যমুনা নদীর অব্যাহত ভাঙন রোধে প্রতিবছরই বালুর বস্তা ডাম্পিং ও সিসি ব্লক ফেলার নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা রোধসহ নদীতে ড্রেজিং করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যমুনার বামতীরে (পূর্ব তীর) দুই যুগ ধরে ভয়াবহ নদীভাঙন চলছে। এতে ইসলামপুরের উলিয়া ও গুঠাইল এলাকার পশ্চিমে প্রায় ১৩ কিলোমিটার প্রশস্তের যমুনায় নদীর পর চর আর চরের পর অসংখ্য ছোট-বড় নদী সৃষ্টি হয়েছে। গত দুই যুগে যমুনার ভয়াবহ ভাঙনে ইসলামপুরের সাপধরী ইউনিয়নটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ওই ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ নিঃস্ব হয়ে এখন যমুনার বুকে জেগে ওঠা নতুন চরে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া নদীভাঙনের শিকার হয়েছে ইসলামপুরের পাথর্শী, কুলকান্দি, নোয়ারপাড়া, বেলগাছা ও চিনাডুলি ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। তাদের বসতভিটা, বিস্তীর্ণ ফসলি জমিসহ ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজারসহ বহু রাস্তাঘাট নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীভাঙনের শিকার ওই ভূমিহীন মানুষগুলো যমুনার চর বা বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও যমুনার চরাঞ্চলে খুপরি বেঁধে জীবন যাপন করছে। অনেকেই এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে দেশের বিভিন্ন শহরের বস্তিগুলোতে।
সরেজমিন ঘুরে আরো জানা গেছে, নদীভাঙন ঠেকাতে ১৯৯৫ সালে ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনার বামতীরে ইসলামপুরের কুলকান্দি পয়েন্টে কুলকান্দি রিভেটমেন্ট টেস্ট স্ট্রাকচার নির্মাণ করা হয়। কয়েক বছর পর ইসলামপুরের গুঠাইল বাজার এলাকায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে হার্ডপয়েন্ট নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া যমুনার ভাঙন রোধে ইসলামপুরের উলিয়া বাজার এলাকায় ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ ও ইসলামপুরের নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের হাড়গিলা এলাকায় নদীতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। সর্বশেষ যমুনার বামতীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় জামালপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চার বছর ধরে নদীতে বালুর বস্তা ডাম্পিং ও সিসি ব্লক ফেলছে। এ ডাম্পিং কার্যক্রম নদীভাঙন ঠেকাতে শুধু ব্যর্থই হয়নি, উল্টো বিগত দিনে নির্মাণ করা কংক্রিটের বাঁধগুলোও নদীভাঙন থেকে রক্ষা করতে পারেনি।
ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম জানান, আগামী শুষ্ক মৌসুমে যমুনার ভাঙন রোধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় শিগগিরই ইসলামপুরের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী গুঠাইল হাটবাজার, গুঠাইল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গুঠাইল সিনিয়র মাদ্রাসাসহ আশপাশের দুই সহস্রাধিক বসতভিটা ও বহু ফসলি জমি যমুনাগর্ভে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ইসলামপুরের সাপধরী ইউনিয়নের নদীভাঙনের শিকার অসহায় কৃষক আনছার আলী, আজহার মণ্ডল, কমল প্রামাণিক, হেলাল উদ্দিন, মোকারম হোসেনসহ ইসলামপুরের কুলকান্দি, সাপধরী, নোয়ারপাড়া, বেলগাছা ও চিনাডুলি ইউনিয়নের শত শত কৃষকের অভিযোগ, যমুনায় অপরিকল্পিতভাবে বালুর বস্তা ডাম্পিংয়ের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা অপচয় করছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
ইসলামপুরের কুলকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জুবাইদুর রহমান দুলাল আক্ষেপ করে বলেন, যমুনায় বালুর বস্তা ফেলে কী হবে? নদীভাঙন তো থামছে না। আগের বছর বস্তা ফেললে পরের বছরই তার চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। প্রায় ১৫ বছর ধরে যমুনার বামতীরে বালুর বস্তা ডাম্পিং করা হচ্ছে। আবার নদীর তীর থেকে অবৈধভাবে বালু তোলারও মহোৎসব চলছে। যমুনায় বালুর বস্তা ফেলে কেবল অফিসার আর ঠিকাদারদের পেট ভরানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যমুনার মূল স্রোতের লাইনে জেগে ওঠা নতুন চরগুলো অপসারণের পাশাপাশি নদীর গভীরতা ঠিক রাখতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে। আর শুষ্ক মৌসুমে যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলা বন্ধ করতে হবে।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী জানান, যমুনা তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দেওয়ানগঞ্জের ফুটানী বাজার, ইসলামপুরের পশ্চিম বামনা ও শিংভাঙ্গা এলাকায় যমুনার বামতীরে বালুর বস্তা ডাম্পিং ও ব্লক সেটিং চলছে। যমুনা নদীর ভাঙন রোধে বালুর বস্তা ডাম্পিং ও ব্লক সেটিং পাউবোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা নয়। তবে ডাম্পিং পয়েন্টের উজানে কোনো প্রটেকশন না থাকায় ইসলামপুরের গুঠাইল ও কদমতলী এলাকায় ডাম্পিং করা বালুর বস্তা গত বন্যায় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ইসলামপুরের উলিয়া, চিনাডুলি, গুঠাইল ও বেলগাছা এলাকায় যমুনার ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে।