ঢাকা ১১:০৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মক্তব : শিক্ষা ও সভ্যতার ঐতিহ্য

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:২৪:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮
  • ৪৪০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মক্তব শিক্ষার ইতিহাস তালাশ করলে আমরা দেখি, প্রাচীন আরবে সভ্যতা বিস্তারের প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে মক্তব বলা হতো। হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে সর্বপ্রথম বাচ্চাদের জন্য মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। মদিনায় তখন তিনটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমরা বিজিত অঞ্চলে শিক্ষাদীক্ষার প্রতিও মনোযোগ দেন। শাম বিজয়ের পর সেখানে অনেক মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়।

শীতের নরম সকাল। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে সবুজ প্রকৃতি। মুসল্লিরা ফজরের নামাজ পড়ে চাদর জড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরছেন। অনেকে আরামে ঘুমিয়ে আছেন কম্বল মুড়িয়ে। বাতাসে ভাসছে খেজুর রসের মিষ্টি গন্ধ। মসজিদের মাইকে ঘোষণা হলো ‘শান্তিরহাট জামে মসজিদ মক্তবের ছাত্রছাত্রীরা, তোমাদের পড়ার সময় হয়েছে। কায়দা-আমপারা নিয়ে সবাই মক্তবে চলে এসো।’

শুধু শান্তিরহাটে নয়, শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার ভোরে মসজিদের মাইকে এমন ঘোষণা আমি শুনেছি বাংলার নানা প্রান্তে। হেমন্তের মুন্সীগঞ্জে পদ্মার পাড়ে, বর্ষায় রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ের খাঁজে, গ্রীষ্মে যশোরের বাঁওড় পাড়ে, শ্রাবণে লালমনিরহাটের অজপাড়াগাঁয়ে মসজিদের মাইকের আহ্বানে বুকে কায়দা চেপে ঘুমভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে মক্তবে যেতে দেখেছি ছোট ছোট শিশুদের।

আমাদের বাবা-দাদারা যখন ছোট ছিলেন, তারাও শিশুশিক্ষা নিয়েছেন মসজিদভিত্তিক মক্তব থেকে। ভোর হলেই বুকে কায়দা চেপে মক্তবে ছুটে যাওয়ার গল্প শুনি তাদের মুখে। তাদের বাবা-দাদারাও নাকি এমন মক্তবেই পড়েছেন। যখন এ অঞ্চলের মানুষ শিক্ষার খবর জানত না, তখনও মক্তব ছিল। মসজিদের দরিদ্র মুয়াজ্জিন কিংবা বৃদ্ধ ইমাম কখনও কমিটির উদ্যোগে, কখনও নিজের আগ্রহে মক্তব শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলার নিরক্ষরতার হার হ্রাস করে আসছেন।

বঙ্গের ভাগ্যে যখন দারিদ্র্যের অভিশাপ চিরন্তন, মানুষ দুই মুঠো খাবার জোগানোর সন্ধানে মরিয়া, বিস্তার লাভ করেছে শিশুশ্রম, তখন বাংলার ঐতিহ্যের অবৈতনিক মক্তব শিশুদের শিক্ষার আলো দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে কালের বহমান গতিতে। সমাজের বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে শিক্ষা ও সভ্যতাবিষয়ক নিঃস্বার্থ কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনটির নাম মক্তব।

শিশুশিক্ষার ব্যাপারে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, শিশুর মুখে যখন কথা ফুটতে শুরু করবে, তখন প্রথমে তাকে কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ শেখাবে, আর মৃত্যুকালেও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর তালকিন দেবে। কারণ, যার প্রথম বাক্য এবং শেষ বাক্য (মৃত্যুকালে কালেমার ওপর বিশ্বাস অবস্থা) হবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে যদি হাজার বছরও বেঁচে থাকে, তবে তাকে কোনো গোনাহ ও পাপের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না।

মক্তব শিক্ষার ইতিহাস তালাশ করলে আমরা দেখি, প্রাচীন আরবে সভ্যতা বিস্তারের প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে মক্তব বলা হতো। হজরত ওমর (রা.) এর শাসনামলে সর্বপ্রথম বাচ্চাদের জন্য মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। মদিনায় তখন তিনটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমরা বিজিত অঞ্চলে শিক্ষাদীক্ষার প্রতিও মনোযোগ দেন। শাম বিজয়ের পর সেখানে অনেক মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতিহাসে বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকেই এ মক্তবগুলোতে শিক্ষকতা করেছেন।

