে এর সামঞ্জস্যতা হলো, নবজাতকের জন্মের মতো ইতিহাসও সৃজিত হয়, রচিত হয়। একের পর এক সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো ইতিহাসের ধারা চলমান, প্রবহমান।” কেউ কেউ বলেছেন, ‘তারিখ’ শব্দটি অনারবি। ‘মা’ ও ‘রোজ’ থেকে পরিবর্তন করে একে আরবিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এর অর্থ : দিন, মাস ও বছরের হিসাব।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, সংখ্যা গণনা, হিসাব সংরক্ষণের সঙ্গে ইতিহাসের সখ্য অনেক গভীর। সন-তারিখ ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনচরিত রচনা, সময়ের আলোচনা-পর্যালোচনা সন-তারিখ ছাড়া সম্ভব নয়। যদিও এটি ইতিহাস রচনার মূল উদ্দেশ্য নয়, তবুও সন-তারিখ প্রথা ইতিহাসের অনুষঙ্গ হয়ে আছে সেই আদিকাল থেকে। ফলে ইতিহাস বোঝাতে ‘তারিখ’ শব্দটিকেই ব্যবহার করা হয়।

তারিখ গণনার সূচনা যেভাবে হলো

তারিখ গণনার সূচনা কিভাবে হলো, কবে থেকে হলো, বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্নভাবে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। ‘আল মাওছুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা’ গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে এসেছে : ইসলাম আসার আগে আরবের সমষ্টিগত কোনো তারিখ ছিল না। সে সময় তারা প্রসিদ্ধ ঘটনা অবলম্বনে বছর ও মাস গণনা করত। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সন্তানরা কাবা শরিফ নির্মিত হওয়ার আগে তাঁর আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনা অবলম্বনে তারিখ নির্ধারণ করত। কাবা শরিফ নির্মাণের পর তারা বিক্ষিপ্ত হওয়া পর্যন্ত এর আলোকেই সাল গণনা করত। তারপর বনু ইসমাঈলের যারা হেজাজের তেহামা অঞ্চল থেকে বেরিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেত, তখন সেই গোত্র বেরিয়ে যাওয়ার দিন থেকে তারিখ গণনা করত। যারা তেহামাতে রয়ে যেত, তারা বনি জায়েদ গোত্রের জুহাইনা, নাহ্দ ও সাদের চলে যাওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করত। কাব বিন লুআইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত এ ধারা চলমান ছিল। পরে তাঁর মৃত্যুর দিন থেকে নতুনভাবে সাল গণনা শুরু হয়। এটা চলতে থাকে হস্তীবাহিনীর ঘটনা পর্যন্ত। হজরত ওমর (রা.) হিজরি নববর্ষের গোড়াপত্তন করার আগ পর্যন্ত আরবে ‘হস্তীবর্ষ’ই প্রচলিত ছিল। (আল-কামেল ফিত-তারিখ লি-ইবনিল আছির : ১/৯)

বনু ইসমাঈল ছাড়া আরবের অন্য গোত্রের লোকেরা নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে উপলক্ষ করে বর্ষ গণনা করত। যেমন- বাসুস, দাহেস, গাবরা, ইয়াওমু জি-কার, হরবুল ফুজ্জার ইত্যাদি ঐতিহাসিক যুদ্ধের দিন থেকে তারা নতুন নতুন বর্ষ গণনার সূত্রপাত করত। এটা তো গেল আরবদের সাল গণনার বর্ণনা। গোটা বিশ্বের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে বর্ষপঞ্জি গণনা আরম্ভ করা হয়। আদি পিতা আদম (আ.) পৃথিবীতে আগমনের দিন থেকে সাল গণনা শুরু। এ ধারা চলতে থাকে হজরত নুহ (আ.)-এর মহাপ্রলয় পর্যন্ত। এরপর মহাপ্রলয় থেকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। এটা চলতে থাকে ইব্রাহিম (আ.) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত। এ বর্ষপঞ্জি চলতে থাকে ইউসুফ (আ.) মিসরে শাসনকর্তা নিযুক্ত হওয়া পর্যন্ত। সে ঘটনা থেকে শুরু হয় নতুন বর্ষ গণনা। এটি চলতে থাকে মুসা (আ.)-এর মিসর ত্যাগের ঘটনা পর্যন্ত। সেটি চলতে থাকে দাউদ (আ.)-এর শাসনামল পর্যন্ত। সে ধারা চলতে থাকে সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্বকাল পর্যন্ত। সেটি চলতে থাকে হজরত ঈসা (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত। ঈসা (আ.)-এর জন্ম থেকে নতুন বর্ষ গণনা আরম্ভ হয়। আরবের হিম্য়ার গোত্র তাবাবিয়াহ (ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দিন) থেকে, প্রাচীন আরবের গাস্সান গোত্র বাঁধ নির্মাণের দিন থেকে সাল গণনা করে। সান’আ অধিবাসীরা হাবশিদের ইয়েমেন আক্রমণের দিন থেকে বর্ষ গণনা শুরু করে। তারপর তারা পারস্যদের জয়লাভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করে। (আল-ই’লান, লিস্ সাখাভি : ১৪৬-১৪৭)

