ঢাকা ০৮:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হে ক্ষমতাবান! নিজের প্রতি রহম করুন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:৩৮:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫
  • ২২৮ বার

????????????????????????????????????

বাংলাদেশের কোনো ক্ষমতাবানকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে আমাকে একাধিকবার ভাবতে হয়েছে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে। আমাকে এ কথাও ভাবতে হয়েছে যে, প্রায় পাঁচ কোটি লোক অন্ধের মতো তাদের নেতা-নেত্রীর সব কর্ম সমর্থন করেন। অন্যদিকে প্রায় সমসংখ্যক লোক কোনো রকম বাছ-বিচার না করেই তার সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করেন। এই শ্রেণির বাইরে আরও ছয়-সাত কোটি লোক আছেন তারা দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেন এবং অতীব বুদ্ধিমান প্রাণীর মতো সময় ও সুযোগ বুঝে একটি দলের দিকে তাদের সমর্থন নিয়ে ঝুঁকে পড়েন। এ অবস্থায় ক্ষমতাধর কাউকে নিয়ে আমি যা কিছুই লিখি না কেন তা আমাদের দেশে ত্রিমাত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। কাজেই আজকের লেখাটি সরাসরি কোনো ব্যক্তির উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত না হয়ে যদি ধ্রুপদী ঢঙে এবং দরবারি রাগ-ছন্দে পরিবেশিত হয় তবে লেখক সুবিধাজনক স্থানে থাকতে পারবেন।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে নিই কেন আমি ক্ষমতাবানকে নিজের প্রতি রহম করার কথা বললাম। বললাম এ কারণে, তিনি নিশ্চয়ই জানেন- যে ব্যক্তি নিজের প্রতি রহম করতে পারে না তার পক্ষে অন্য মানুষের প্রতি রহম দিল হওয়া অসম্ভব। রহম একটি আরবি শব্দ। এটির সঙ্গে রহমত, মহব্বত, ইনসাফ এবং ইনসানিয়াতের রয়েছে বহুমুখী অন্তর্নিহিত সম্পর্ক। একটি মায়ার বন্ধন এবং অদৃশ্য রুবিবিয়তের রুহানি শক্তি দ্বারা স্বয়ং আল্লাহ তার সব সৃষ্টিকুলকে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন। ফলে কোনো একক সৃষ্টি যদি অন্য কোনো সৃষ্টির উপকার করে তবে কল্যাণের মোহময় সুর লহরী তাবৎ সৃষ্টিকুলকে আন্দোলিত করে। অন্যদিকে ব্যক্তির ভুল, ভ্রান্তি, জুলুম বা অন্যায় যদি কাউকে আঘাত করে পুরো মাখলুকাত কেঁপে ওঠে। কাজেই ব্যক্তি যখন নিজের প্রতি রহম করে, তখন মূলত নিজের প্রতিকৃত সেই রহমে পুরো সৃষ্টিকুল উপকৃত হয়।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি, ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ আধ্যাত্দবাদী মহামানবের মতে, মানুষ যখন তার অন্তর্নিহিত সৎ গুণাবলি, চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধি-প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং গরিমা দিয়ে নিজের কর্মকাণ্ডকে মূল্যায়ন করতে সমর্থ হয় তখন হেদায়েত, রহমত ও বরকতের রাস্তা মানুষটিকে কল্যাণের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ফলে লোকটি নিজের প্রতি অবিচার ও জুলুমের দায় থেকে রেহাই পেয়ে জমিনে খোদায়ী রহমত এবং বরকতের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, মানুষের কু-রিপু এবং অজ্ঞানতা যদি কারও প্রতি আছর করে তবে পুরো পৃথিবীটাকেই একটি মোহময় জাদুর বাঙ্ বলে মনে হতে থাকে। সেই ক্ষেত্রে ভালো-মন্দ পৃথক করার ক্ষমতা মানুষ হারিয়ে ফেলে। আমি আগেই বলেছি যে, আজকের লেখাটি ধ্রুপদী এবং দরবারি ঢঙে পরিবেশিত হবে। অর্থাৎ কথাগুলো সবার জন্য। কেউ ইচ্ছে করলে শুনতেও পারেন আবার এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে নিজ নিজ দরবারে কাজ ইচ্ছেমতো চালিয়ে যেতে পারেন। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আপনি যদি নিজের প্রতি রহম করার জন্য আপনার আশপাশের লোকজনের প্রতি তাকান এবং তাদের সততা, নৈতিকতা, নিষ্ঠা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ নিয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেন সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য দুটো উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন। প্রথমটি হলো- আহা! লোকগুলো কতই না ভালো। কত সুন্দরভাবে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। তারা মদ্যপান করেন না- নীতিবহিভর্ূত কোনো কাজ করেন না, অন্যের হক নষ্ট করেন না। আমানতের খেয়ানত করেন না, তাদের আনুগত্য নিয়ে কোনো সন্দেহ করার অবকাশ নেই। তারা নিজেরা যেমন ঘুষ, দুর্নীতি, অশালীন কর্ম করেন না তদ্রূপ এমন কাজ যেন কেউ করতে না পারে সে জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। কাজেই লোকগুলোর দ্বারা আপনার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই- আপনি তাদের অন্তর থেকে খুশি মনে ভালোবাসেন। তাদের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান। আপনার সব আমানত তাদের কাছে যক্ষের ধনের মতো সংরক্ষিত থাকে। ফলে তাদের নিয়োগ দিয়ে আপনি নিজের প্রতি রহম করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানবুদ্ধি-প্রজ্ঞা এবং মেধার সর্বোচ্চ সতর্ক প্রয়োগ করেছেন।
দ্বিতীয় উত্তরটা হয়তো আপনার জন্য আরও কল্যাণকর হবে যদি আপনি দেখতে পান যে, কর্মক্ষেত্রের আশপাশের ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ মূলত আপনাকে খুশি করার জন্য প্রকারান্তে জমিনে চরম ফ্যাতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করছে। তারা কথায় কথায় মিথ্যা বলে। তাদের হাসির মধ্যে কোনো উচ্ছলতা কিংবা আন্তরিকতা নেই। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো একেবারেই হাসে না, অতিরিক্ত বিনয় দেখাতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ সব সময় মাথা নিচু করে বেশি মোলায়েম এবং তুলতুলে স্বরে কথা বলে তারা যে আপনাকে খুবই ভয় করে সে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার জন্য সারাক্ষণ চোখে-মুখে কৃত্রিম ভয় ভয় ভাবের মানচিত্র অংকন করে মুখখানা গম্ভীর করে রাখে।
আপনি হয়তো আরেকটি দলের সন্ধানও পেতে পারেন যারা আপনার প্রতি স্বাভাবিক আচরণ করে না। একান্ত আলাপচারিতায় তারা সুযোগ পেলেই ঔদ্ধত্য দেখায় এবং রীতিমতো বেয়াদবির চেষ্টা করে। তারা কথা বলার সময় এদিক-ওদিক মাথা ঘোরায়, পায়ের ওপর পা তুলে দোলাতে থাকে কিংবা অসংলগ্ন এবং বিশ্রী মুদ্রাদোষের তাড়নায় নাড়াচাড়া করতে থাকে। কথা বলার সময় তারা নানা মুদ্রাদোষে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ খুক খুক কাশি দেয়, নাকে মুখে চুলকাতে আরম্ভ করে এবং মাঝেমধ্যে বড় বড় হাই তুলে এবং সুযোগ পেলেই ঝিমিয়ে পড়ে কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরা আপনার সুদিনে মুখ ভার করে থাকে এবং ঝামেলার সময়গুলোতে দাঁত-মুখ খিচিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করে যে, ওদিকে তাকালে মনে হয় পুরো পৃথিবীটাই সাহারা মরুভূমি হয়ে গেছে।
আপনি অবশ্যই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবেন যদি আপনি কিছু লোককে চিহ্নিত করতে পারেন যারা কিনা শিক্ষাদীক্ষা, বংশ মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতর হওয়া সত্ত্বেও আপনার কাছে অভাবগ্রস্ত ফকিরের মতো দাঁড়াতে পছন্দ করে। তারা কথা বলার সময় নিজেদের সব জ্ঞান সিন্ধুকে ভরে রাখে এবং আপনার মর্জি ও মেজাজ বুঝে সব কাজে অন্ধের মতো সায় দিতে থাকে। তারা কোনো দিন আপনাকে পরামর্শ তো দেয়ই না উল্টো তাদের জীবনের ছোটখাটো বিষয়ে আপনার পরামর্শ চেয়ে বসে। তারা সর্বদা নিজেদের সব যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের ওপর আপনার কদম দু’খানার স্পর্শ লাগিয়ে নিজেদের হীনমন্যতার নিম্নস্তরে নামিয়ে আনার প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তারা নিজেদের বোকা, অসহায়, আশ্রয়হীন এবং একান্ত অনুগত প্রমাণের জন্য সর্বতো চেষ্টা করে কেবল আপনার আনুকূল্য লাভ এবং পদ-পদবি পাওয়ার লোভে। তারা এমনভাবে বাক্য রচনা করে কিংবা এমনভাবে মূকাভিনয়ে সফলতা দেখায় যে অনুগ্রহ করা ছাড়া ভিন্ন উপায় থাকে না।