বিখ্যাত শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফও প্রথম জীবনে এমনই এক মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। কুফায় ইবনে মুজাহিমের মক্তবে তিন হাজার ছাত্র পড়ত। আবুল কাসেম বলখির মক্তবেও তিন হাজার ছাত্র ছিল। তিনি গাধায় চড়ে ছাত্রদের চারপাশে চক্কর দিতেন এবং তাদের দেখাশোনা করতেন। প্রাচীন বিশ্বে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধিতে মৌলিক ভূমিকা রাখে মক্তব শিক্ষা। প্রাচীন এথেন্সের তুলনায় মধ্যযুগের মক্তব শিক্ষার মাধ্যমে স্বাক্ষরতার হার উন্নীত হয়েছিল অনেক। তার পর শিক্ষাস্রোতের গতিবেগ প্রবলের ভূমিকায় উসমানি সাম্রাজ্যের মক্তব শিক্ষাব্যবস্থার স্থান অগ্রগণ্য।

আমাদের উপমহাদেশে সুলতানি ও মুঘল আমলে মক্তব শিক্ষার ভূমি ও খরচ বাবদ ‘মদদই মাশ’ নামে একটি ব্যবস্থা পরিচিত ছিল। সর্ববিদ্যায় পারদর্শী খ্যাত ১১ শতকের মুসলিম দার্শনিক ও চিকিৎসক আবু আলী হোসাইন ইবনে সিনা মক্তব শিক্ষার দুটি স্তরের বিন্যাস দিয়েছেন। একটি প্রাথমিক শিক্ষা, দ্বিতীয়টি মাধ্যমিক। প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর ৬ বছর বয়স থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত। এ স্তরে শিশুকে কোরআন, ইসলামি অধিবিদ্যা, ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামি নীতিবিদ্যা, বিভিন্ন ব্যবহারিক জ্ঞান প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হবে। তারপর দ্বিতীয় স্তরে অর্থাৎ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিশুকে উন্মুক্ত শিক্ষার সুযোগ ও ব্যবস্থা করা উচিত বলে তিনি মনে করতেন। এ সময় একজন শিক্ষার্থী তার পছন্দের বিষয় বেছে নিয়ে পাঠে মনোনিবেশ করার পক্ষে লিখেছিলেন ইবনে সিনা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মক্তব শিক্ষার ধারণা ও পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে। আমাদের উপমহাদেশে বর্তমানে মক্তব শিক্ষার পাশাপাশি পবিত্র কোরআন হিফজ করার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজ আমলে যখন এ অঞ্চলে ‘দরসে নেজামি’ নামের শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয় এবং ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে, মক্তব শিক্ষাও সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

মক্তবে শিশুদের কী শেখানো হবে? এ বিষয়ে হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা নিজ নিজ সন্তানদের তিনটি স্বভাবের অনুসারী করে গড়ে তোলো।

১. তাদের নবী (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা শিক্ষা দাও।

২. নবী (সা.) এর বংশধরদের প্রতি ভালোবাসা শিক্ষা দাও।

৩. তাদের মধ্যে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলো। কারণ, পবিত্র কোরআনের ধারক ও বাহকরাই সেদিন আম্বিয়া কেরাম এবং সাধু-সজ্জনদের সঙ্গে আরশের ছায়ায় অবস্থান করবে, যেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। (তিবরানি)।

আমাদের দেশে এখনকার মক্তবে কোরআন শরিফ পড়তে শেখানো হয়, পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয় উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়ার প্রতি। এ ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় আমল যেমন নামাজ শিক্ষা, মাসনুন দোয়া মুখস্থকরণ ও চল্লিশ হাদিস মুখস্থকরণ প্রভৃতি শিক্ষার পাশাপাশি আরবি ও মাতৃভাষায় হাতের লেখার প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়। নীতিজ্ঞান, আদব ও ভদ্রতা শিক্ষা মক্তব পদ্ধতির বিশেষ ভূষণ। রাসুল (সা.) বলেন, কোনো বাবা তার সন্তানকে এর থেকে উত্তম উপঢৌকন প্রদান করতে পারেন না, তিনি তাকে যে উত্তম শিক্ষা প্রদান করেন। (তিরমিজি)।