পারসিকরা তাদের রাষ্ট্রনায়কদের চার স্তরে বিন্যস্ত করে সাল গণনা করত। রোমানরা পারসিকদের কাছে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত দারা ইবনে দারা নিহত হওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করত। কিবতিরা মিসরের রানি কিলইয়ুবাতরাকে বুখতে নছর বাদশাহ সাহায্য করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করত। ইহুদিরা বায়তুল মাকদিসে হামলা এবং এটি তাদের হাতছাড়া হওয়ার ঘটনাকে উপলক্ষ করে বর্ষ গণনা করে। খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে উত্তোলনের ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে খ্রিস্টবর্ষ পালন করে। (আল মাওছুয়াতুল ফিক্হিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা : ১০/২৮ ‘তারিখ’)

হিজরি বর্ষের সূচনা

হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসেও সবচেয়ে তাৎপর্যবহ, সুদূরপ্রসারী ঘটনা এটি। এটি দ্বীন ও মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ, বিসর্জনের এক সাহসী পদক্ষেপ। মুসলমানরা মক্কার কাফেরদের পাশবিক নির্যাতন-নিপীড়ন, অব্যাহত অমানবিক আচরণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ নীরবে সহ্য করার পর তাদের স্পর্ধা আরো বেড়ে যায়। তারা মহানবী (সা.)-কেও হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আল্লাহ তাআলা তাদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। মহানবী (সা.) ও মক্কার নির্যাতিত মুসলমানদের মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। হিজরতের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দ্বার উন্মোচিত হয়। সশস্ত্র যুদ্ধে তাগুতি শক্তির মোকাবিলার শুভ সূচনা হয়। উদিত হয় মক্কা বিজয়সহ ইসলামের বিশ্বজয়ের রঙিন সূর্য। হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) হিজরি নববর্ষের গোড়াপত্তন করেন। মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র চান্দ্রমাসের পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। কেন একটি নতুন সাল গণনাপ্রথা চালু করতে হলো- এ নিয়ে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। আল্লামা আইনির বিবরণ দেখুন : “হিজরি সাল প্রণয়নের কারণ নিয়ে মতবিরোধ আছে। ইবনে সমরকন্দি বলেন, ‘হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে চিঠি লিখেছেন যে আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে; কিন্তু তাতে তারিখ লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সাল গণনার ব্যবস্থা করুন। তারপর ওমর (রা.) হিজরি সালের গোড়াপত্তন করেন’।” আল্লামা ইবনুল আছির (রহ.) আল কামিল ফিত্ তারিখের মধ্যে এটিকে প্রসিদ্ধতম ও বিশুদ্ধতম অভিমত বলে আখ্যায়িত করেছেন। (সূত্র : প্রাগুক্ত ১/৮)

আল্লামা আইনি তারপর লিখেছেন, “আবুল ইক্জান বলেছেন : ‘হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে একটি দলিল পেশ করা হয়, যাতে কেবল শাবান মাসের কথা লেখা হয়। তিনি বলেন : এটা কোন শাবান! এ বছরের শাবান নাকি আগামী বছরের শাবান? তারপর হিজরি সন প্রবর্তন করা হয়’।” আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.) এ অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (আল ফারুক : পৃ. ১৯৫)

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত : যখন হজরত ওমর (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি পরামর্শসভার আহ্বান করেন। সভায় হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাছ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত থেকে সাল গণনার প্রস্তাব দেন। হজরত তালহা (রা.) নবুয়তের বছর থেকে সাল গণনার অভিমত ব্যক্ত করেন। হজরত আলী (রা.) হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। তারপর তাঁরা সবাই আলী (রা.)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন। এরপর কোন মাস থেকে শুরু হবে- এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) রজব থেকে শুরু করার প্রস্তাব দেন। কেননা এটি চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে প্রথমে আসে। হজরত তালহা (রা.) রমজান থেকে শুরু করার কথা বলেন। কেননা এটি উম্মতের মাস। হজরত আলী (রা.) ও ওসমান (রা.) মহররম থেকে শুরু করার পরামর্শ দেন। (উমদাতুল ক্বারি : ১৭/৬৬)