আপনি ইচ্ছে করলে আপনার চারপাশের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। যারা খুশকিযুক্ত চুল এবং ময়লাযুক্ত দাঁতের অধিকারী তাদের আপনি একটি শ্রেণিতে ফেলুন। এরপর অতিরিক্ত মোটা এবং বেঢপ আকৃতির লোকজন এবং কৃশকায় লোকদের পৃথক করুন। যারা অতিরিক্ত বায়ুভর্তি পেট এবং টেকো মাথা নিয়ে ঘনঘন চুকা ঢেঁক মারে তাদের চিনে রাখুন। যারা পোশাক-আশাকে অতিরিক্ত ফিটবাবু সেজে হাতে বাহারি আংটি গায়ে দামি সেন্ট, আকর্ষণীয় মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে সর্বদা কথা বলে এবং মিচকে হাসি দিয়ে চারদিকে ইতিউতি করে তাকায় তাদের ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, তারা কাজের চেয়ে বিপরীত লিঙ্গের নাগর কিংবা নাগরিকে আকর্ষণ করতে বেশি তৎপর। অন্যদিকে যারা উঁচু পদে থেকে ভিখেরির বেশ ধারণ করে তারা হয় ভণ্ড না হয় রুচিহীন বিকৃত মানসিকতার অধিকারী। জেনা, ব্যভিচার, অসৎ পন্থায় উপার্জন, মিথ্যাবাদিতা, ভণ্ডামি ইত্যাদি মারাত্দক গুনাহগার পাপীদের যদি আপনি জেনেশুনে আপনার সঙ্গী-সাথী কিংবা সাহায্যকারী অথবা কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেন তবে জেনে রাখুন কিয়ামতের দিন আপনাকে মস্ত বড় জুলুমকারী হিসেবে কুখ্যাত সব জালেমের কাতারে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। আপনার মন, বুদ্ধি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ সেদিন আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে আপনার জন্য অনন্তকালের ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
আপনার অনুগ্রহ এবং করুণাপ্রাপ্ত দলবাজ এবং ধুরন্ধর প্রকৃতির কর্মকর্তাকে উঁচু পদে বসিয়ে আপনি যে নিজের প্রতি কতটা অন্যায় করেছেন তা অন্তিমকাল আসার আগে যদি বুঝতে পারেন তবে সেটা হবে আপনার জন্য পরম এক সৌভাগ্য। আপনার জ্ঞান বলে দেবে, সুবিধাভোগীরা সব সময়ই হয় মেরুদণ্ডহীন, লোভী এবং স্বার্থপর প্রকৃতির। তাদের সব যোগ্যতা, সাহস এবং শক্তি সুবিধার সুধারসে বিলীন হয়ে তাদের চরম কাপুরুষ বা কা-মহিলা বানিয়ে ফেলে, তারা শান্তির সময়ে নিজ গোত্র কিংবা দলের মধ্যে কলহ-বিবাদ করে। তাদেরই মতো অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তকে বিনাশ করার জন্য আপনার দানকৃত অর্থ বিত্তবৈভব এবং ক্ষমতার বিরাট এক অংশ অপচয় অথবা বিনষ্ট করে ফেলে। তারা সুযোগ পেলে আপনার প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলায় এবং প্রতিপক্ষের আস্থা অর্জনের জন্য নোংরামির নিম্নস্তরে গমন করে। সামান্য বিপদ দেখলে তারা পালানোর জন্য পথ খুঁজতে থাকে এবং নিজেদের জান বাঁচানোর জন্য এসব লোক আপনি তো দূরের কথা- নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কোরবানি দিতে পিছপা হয় না। আধুনিককালে আপনার জন্য সবচেয়ে বড় মুসিবত হলো সংবাদ মাধ্যম। একই সঙ্গে এটি আপনার জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হতে পারে যদি আপনি এক্ষেত্রে নিজের প্রতি রহম করতে পারেন। আপনার উচিত হবে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়ের বিষয়ে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা। পত্রিকার বিজ্ঞাপন এবং প্রতিবেদন জনগণকে কোনো একটি বিষয় অবহিত করে মাত্র। এগুলো সচেতন হতে সাহায্য করে। কিন্তু সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়গুলো জনমত গঠন করে। জনমত প্রভাবিত করে এবং অনেক সময় জনমতকে পাল্টে দেয়। এখন আপনি একটু চিন্তা করুন তো আপনার আশপাশে কেউ আছে কিনা যার লেখা সম্পাদকীয় কিংবা উপ-সম্পাদকীয় ৫০ লাখ লোক তো দূরের কথা পাঁচশত জন নিয়মিত পড়ে! অথবা আপনি নিজে গত এক বছরে আপনার অনুগ্রহভাজন কারও লেখা পড়েছেন অথবা পড়ার পর ভেবেছেন লোকটি এমন কথা লিখেছে যা লাখ লাখ মানুষ পড়েছে এবং আপনার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পেয়েছে। আপনি নিজের প্রতি রহমদিল হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন- বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি সংবাদপত্র পাঠক চাতক পাখির মতো যেসব কলামিস্টের লেখা পড়ার জন্য অপেক্ষা করেন এবং প্রতিদিন পত্রিকাগুলোতে তাদের লেখা খুঁজে বেড়ান এবং একেকটি লেখা একাধিকবার পাঠ করার পর তা পত্রিকার পাতা থেকে কেটে সংরক্ষণ করেন সেসব লেখকের নামধাম, টেলিফোন নম্বর আপনার জানা আছে কি? কিংবা সেসব লেখকের সঙ্গে গত সাত-আট বছরে আপনার কোনো কথাবার্তা হয়েছে কি?