সারাদেশে শুধু ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক মিশন বিভাগের মাধ্যমে ৪০টি মিশন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ৩৮০টি মক্তব শিক্ষাকেন্দ্র চালু আছে। এ মক্তব শিক্ষাকেন্দ্রে গড়ে ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি প্রায় ১২০ জন। এছাড়াও সারা দেশে বিভিন্ন মাদ্রাসাভিত্তিক মক্তব, মসজিদভিত্তিক মক্তব ও শিক্ষক বৃত্তায়ন মক্তবের সংখ্যা অফুরন্ত।

আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা ও সভ্যতা বিস্তারের মক্তব শিক্ষা কেমন চলছে জানতে চাইলে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানার ওয়াসেকপুর শান্তিরহাট মসজিদভিত্তিক মক্তবের প্রবীণ শিক্ষক মৌলভি দেলোয়ার হুসাইন বলেন, ‘এ শিক্ষা আগের মতো প্রাণবন্ত নেই। আগে শিশু-কিশোররা ফজরের পরেই কায়দা নিয়ে মক্তবে হাজির হতো, এখন ওই সময় তাদের হাজিরা দিতে হয় কিন্ডারগার্টেনে।

শহর কিংবা গ্রাম পুরো দেশের এখন এই চিত্র। এ সমস্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন জায়গায় ‘বৈকালিক মক্তব’ নাম দিয়ে সকালে পড়তে না পারা শিশুদের পড়ানো হয়। এতে তাদের খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় ব্যাঘাত ঘটে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই আন-রেজিস্টার্ড এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি রুটিনের আওতায় আনা হোক। মক্তব শিক্ষার ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা সরকারের পদক্ষেপ জরুরি মনে করি।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

মক্তব : শিক্ষা ও সভ্যতার ঐতিহ্য

আপডেট টাইম : ০৫:২৪:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মক্তব শিক্ষার ইতিহাস তালাশ করলে আমরা দেখি, প্রাচীন আরবে সভ্যতা বিস্তারের প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে মক্তব বলা হতো। হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে সর্বপ্রথম বাচ্চাদের জন্য মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। মদিনায় তখন তিনটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমরা বিজিত অঞ্চলে শিক্ষাদীক্ষার প্রতিও মনোযোগ দেন। শাম বিজয়ের পর সেখানে অনেক মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়।

শীতের নরম সকাল। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে সবুজ প্রকৃতি। মুসল্লিরা ফজরের নামাজ পড়ে চাদর জড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরছেন। অনেকে আরামে ঘুমিয়ে আছেন কম্বল মুড়িয়ে। বাতাসে ভাসছে খেজুর রসের মিষ্টি গন্ধ। মসজিদের মাইকে ঘোষণা হলো ‘শান্তিরহাট জামে মসজিদ মক্তবের ছাত্রছাত্রীরা, তোমাদের পড়ার সময় হয়েছে। কায়দা-আমপারা নিয়ে সবাই মক্তবে চলে এসো।’

শুধু শান্তিরহাটে নয়, শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার ভোরে মসজিদের মাইকে এমন ঘোষণা আমি শুনেছি বাংলার নানা প্রান্তে। হেমন্তের মুন্সীগঞ্জে পদ্মার পাড়ে, বর্ষায় রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ের খাঁজে, গ্রীষ্মে যশোরের বাঁওড় পাড়ে, শ্রাবণে লালমনিরহাটের অজপাড়াগাঁয়ে মসজিদের মাইকের আহ্বানে বুকে কায়দা চেপে ঘুমভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে মক্তবে যেতে দেখেছি ছোট ছোট শিশুদের।