বর্ষ গণনা হিজরত থেকে কেন আরম্ভ করা হলো

বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে হিজরতের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ কী? অথচ মহানবী (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তিসহ আরো একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে সাল গণনা শুরু করা যেত। এ প্রশ্নের উত্তর আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) এভাবে দিয়েছেন : ”সুহাইলি (রহ.) এ বিষয়ে রহস্য উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম সাল গণনার বিষয়ে হিজরতকে প্রাধান্য দিয়েছেন সুরা তাওবার ১০৮ নম্বর আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে। সেখানে প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে। এই ‘প্রথম দিন’ ব্যাপক নয়। এটি রহস্যাবৃত। এটি সেই দিন, যেদিন ইসলামের বিশ্বজয়ের সূচনা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরাপদে, নির্ভয়ে নিজ প্রভুর ইবাদত করেছেন। মসজিদে কোবার ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ফলে সাল গণনার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম সেই দিনকেই বেছে নিয়েছেন’।” (ফতহুল বারি : ৭/২৬৮)

তিনি আরো লিখেছেন, ‘মহানবী (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, হিজরত ও নবুয়তপ্রাপ্তি- এ চার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করা যেত। কিন্তু জন্ম ও নবুয়তের তারিখ নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য আছে। আর মৃত্যু শোকের স্মারক। তাই অগত্যা হিজরতের মাধ্যমেই সাল গণনা শুরু করা হয়েছে।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

যেভাবে হিজরি সনের প্রচলন হলো

আপডেট টাইম : ০৫:০০:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

তারিখ শব্দটি আরবি। এর প্রচলিত অর্থ ইতিহাস, বছরের নির্দিষ্ট দিনের হিসাব। আল্লামা ইবনে মানজুর (রহ.) তাঁর বিখ্যাত আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ লিখেছেন : ‘তারিখ হলো, সময়কে নির্দিষ্ট করা, সময়ের চিত্র তুলে ধরা, সময়ের ঘটনাপ্রবাহ শব্দবদ্ধ করা।’ আল্লামা আইনি (রহ.) লিখেছেন : “সায়দাভি (রহ.) বলেছেন, ‘তারিখ’ শব্দটি ‘আরখুন’ থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ নবজাতক, সদ্যপ্রসূত শিশু। ইতিহাসের সঙ্গে এর সামঞ্জস্যতা হলো, নবজাতকের জন্মের মতো ইতিহাসও সৃজিত হয়, রচিত হয়। একের পর এক সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো ইতিহাসের ধারা চলমান, প্রবহমান।” কেউ কেউ বলেছেন, ‘তারিখ’ শব্দটি অনারবি। ‘মা’ ও ‘রোজ’ থেকে পরিবর্তন করে একে আরবিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এর অর্থ : দিন, মাস ও বছরের হিসাব।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, সংখ্যা গণনা, হিসাব সংরক্ষণের সঙ্গে ইতিহাসের সখ্য অনেক গভীর। সন-তারিখ ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনচরিত রচনা, সময়ের আলোচনা-পর্যালোচনা সন-তারিখ ছাড়া সম্ভব নয়। যদিও এটি ইতিহাস রচনার মূল উদ্দেশ্য নয়, তবুও সন-তারিখ প্রথা ইতিহাসের অনুষঙ্গ হয়ে আছে সেই আদিকাল থেকে। ফলে ইতিহাস বোঝাতে ‘তারিখ’ শব্দটিকেই ব্যবহার করা হয়।