এরপর আপনি টেলিভিশনগুলোর দিকে তাকান। দেখবেন সেখানে টকশোর নামে আপনার লোকজন কী করছে। এক সময় কয়েকটি চ্যানেলের কিছু জনপ্রিয় টকশো আরম্ভ হলে দেশ-বিদেশের বাঙালিরা সব কাজ ফেলে তা দেখতেন। কোনো কোনো অনুষ্ঠানের টিআরপিতে ৫০-৬০ লাখ দর্শকের উপস্থিতির রেকর্ড ছিল। বর্তমানে একমাত্র তৃতীয়মাত্রা ছাড়া কোনো টকশোর দেশ-বিদেশের দর্শক চার-পাঁচ হাজারের বেশি নয়। আপনার অনুগ্রহভাজন ধামাধরা শব্দ ও বাক্য সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দর্শককুল টিভি দেখাই বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আপনার জন্য প্রণীত বন্দনা কেউ দেখে না। আমার বিশ্বাস আপনি নিজেও দেখেন না। আমার অনুরোধ আগামী কিছু দিন নিয়ম করে টকশোগুলো দেখুন এবং ভাবুন বক্তাদের কয়টি কথা আপনার পছন্দ হয়েছে এবং আপনি তাদের বক্তব্যে প্রভাবিত হন কিনা অথবা এসব বক্তা কিংবা বক্তব্য আপনার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? অন্যথায় বন্ধ করে দিন ওসব ভাঁড়ামি অথবা বন্দনামূলক গীতিনাট্য যা কিনা জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং আপনাকে মানুষের বিরক্তির কারণ বানিয়ে ফেলছে।
শহরের আনাচে-কানাচে যেখানে মানুষের দুর্ভোগ এসে কেন্দ্রীভূত হয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভে দাউ দাউ করে জ্বলছে, যেখানে গভীর রাত পর্যন্ত দুঃসহ যানজট লেগে থাকে। যেখানকার রাস্তা ভেঙে খানাখন্দকে পরিণত হয়েছে এবং যেখানটায় আপনার অনুগ্রহভাজনরা দুর্বৃত্তপনায় জনগণকে অতিষ্ঠ করে ফেলেছে ঠিক সেই জায়গায় বিরাট এক বিলবোর্ডে শান্তির পায়রা হাতে আপনার হাস্যোজ্জ্বল ছবি কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এমনতরো ভাবনা যদি ভাবতে না পারেন তবে আপনি কী করে নিজের প্রতি রহম করলেন? আপনার মনে রাখা উচিত বোকা ও নির্বোধ লোকদের আল্লাহ পছন্দ করেন না। জ্ঞানী, চরিত্রবান এবং প্রজ্ঞাবানদের স্বয়ং আল্লাহ এবং তার রসুল (সা.) মর্যাদা দিয়েছেন। ভুলেও এসব মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ হলো জ্ঞান। কোনো জ্ঞানী তার জ্ঞানকে ফেরি করে বিক্রি করেন না। জ্ঞান হলো সূর্যের আলোর চেয়ে বিভাময় এবং শক্তিশালী। পৃথিবীর কোনো শক্তিমান মানুষ জ্ঞান এবং জ্ঞানীদের বন্দী বা আবদ্ধ করে রাখতে পারেননি। জ্ঞানীরা কারও কাছে যায় না- বরং তাবৎ দুনিয়ার সব বুদ্ধিমান ক্ষমতাবানরা জ্ঞানীর কাছে আশ্রয় নেয়। আলেকজান্ডারের মতো মহাবীর এবং মহান বিজেতা বিজিত রাজ্যের জ্ঞানীদের সন্ধান করতেন এবং তাদের দ্বারে গিয়ে বিদ্যার্থীদের মতো বিনয় ও ভদ্রতা নিয়ে উপস্থিত হতেন।
আপনি নিশ্চয়ই বাইয়াত শব্দটির সঙ্গে পরিচিত আছেন। হাজার বছরের ইতিহাসে সব রাজা, বাদশাহ, সম্রাট এবং খলিফারা সিংহাসনে আরোহণ করেই সাম্রাজ্যের জ্ঞানী-গুণী, অভিজাত, আমির, ওমরাহ, পীর-দরবেশ প্রমুখকে রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কাছ থেকে সমর্থন চাইতেন। সাম্রাজ্যের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিও যদি বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতেন তাহলে বাদশাহ নিজেকে বৈধ মনে করতেন না। অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধ বেঁধে যেত এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়ে যেত। ঢাকা শহরে ১০০ বর্গফুটের ছোট্ট একটি দোকানের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য অনেকগুলো বৈধ দলিল দস্তাবেজের দরকার হয়। একজন নারী কিংবা পুরুষের শরীর ও মনের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য হাজার চেষ্টা-তদবিরের সঙ্গে দরকার পড়ে বৈধ কাবিননামা। কাজেই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড, প্রায় এক লাখ বর্গমাইলের সমুদ্র এবং ১৭ কোটি মানুষের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য কি কি বৈধ দলিল ও দস্তাবেজ দরকার তা যদি আপনি না ভাবেন তবে কী করে আপনার প্রতি আপনি রহম করবেন? আপনি যদি মাগুরা মার্কা নির্বাচন, ঢাকার তেজগাঁওয়ের ফালু মার্কা প্রহসন এবং ৫ জানুয়ারির রকিব মার্কা বায়স্কোপকে ক্ষমতার দলিল মনে করেন তবে আমার এ লেখাটি অরণ্যে রোদন বৈ কিছুই যে নয় তা আর কেউ না বুঝলেও আমি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারব। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হে ক্ষমতাবান! নিজের প্রতি রহম করুন

আপডেট টাইম : ০৪:৩৮:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

বাংলাদেশের কোনো ক্ষমতাবানকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে আমাকে একাধিকবার ভাবতে হয়েছে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে। আমাকে এ কথাও ভাবতে হয়েছে যে, প্রায় পাঁচ কোটি লোক অন্ধের মতো তাদের নেতা-নেত্রীর সব কর্ম সমর্থন করেন। অন্যদিকে প্রায় সমসংখ্যক লোক কোনো রকম বাছ-বিচার না করেই তার সবকিছুকে প্রত্যাখ্যান করেন। এই শ্রেণির বাইরে আরও ছয়-সাত কোটি লোক আছেন তারা দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেন এবং অতীব বুদ্ধিমান প্রাণীর মতো সময় ও সুযোগ বুঝে একটি দলের দিকে তাদের সমর্থন নিয়ে ঝুঁকে পড়েন। এ অবস্থায় ক্ষমতাধর কাউকে নিয়ে আমি যা কিছুই লিখি না কেন তা আমাদের দেশে ত্রিমাত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। কাজেই আজকের লেখাটি সরাসরি কোনো ব্যক্তির উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত না হয়ে যদি ধ্রুপদী ঢঙে এবং দরবারি রাগ-ছন্দে পরিবেশিত হয় তবে লেখক সুবিধাজনক স্থানে থাকতে পারবেন।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে নিই কেন আমি ক্ষমতাবানকে নিজের প্রতি রহম করার কথা বললাম। বললাম এ কারণে, তিনি নিশ্চয়ই জানেন- যে ব্যক্তি নিজের প্রতি রহম করতে পারে না তার পক্ষে অন্য মানুষের প্রতি রহম দিল হওয়া অসম্ভব। রহম একটি আরবি শব্দ। এটির সঙ্গে রহমত, মহব্বত, ইনসাফ এবং ইনসানিয়াতের রয়েছে বহুমুখী অন্তর্নিহিত সম্পর্ক। একটি মায়ার বন্ধন এবং অদৃশ্য রুবিবিয়তের রুহানি শক্তি দ্বারা স্বয়ং আল্লাহ তার সব সৃষ্টিকুলকে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন। ফলে কোনো একক সৃষ্টি যদি অন্য কোনো সৃষ্টির উপকার করে তবে কল্যাণের মোহময় সুর লহরী তাবৎ সৃষ্টিকুলকে আন্দোলিত করে। অন্যদিকে ব্যক্তির ভুল, ভ্রান্তি, জুলুম বা অন্যায় যদি কাউকে আঘাত করে পুরো মাখলুকাত কেঁপে ওঠে। কাজেই ব্যক্তি যখন নিজের প্রতি রহম করে, তখন মূলত নিজের প্রতিকৃত সেই রহমে পুরো সৃষ্টিকুল উপকৃত হয়।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি, ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ আধ্যাত্দবাদী মহামানবের মতে, মানুষ যখন তার অন্তর্নিহিত সৎ গুণাবলি, চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধি-প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং গরিমা দিয়ে নিজের কর্মকাণ্ডকে মূল্যায়ন করতে সমর্থ হয় তখন হেদায়েত, রহমত ও বরকতের রাস্তা মানুষটিকে কল্যাণের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ফলে লোকটি নিজের প্রতি অবিচার ও জুলুমের দায় থেকে রেহাই পেয়ে জমিনে খোদায়ী রহমত এবং বরকতের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, মানুষের কু-রিপু এবং অজ্ঞানতা যদি কারও প্রতি আছর করে তবে পুরো পৃথিবীটাকেই একটি মোহময় জাদুর বাঙ্ বলে মনে হতে থাকে। সেই ক্ষেত্রে ভালো-মন্দ পৃথক করার ক্ষমতা মানুষ হারিয়ে ফেলে। আমি আগেই বলেছি যে, আজকের লেখাটি ধ্রুপদী এবং দরবারি ঢঙে পরিবেশিত হবে। অর্থাৎ কথাগুলো সবার জন্য। কেউ ইচ্ছে করলে শুনতেও পারেন আবার এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে নিজ নিজ দরবারে কাজ ইচ্ছেমতো চালিয়ে যেতে পারেন। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। আপনি যদি নিজের প্রতি রহম করার জন্য আপনার আশপাশের লোকজনের প্রতি তাকান এবং তাদের সততা, নৈতিকতা, নিষ্ঠা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ নিয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেন সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য দুটো উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন। প্রথমটি হলো- আহা! লোকগুলো কতই না ভালো। কত সুন্দরভাবে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। তারা মদ্যপান করেন না- নীতিবহিভর্ূত কোনো কাজ করেন না, অন্যের হক নষ্ট করেন না। আমানতের খেয়ানত করেন না, তাদের আনুগত্য নিয়ে কোনো সন্দেহ করার অবকাশ নেই। তারা নিজেরা যেমন ঘুষ, দুর্নীতি, অশালীন কর্ম করেন না তদ্রূপ এমন কাজ যেন কেউ করতে না পারে সে জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। কাজেই লোকগুলোর দ্বারা আপনার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই- আপনি তাদের অন্তর থেকে খুশি মনে ভালোবাসেন। তাদের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান। আপনার সব আমানত তাদের কাছে যক্ষের ধনের মতো সংরক্ষিত থাকে। ফলে তাদের নিয়োগ দিয়ে আপনি নিজের প্রতি রহম করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানবুদ্ধি-প্রজ্ঞা এবং মেধার সর্বোচ্চ সতর্ক প্রয়োগ করেছেন।
দ্বিতীয় উত্তরটা হয়তো আপনার জন্য আরও কল্যাণকর হবে যদি আপনি দেখতে পান যে, কর্মক্ষেত্রের আশপাশের ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ মূলত আপনাকে খুশি করার জন্য প্রকারান্তে জমিনে চরম ফ্যাতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করছে। তারা কথায় কথায় মিথ্যা বলে। তাদের হাসির মধ্যে কোনো উচ্ছলতা কিংবা আন্তরিকতা নেই। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো একেবারেই হাসে না, অতিরিক্ত বিনয় দেখাতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ সব সময় মাথা নিচু করে বেশি মোলায়েম এবং তুলতুলে স্বরে কথা বলে তারা যে আপনাকে খুবই ভয় করে সে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার জন্য সারাক্ষণ চোখে-মুখে কৃত্রিম ভয় ভয় ভাবের মানচিত্র অংকন করে মুখখানা গম্ভীর করে রাখে।
আপনি হয়তো আরেকটি দলের সন্ধানও পেতে পারেন যারা আপনার প্রতি স্বাভাবিক আচরণ করে না। একান্ত আলাপচারিতায় তারা সুযোগ পেলেই ঔদ্ধত্য দেখায় এবং রীতিমতো বেয়াদবির চেষ্টা করে। তারা কথা বলার সময় এদিক-ওদিক মাথা ঘোরায়, পায়ের ওপর পা তুলে দোলাতে থাকে কিংবা অসংলগ্ন এবং বিশ্রী মুদ্রাদোষের তাড়নায় নাড়াচাড়া করতে থাকে। কথা বলার সময় তারা নানা মুদ্রাদোষে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ খুক খুক কাশি দেয়, নাকে মুখে চুলকাতে আরম্ভ করে এবং মাঝেমধ্যে বড় বড় হাই তুলে এবং সুযোগ পেলেই ঝিমিয়ে পড়ে কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরা আপনার সুদিনে মুখ ভার করে থাকে এবং ঝামেলার সময়গুলোতে দাঁত-মুখ খিচিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করে যে, ওদিকে তাকালে মনে হয় পুরো পৃথিবীটাই সাহারা মরুভূমি হয়ে গেছে।
আপনি অবশ্যই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবেন যদি আপনি কিছু লোককে চিহ্নিত করতে পারেন যারা কিনা শিক্ষাদীক্ষা, বংশ মর্যাদায় শ্রেষ্ঠতর হওয়া সত্ত্বেও আপনার কাছে অভাবগ্রস্ত ফকিরের মতো দাঁড়াতে পছন্দ করে। তারা কথা বলার সময় নিজেদের সব জ্ঞান সিন্ধুকে ভরে রাখে এবং আপনার মর্জি ও মেজাজ বুঝে সব কাজে অন্ধের মতো সায় দিতে থাকে। তারা কোনো দিন আপনাকে পরামর্শ তো দেয়ই না উল্টো তাদের জীবনের ছোটখাটো বিষয়ে আপনার পরামর্শ চেয়ে বসে। তারা সর্বদা নিজেদের সব যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং শ্রেষ্ঠত্বের ওপর আপনার কদম দু’খানার স্পর্শ লাগিয়ে নিজেদের হীনমন্যতার নিম্নস্তরে নামিয়ে আনার প্রতিযোগিতায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তারা নিজেদের বোকা, অসহায়, আশ্রয়হীন এবং একান্ত অনুগত প্রমাণের জন্য সর্বতো চেষ্টা করে কেবল আপনার আনুকূল্য লাভ এবং পদ-পদবি পাওয়ার লোভে। তারা এমনভাবে বাক্য রচনা করে কিংবা এমনভাবে মূকাভিনয়ে সফলতা দেখায় যে অনুগ্রহ করা ছাড়া ভিন্ন উপায় থাকে না।