আমাদের বাবা-দাদারা যখন ছোট ছিলেন, তারাও শিশুশিক্ষা নিয়েছেন মসজিদভিত্তিক মক্তব থেকে। ভোর হলেই বুকে কায়দা চেপে মক্তবে ছুটে যাওয়ার গল্প শুনি তাদের মুখে। তাদের বাবা-দাদারাও নাকি এমন মক্তবেই পড়েছেন। যখন এ অঞ্চলের মানুষ শিক্ষার খবর জানত না, তখনও মক্তব ছিল। মসজিদের দরিদ্র মুয়াজ্জিন কিংবা বৃদ্ধ ইমাম কখনও কমিটির উদ্যোগে, কখনও নিজের আগ্রহে মক্তব শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলার নিরক্ষরতার হার হ্রাস করে আসছেন।

বঙ্গের ভাগ্যে যখন দারিদ্র্যের অভিশাপ চিরন্তন, মানুষ দুই মুঠো খাবার জোগানোর সন্ধানে মরিয়া, বিস্তার লাভ করেছে শিশুশ্রম, তখন বাংলার ঐতিহ্যের অবৈতনিক মক্তব শিশুদের শিক্ষার আলো দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে কালের বহমান গতিতে। সমাজের বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে শিক্ষা ও সভ্যতাবিষয়ক নিঃস্বার্থ কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনটির নাম মক্তব।

শিশুশিক্ষার ব্যাপারে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেন, শিশুর মুখে যখন কথা ফুটতে শুরু করবে, তখন প্রথমে তাকে কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ শেখাবে, আর মৃত্যুকালেও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর তালকিন দেবে। কারণ, যার প্রথম বাক্য এবং শেষ বাক্য (মৃত্যুকালে কালেমার ওপর বিশ্বাস অবস্থা) হবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে যদি হাজার বছরও বেঁচে থাকে, তবে তাকে কোনো গোনাহ ও পাপের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না।

মক্তব শিক্ষার ইতিহাস তালাশ করলে আমরা দেখি, প্রাচীন আরবে সভ্যতা বিস্তারের প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে মক্তব বলা হতো। হজরত ওমর (রা.) এর শাসনামলে সর্বপ্রথম বাচ্চাদের জন্য মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। মদিনায় তখন তিনটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমরা বিজিত অঞ্চলে শিক্ষাদীক্ষার প্রতিও মনোযোগ দেন। শাম বিজয়ের পর সেখানে অনেক মক্তব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতিহাসে বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনেকেই এ মক্তবগুলোতে শিক্ষকতা করেছেন।

বিখ্যাত শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফও প্রথম জীবনে এমনই এক মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। কুফায় ইবনে মুজাহিমের মক্তবে তিন হাজার ছাত্র পড়ত। আবুল কাসেম বলখির মক্তবেও তিন হাজার ছাত্র ছিল। তিনি গাধায় চড়ে ছাত্রদের চারপাশে চক্কর দিতেন এবং তাদের দেখাশোনা করতেন। প্রাচীন বিশ্বে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধিতে মৌলিক ভূমিকা রাখে মক্তব শিক্ষা। প্রাচীন এথেন্সের তুলনায় মধ্যযুগের মক্তব শিক্ষার মাধ্যমে স্বাক্ষরতার হার উন্নীত হয়েছিল অনেক। তার পর শিক্ষাস্রোতের গতিবেগ প্রবলের ভূমিকায় উসমানি সাম্রাজ্যের মক্তব শিক্ষাব্যবস্থার স্থান অগ্রগণ্য।

আমাদের উপমহাদেশে সুলতানি ও মুঘল আমলে মক্তব শিক্ষার ভূমি ও খরচ বাবদ ‘মদদই মাশ’ নামে একটি ব্যবস্থা পরিচিত ছিল। সর্ববিদ্যায় পারদর্শী খ্যাত ১১ শতকের মুসলিম দার্শনিক ও চিকিৎসক আবু আলী হোসাইন ইবনে সিনা মক্তব শিক্ষার দুটি স্তরের বিন্যাস দিয়েছেন। একটি প্রাথমিক শিক্ষা, দ্বিতীয়টি মাধ্যমিক। প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর ৬ বছর বয়স থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত। এ স্তরে শিশুকে কোরআন, ইসলামি অধিবিদ্যা, ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামি নীতিবিদ্যা, বিভিন্ন ব্যবহারিক জ্ঞান প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হবে। তারপর দ্বিতীয় স্তরে অর্থাৎ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিশুকে উন্মুক্ত শিক্ষার সুযোগ ও ব্যবস্থা করা উচিত বলে তিনি মনে করতেন। এ সময় একজন শিক্ষার্থী তার পছন্দের বিষয় বেছে নিয়ে পাঠে মনোনিবেশ করার পক্ষে লিখেছিলেন ইবনে সিনা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মক্তব শিক্ষার ধারণা ও পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে। আমাদের উপমহাদেশে বর্তমানে মক্তব শিক্ষার পাশাপাশি পবিত্র কোরআন হিফজ করার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইংরেজ আমলে যখন এ অঞ্চলে ‘দরসে নেজামি’ নামের শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয় এবং ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে, মক্তব শিক্ষাও সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