তারিখ গণনার সূচনা যেভাবে হলো

তারিখ গণনার সূচনা কিভাবে হলো, কবে থেকে হলো, বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্নভাবে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। ‘আল মাওছুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা’ গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে এসেছে : ইসলাম আসার আগে আরবের সমষ্টিগত কোনো তারিখ ছিল না। সে সময় তারা প্রসিদ্ধ ঘটনা অবলম্বনে বছর ও মাস গণনা করত। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সন্তানরা কাবা শরিফ নির্মিত হওয়ার আগে তাঁর আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনা অবলম্বনে তারিখ নির্ধারণ করত। কাবা শরিফ নির্মাণের পর তারা বিক্ষিপ্ত হওয়া পর্যন্ত এর আলোকেই সাল গণনা করত। তারপর বনু ইসমাঈলের যারা হেজাজের তেহামা অঞ্চল থেকে বেরিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেত, তখন সেই গোত্র বেরিয়ে যাওয়ার দিন থেকে তারিখ গণনা করত। যারা তেহামাতে রয়ে যেত, তারা বনি জায়েদ গোত্রের জুহাইনা, নাহ্দ ও সাদের চলে যাওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করত। কাব বিন লুআইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত এ ধারা চলমান ছিল। পরে তাঁর মৃত্যুর দিন থেকে নতুনভাবে সাল গণনা শুরু হয়। এটা চলতে থাকে হস্তীবাহিনীর ঘটনা পর্যন্ত। হজরত ওমর (রা.) হিজরি নববর্ষের গোড়াপত্তন করার আগ পর্যন্ত আরবে ‘হস্তীবর্ষ’ই প্রচলিত ছিল। (আল-কামেল ফিত-তারিখ লি-ইবনিল আছির : ১/৯)

বনু ইসমাঈল ছাড়া আরবের অন্য গোত্রের লোকেরা নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে উপলক্ষ করে বর্ষ গণনা করত। যেমন- বাসুস, দাহেস, গাবরা, ইয়াওমু জি-কার, হরবুল ফুজ্জার ইত্যাদি ঐতিহাসিক যুদ্ধের দিন থেকে তারা নতুন নতুন বর্ষ গণনার সূত্রপাত করত। এটা তো গেল আরবদের সাল গণনার বর্ণনা। গোটা বিশ্বের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে বর্ষপঞ্জি গণনা আরম্ভ করা হয়। আদি পিতা আদম (আ.) পৃথিবীতে আগমনের দিন থেকে সাল গণনা শুরু। এ ধারা চলতে থাকে হজরত নুহ (আ.)-এর মহাপ্রলয় পর্যন্ত। এরপর মহাপ্রলয় থেকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। এটা চলতে থাকে ইব্রাহিম (আ.) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত। এ বর্ষপঞ্জি চলতে থাকে ইউসুফ (আ.) মিসরে শাসনকর্তা নিযুক্ত হওয়া পর্যন্ত। সে ঘটনা থেকে শুরু হয় নতুন বর্ষ গণনা। এটি চলতে থাকে মুসা (আ.)-এর মিসর ত্যাগের ঘটনা পর্যন্ত। সেটি চলতে থাকে দাউদ (আ.)-এর শাসনামল পর্যন্ত। সে ধারা চলতে থাকে সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্বকাল পর্যন্ত। সেটি চলতে থাকে হজরত ঈসা (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত। ঈসা (আ.)-এর জন্ম থেকে নতুন বর্ষ গণনা আরম্ভ হয়। আরবের হিম্য়ার গোত্র তাবাবিয়াহ (ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দিন) থেকে, প্রাচীন আরবের গাস্সান গোত্র বাঁধ নির্মাণের দিন থেকে সাল গণনা করে। সান’আ অধিবাসীরা হাবশিদের ইয়েমেন আক্রমণের দিন থেকে বর্ষ গণনা শুরু করে। তারপর তারা পারস্যদের জয়লাভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করে। (আল-ই’লান, লিস্ সাখাভি : ১৪৬-১৪৭)

পারসিকরা তাদের রাষ্ট্রনায়কদের চার স্তরে বিন্যস্ত করে সাল গণনা করত। রোমানরা পারসিকদের কাছে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত দারা ইবনে দারা নিহত হওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করত। কিবতিরা মিসরের রানি কিলইয়ুবাতরাকে বুখতে নছর বাদশাহ সাহায্য করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করত। ইহুদিরা বায়তুল মাকদিসে হামলা এবং এটি তাদের হাতছাড়া হওয়ার ঘটনাকে উপলক্ষ করে বর্ষ গণনা করে। খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে উত্তোলনের ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে খ্রিস্টবর্ষ পালন করে। (আল মাওছুয়াতুল ফিক্হিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা : ১০/২৮ ‘তারিখ’)