আপনি ইচ্ছে করলে আপনার চারপাশের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন। যারা খুশকিযুক্ত চুল এবং ময়লাযুক্ত দাঁতের অধিকারী তাদের আপনি একটি শ্রেণিতে ফেলুন। এরপর অতিরিক্ত মোটা এবং বেঢপ আকৃতির লোকজন এবং কৃশকায় লোকদের পৃথক করুন। যারা অতিরিক্ত বায়ুভর্তি পেট এবং টেকো মাথা নিয়ে ঘনঘন চুকা ঢেঁক মারে তাদের চিনে রাখুন। যারা পোশাক-আশাকে অতিরিক্ত ফিটবাবু সেজে হাতে বাহারি আংটি গায়ে দামি সেন্ট, আকর্ষণীয় মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে সর্বদা কথা বলে এবং মিচকে হাসি দিয়ে চারদিকে ইতিউতি করে তাকায় তাদের ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, তারা কাজের চেয়ে বিপরীত লিঙ্গের নাগর কিংবা নাগরিকে আকর্ষণ করতে বেশি তৎপর। অন্যদিকে যারা উঁচু পদে থেকে ভিখেরির বেশ ধারণ করে তারা হয় ভণ্ড না হয় রুচিহীন বিকৃত মানসিকতার অধিকারী। জেনা, ব্যভিচার, অসৎ পন্থায় উপার্জন, মিথ্যাবাদিতা, ভণ্ডামি ইত্যাদি মারাত্দক গুনাহগার পাপীদের যদি আপনি জেনেশুনে আপনার সঙ্গী-সাথী কিংবা সাহায্যকারী অথবা কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেন তবে জেনে রাখুন কিয়ামতের দিন আপনাকে মস্ত বড় জুলুমকারী হিসেবে কুখ্যাত সব জালেমের কাতারে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে। আপনার মন, বুদ্ধি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ সেদিন আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে আপনার জন্য অনন্তকালের ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
আপনার অনুগ্রহ এবং করুণাপ্রাপ্ত দলবাজ এবং ধুরন্ধর প্রকৃতির কর্মকর্তাকে উঁচু পদে বসিয়ে আপনি যে নিজের প্রতি কতটা অন্যায় করেছেন তা অন্তিমকাল আসার আগে যদি বুঝতে পারেন তবে সেটা হবে আপনার জন্য পরম এক সৌভাগ্য। আপনার জ্ঞান বলে দেবে, সুবিধাভোগীরা সব সময়ই হয় মেরুদণ্ডহীন, লোভী এবং স্বার্থপর প্রকৃতির। তাদের সব যোগ্যতা, সাহস এবং শক্তি সুবিধার সুধারসে বিলীন হয়ে তাদের চরম কাপুরুষ বা কা-মহিলা বানিয়ে ফেলে, তারা শান্তির সময়ে নিজ গোত্র কিংবা দলের মধ্যে কলহ-বিবাদ করে। তাদেরই মতো অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তকে বিনাশ করার জন্য আপনার দানকৃত অর্থ বিত্তবৈভব এবং ক্ষমতার বিরাট এক অংশ অপচয় অথবা বিনষ্ট করে ফেলে। তারা সুযোগ পেলে আপনার প্রতিপক্ষের সঙ্গে হাত মেলায় এবং প্রতিপক্ষের আস্থা অর্জনের জন্য নোংরামির নিম্নস্তরে গমন করে। সামান্য বিপদ দেখলে তারা পালানোর জন্য পথ খুঁজতে থাকে এবং নিজেদের জান বাঁচানোর জন্য এসব লোক আপনি তো দূরের কথা- নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কোরবানি দিতে পিছপা হয় না। আধুনিককালে আপনার জন্য সবচেয়ে বড় মুসিবত হলো সংবাদ মাধ্যম। একই সঙ্গে এটি আপনার জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হতে পারে যদি আপনি এক্ষেত্রে নিজের প্রতি রহম করতে পারেন। আপনার উচিত হবে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়ের বিষয়ে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা। পত্রিকার বিজ্ঞাপন এবং প্রতিবেদন জনগণকে কোনো একটি বিষয় অবহিত করে মাত্র। এগুলো সচেতন হতে সাহায্য করে। কিন্তু সম্পাদকীয় এবং উপ-সম্পাদকীয়গুলো জনমত গঠন করে। জনমত প্রভাবিত করে এবং অনেক সময় জনমতকে পাল্টে দেয়। এখন আপনি একটু চিন্তা করুন তো আপনার আশপাশে কেউ আছে কিনা যার লেখা সম্পাদকীয় কিংবা উপ-সম্পাদকীয় ৫০ লাখ লোক তো দূরের কথা পাঁচশত জন নিয়মিত পড়ে! অথবা আপনি নিজে গত এক বছরে আপনার অনুগ্রহভাজন কারও লেখা পড়েছেন অথবা পড়ার পর ভেবেছেন লোকটি এমন কথা লিখেছে যা লাখ লাখ মানুষ পড়েছে এবং আপনার সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পেয়েছে। আপনি নিজের প্রতি রহমদিল হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন- বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি সংবাদপত্র পাঠক চাতক পাখির মতো যেসব কলামিস্টের লেখা পড়ার জন্য অপেক্ষা করেন এবং প্রতিদিন পত্রিকাগুলোতে তাদের লেখা খুঁজে বেড়ান এবং একেকটি লেখা একাধিকবার পাঠ করার পর তা পত্রিকার পাতা থেকে কেটে সংরক্ষণ করেন সেসব লেখকের নামধাম, টেলিফোন নম্বর আপনার জানা আছে কি? কিংবা সেসব লেখকের সঙ্গে গত সাত-আট বছরে আপনার কোনো কথাবার্তা হয়েছে কি?