মক্তবে শিশুদের কী শেখানো হবে? এ বিষয়ে হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা নিজ নিজ সন্তানদের তিনটি স্বভাবের অনুসারী করে গড়ে তোলো।

১. তাদের নবী (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা শিক্ষা দাও।

২. নবী (সা.) এর বংশধরদের প্রতি ভালোবাসা শিক্ষা দাও।

৩. তাদের মধ্যে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলো। কারণ, পবিত্র কোরআনের ধারক ও বাহকরাই সেদিন আম্বিয়া কেরাম এবং সাধু-সজ্জনদের সঙ্গে আরশের ছায়ায় অবস্থান করবে, যেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। (তিবরানি)।

আমাদের দেশে এখনকার মক্তবে কোরআন শরিফ পড়তে শেখানো হয়, পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয় উচ্চারণ শুদ্ধ হওয়ার প্রতি। এ ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় আমল যেমন নামাজ শিক্ষা, মাসনুন দোয়া মুখস্থকরণ ও চল্লিশ হাদিস মুখস্থকরণ প্রভৃতি শিক্ষার পাশাপাশি আরবি ও মাতৃভাষায় হাতের লেখার প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়। নীতিজ্ঞান, আদব ও ভদ্রতা শিক্ষা মক্তব পদ্ধতির বিশেষ ভূষণ। রাসুল (সা.) বলেন, কোনো বাবা তার সন্তানকে এর থেকে উত্তম উপঢৌকন প্রদান করতে পারেন না, তিনি তাকে যে উত্তম শিক্ষা প্রদান করেন। (তিরমিজি)।

সারাদেশে শুধু ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক মিশন বিভাগের মাধ্যমে ৪০টি মিশন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ৩৮০টি মক্তব শিক্ষাকেন্দ্র চালু আছে। এ মক্তব শিক্ষাকেন্দ্রে গড়ে ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি প্রায় ১২০ জন। এছাড়াও সারা দেশে বিভিন্ন মাদ্রাসাভিত্তিক মক্তব, মসজিদভিত্তিক মক্তব ও শিক্ষক বৃত্তায়ন মক্তবের সংখ্যা অফুরন্ত।

আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা ও সভ্যতা বিস্তারের মক্তব শিক্ষা কেমন চলছে জানতে চাইলে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী থানার ওয়াসেকপুর শান্তিরহাট মসজিদভিত্তিক মক্তবের প্রবীণ শিক্ষক মৌলভি দেলোয়ার হুসাইন বলেন, ‘এ শিক্ষা আগের মতো প্রাণবন্ত নেই। আগে শিশু-কিশোররা ফজরের পরেই কায়দা নিয়ে মক্তবে হাজির হতো, এখন ওই সময় তাদের হাজিরা দিতে হয় কিন্ডারগার্টেনে।

শহর কিংবা গ্রাম পুরো দেশের এখন এই চিত্র। এ সমস্যা মোকাবিলায় বিভিন্ন জায়গায় ‘বৈকালিক মক্তব’ নাম দিয়ে সকালে পড়তে না পারা শিশুদের পড়ানো হয়। এতে তাদের খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় ব্যাঘাত ঘটে। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই আন-রেজিস্টার্ড এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি রুটিনের আওতায় আনা হোক। মক্তব শিক্ষার ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা সরকারের পদক্ষেপ জরুরি মনে করি।’