হিজরি বর্ষের সূচনা

হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসেও সবচেয়ে তাৎপর্যবহ, সুদূরপ্রসারী ঘটনা এটি। এটি দ্বীন ও মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ, বিসর্জনের এক সাহসী পদক্ষেপ। মুসলমানরা মক্কার কাফেরদের পাশবিক নির্যাতন-নিপীড়ন, অব্যাহত অমানবিক আচরণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ নীরবে সহ্য করার পর তাদের স্পর্ধা আরো বেড়ে যায়। তারা মহানবী (সা.)-কেও হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আল্লাহ তাআলা তাদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। মহানবী (সা.) ও মক্কার নির্যাতিত মুসলমানদের মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। হিজরতের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দ্বার উন্মোচিত হয়। সশস্ত্র যুদ্ধে তাগুতি শক্তির মোকাবিলার শুভ সূচনা হয়। উদিত হয় মক্কা বিজয়সহ ইসলামের বিশ্বজয়ের রঙিন সূর্য। হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) হিজরি নববর্ষের গোড়াপত্তন করেন। মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র চান্দ্রমাসের পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন। কেন একটি নতুন সাল গণনাপ্রথা চালু করতে হলো- এ নিয়ে বিভিন্ন অভিমত পাওয়া যায়। আল্লামা আইনির বিবরণ দেখুন : “হিজরি সাল প্রণয়নের কারণ নিয়ে মতবিরোধ আছে। ইবনে সমরকন্দি বলেন, ‘হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে চিঠি লিখেছেন যে আপনার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অনেক ফরমান আসে; কিন্তু তাতে তারিখ লেখা থাকে না। সুতরাং সময়ক্রম নির্ধারণের জন্য সাল গণনার ব্যবস্থা করুন। তারপর ওমর (রা.) হিজরি সালের গোড়াপত্তন করেন’।” আল্লামা ইবনুল আছির (রহ.) আল কামিল ফিত্ তারিখের মধ্যে এটিকে প্রসিদ্ধতম ও বিশুদ্ধতম অভিমত বলে আখ্যায়িত করেছেন। (সূত্র : প্রাগুক্ত ১/৮)

আল্লামা আইনি তারপর লিখেছেন, “আবুল ইক্জান বলেছেন : ‘হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে একটি দলিল পেশ করা হয়, যাতে কেবল শাবান মাসের কথা লেখা হয়। তিনি বলেন : এটা কোন শাবান! এ বছরের শাবান নাকি আগামী বছরের শাবান? তারপর হিজরি সন প্রবর্তন করা হয়’।” আল্লামা শিবলি নোমানি (রহ.) এ অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (আল ফারুক : পৃ. ১৯৫)

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত : যখন হজরত ওমর (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি পরামর্শসভার আহ্বান করেন। সভায় হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাছ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাত থেকে সাল গণনার প্রস্তাব দেন। হজরত তালহা (রা.) নবুয়তের বছর থেকে সাল গণনার অভিমত ব্যক্ত করেন। হজরত আলী (রা.) হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। তারপর তাঁরা সবাই আলী (রা.)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন। এরপর কোন মাস থেকে শুরু হবে- এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) রজব থেকে শুরু করার প্রস্তাব দেন। কেননা এটি চারটি সম্মানিত মাসের মধ্যে প্রথমে আসে। হজরত তালহা (রা.) রমজান থেকে শুরু করার কথা বলেন। কেননা এটি উম্মতের মাস। হজরত আলী (রা.) ও ওসমান (রা.) মহররম থেকে শুরু করার পরামর্শ দেন। (উমদাতুল ক্বারি : ১৭/৬৬)

বর্ষ গণনা হিজরত থেকে কেন আরম্ভ করা হলো

বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে হিজরতের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ কী? অথচ মহানবী (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তিসহ আরো একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে সাল গণনা শুরু করা যেত। এ প্রশ্নের উত্তর আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) এভাবে দিয়েছেন : ”সুহাইলি (রহ.) এ বিষয়ে রহস্য উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম সাল গণনার বিষয়ে হিজরতকে প্রাধান্য দিয়েছেন সুরা তাওবার ১০৮ নম্বর আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে। সেখানে প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে। এই ‘প্রথম দিন’ ব্যাপক নয়। এটি রহস্যাবৃত। এটি সেই দিন, যেদিন ইসলামের বিশ্বজয়ের সূচনা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরাপদে, নির্ভয়ে নিজ প্রভুর ইবাদত করেছেন। মসজিদে কোবার ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ফলে সাল গণনার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম সেই দিনকেই বেছে নিয়েছেন’।” (ফতহুল বারি : ৭/২৬৮)

তিনি আরো লিখেছেন, ‘মহানবী (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, হিজরত ও নবুয়তপ্রাপ্তি- এ চার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করা যেত। কিন্তু জন্ম ও নবুয়তের তারিখ নিয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য আছে। আর মৃত্যু শোকের স্মারক। তাই অগত্যা হিজরতের মাধ্যমেই সাল গণনা শুরু করা হয়েছে।’