এরপর আপনি টেলিভিশনগুলোর দিকে তাকান। দেখবেন সেখানে টকশোর নামে আপনার লোকজন কী করছে। এক সময় কয়েকটি চ্যানেলের কিছু জনপ্রিয় টকশো আরম্ভ হলে দেশ-বিদেশের বাঙালিরা সব কাজ ফেলে তা দেখতেন। কোনো কোনো অনুষ্ঠানের টিআরপিতে ৫০-৬০ লাখ দর্শকের উপস্থিতির রেকর্ড ছিল। বর্তমানে একমাত্র তৃতীয়মাত্রা ছাড়া কোনো টকশোর দেশ-বিদেশের দর্শক চার-পাঁচ হাজারের বেশি নয়। আপনার অনুগ্রহভাজন ধামাধরা শব্দ ও বাক্য সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দর্শককুল টিভি দেখাই বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আপনার জন্য প্রণীত বন্দনা কেউ দেখে না। আমার বিশ্বাস আপনি নিজেও দেখেন না। আমার অনুরোধ আগামী কিছু দিন নিয়ম করে টকশোগুলো দেখুন এবং ভাবুন বক্তাদের কয়টি কথা আপনার পছন্দ হয়েছে এবং আপনি তাদের বক্তব্যে প্রভাবিত হন কিনা অথবা এসব বক্তা কিংবা বক্তব্য আপনার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা? অন্যথায় বন্ধ করে দিন ওসব ভাঁড়ামি অথবা বন্দনামূলক গীতিনাট্য যা কিনা জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং আপনাকে মানুষের বিরক্তির কারণ বানিয়ে ফেলছে।
শহরের আনাচে-কানাচে যেখানে মানুষের দুর্ভোগ এসে কেন্দ্রীভূত হয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভে দাউ দাউ করে জ্বলছে, যেখানে গভীর রাত পর্যন্ত দুঃসহ যানজট লেগে থাকে। যেখানকার রাস্তা ভেঙে খানাখন্দকে পরিণত হয়েছে এবং যেখানটায় আপনার অনুগ্রহভাজনরা দুর্বৃত্তপনায় জনগণকে অতিষ্ঠ করে ফেলেছে ঠিক সেই জায়গায় বিরাট এক বিলবোর্ডে শান্তির পায়রা হাতে আপনার হাস্যোজ্জ্বল ছবি কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এমনতরো ভাবনা যদি ভাবতে না পারেন তবে আপনি কী করে নিজের প্রতি রহম করলেন? আপনার মনে রাখা উচিত বোকা ও নির্বোধ লোকদের আল্লাহ পছন্দ করেন না। জ্ঞানী, চরিত্রবান এবং প্রজ্ঞাবানদের স্বয়ং আল্লাহ এবং তার রসুল (সা.) মর্যাদা দিয়েছেন। ভুলেও এসব মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ হলো জ্ঞান। কোনো জ্ঞানী তার জ্ঞানকে ফেরি করে বিক্রি করেন না। জ্ঞান হলো সূর্যের আলোর চেয়ে বিভাময় এবং শক্তিশালী। পৃথিবীর কোনো শক্তিমান মানুষ জ্ঞান এবং জ্ঞানীদের বন্দী বা আবদ্ধ করে রাখতে পারেননি। জ্ঞানীরা কারও কাছে যায় না- বরং তাবৎ দুনিয়ার সব বুদ্ধিমান ক্ষমতাবানরা জ্ঞানীর কাছে আশ্রয় নেয়। আলেকজান্ডারের মতো মহাবীর এবং মহান বিজেতা বিজিত রাজ্যের জ্ঞানীদের সন্ধান করতেন এবং তাদের দ্বারে গিয়ে বিদ্যার্থীদের মতো বিনয় ও ভদ্রতা নিয়ে উপস্থিত হতেন।
আপনি নিশ্চয়ই বাইয়াত শব্দটির সঙ্গে পরিচিত আছেন। হাজার বছরের ইতিহাসে সব রাজা, বাদশাহ, সম্রাট এবং খলিফারা সিংহাসনে আরোহণ করেই সাম্রাজ্যের জ্ঞানী-গুণী, অভিজাত, আমির, ওমরাহ, পীর-দরবেশ প্রমুখকে রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কাছ থেকে সমর্থন চাইতেন। সাম্রাজ্যের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিও যদি বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতেন তাহলে বাদশাহ নিজেকে বৈধ মনে করতেন না। অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধ বেঁধে যেত এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়ে যেত। ঢাকা শহরে ১০০ বর্গফুটের ছোট্ট একটি দোকানের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য অনেকগুলো বৈধ দলিল দস্তাবেজের দরকার হয়। একজন নারী কিংবা পুরুষের শরীর ও মনের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য হাজার চেষ্টা-তদবিরের সঙ্গে দরকার পড়ে বৈধ কাবিননামা। কাজেই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড, প্রায় এক লাখ বর্গমাইলের সমুদ্র এবং ১৭ কোটি মানুষের ওপর ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য কি কি বৈধ দলিল ও দস্তাবেজ দরকার তা যদি আপনি না ভাবেন তবে কী করে আপনার প্রতি আপনি রহম করবেন? আপনি যদি মাগুরা মার্কা নির্বাচন, ঢাকার তেজগাঁওয়ের ফালু মার্কা প্রহসন এবং ৫ জানুয়ারির রকিব মার্কা বায়স্কোপকে ক্ষমতার দলিল মনে করেন তবে আমার এ লেখাটি অরণ্যে রোদন বৈ কিছুই যে নয় তা আর কেউ না বুঝলেও আমি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারব। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন