হাওর বার্তা ডেস্কঃ সারা পৃথিবীতে পরিবেশ সংকট নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে। প্রচেষ্টা জোরদার হচ্ছে পরিবেশ সংকট দূর করার জন্য। পরিবেশ সংকট নিছক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহারজনিত ফসল নয়। পরিবেশ সংকটের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাস, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও জীবন দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয় রোধকল্পে দুটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। প্রথমত, প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে তার ঘনিষ্ঠ বিষয়ে ইসলামের ধারণা প্রচার। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক বিষয়ে ইসলামি শিক্ষার মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের আলোকে নৈতিক আচরণ এবং এর বাস্তব প্রয়োগ।
মানুষের জীবন প্রবাহ বিকাশের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সম্মিলিত অবস্থা ও পারস্পরিক সম্পর্ককে পরিবেশ বলে। পরিবেশের সব উপাদানের মধ্যে একটা গভীর আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান, যা পরস্পরকে প্রভাবিত করে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশের উপাদানকে বাহ্যিক, জৈবিক ও সামাজিক উপাদান হিসেবে ভাগ করা হয়। যেমন বায়ু, আলো, পানি ও মাটি বাহ্যিক উপাদান আর মানুষ, বৃক্ষ, জীবজন্তু, জৈবিক এবং জনসংখ্যা সামাজিক উপাদানের অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশের সব উপাদান একটি অপরের সম্পূরক হিসেবে বিবেচিত হয়।
পরিবেশের বাহ্যিক উপাদানগুলোর মধ্যে বায়ু, পানি ও আলো অন্যতম। রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তারা কী দেখে না যে, আমি রাত্রি সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে করেছি আলোকময়। নিশ্চয় এতে ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ (সূরা নামল : ৮৬)। কোরআনে বিশুদ্ধ বায়ুপ্রবাহকে বৃষ্টির বার্তাবাহক ও মন প্রফুল্ল হওয়ার নিয়ামক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে মসজিদ ও জনসমাজে সুগন্ধি ব্যবহার ও পরিপাটি পোশাক পরিধানের নির্দেশ প্রদান করেছে।
পরিবেশের অপর উপাদান পানি। যে ক’টি নেয়ামত ছাড়া এ ভূম-ল অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারে, সেগুলোর মধ্যে পানি অন্যতম। আল্লাহ তার এসব নেয়ামতের অপচয় করা থেকে আমাদের নিষেধ করেছেন। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমাদের দেশ এবং বর্তমান পৃথিবীর গবেষকরা সুপেয় পানির ক্রমবর্ধমান অভাব এবং দূষিত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কিত, অথচ এসবের মূলে রয়েছে দৈনন্দিন জীবনে পানি ব্যবহারে আমাদেরই অপচয় এবং উদাসীনতা। বর্তমান পৃথিবীতে পানির জন্য হাহাকার তো আমাদেরই কর্মফল।
পানি একদিকে যেমন জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে পানি জীবন ধ্বংস হওয়ার কারণ। পানিদূষণের মাধ্যমে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাকটেরিয়া, ধাতবজাতীয় পদার্থ, কীটনাশক ইত্যাদি মিশ্রিত হয়ে পানি দূষিত হয়। দূষিত পানির কারণে কিছু পানিবাহিত রোগ দেখা দিচ্ছে। অতএব, আমাদের উচিত পানিকে দূষণমুক্ত রাখা এবং পানির অপচয় রোধ করা। পানির পাশাপাশি আরও যত প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, সবকিছুর যথাযথ ব্যবহার, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করে আমরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি। পানি দূষণমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে একটি নিয়ামক সামাজিক চেতনা হলো পানির পবিত্রতার চেতনা। দৈনন্দিন ওজু ও গোসলের জন্য ইসলামের এ বিধান আমাদের মাঝে এ চেতনাকে সর্বজনীনভাবে লালন করে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করলে মানব সভ্যতায় নেমে আসবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ মর্মে রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে জল ও স্থলে বিপর্যয় ঘটেছে।’ (সূরা রুম : ৪১)। পবিত্রতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যতীত সুন্দর পরিবেশ কল্পনা করা যায় না। রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্রকে পছন্দ করেন; আল্লাহ পরিচ্ছন্ন, তিনি পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন; আল্লাহ মহৎ, তিনি মহত্ত্ব পছন্দ করেন; আল্লাহ বদান্য, তিনি বদান্যতা পছন্দ করেন। অতএব, তোমরা তোমাদের (ঘরের) উঠানগুলো পরিচ্ছন্ন রাখো।’ (তিরমিজি : ২৭৯৯)। প্রিয়নবী (সা.) আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র, তিনি পবিত্রতাকে ভালোবাসেন।’ এছাড়া কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদেরও ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা : ২২২)।
পরিবেশের সঙ্গে মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সে ক্ষেত্রে এ দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ আল্লাহকে খুশি করার জন্য যাবতীয় কার্যাদি পরিচালিত করবে। উপার্জনও করবে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। তাই প্রকৃতি বা বিশ্বময় বিদ্যমান সব সম্পদ মানুষের অধীন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমরা কি দেখ না? কীভাবে পৃথিবীর সবকিছু আল্লাহ তোমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন।’ (সূরা হজ : ৬৫)। এ প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ইসলামের দৃষ্টিতে সীমিত পর্যায়ে মানুষকে পরিবেশের ওপর হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের প্রতি শুধু দায়িত্ব পালন করলে চলবে না, বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণ থেকে বিরত থাকতে এবং গাছপালা, জীবজন্তুর প্রতিও সদয় ব্যবহার করতে হবে।
আল্লাহ বা তার সৃষ্টির প্রতি অবিচার আর নির্যাতনের বিনিময়ে মানুষকে গৌরবান্বিত করার প্রবণতাকে ইসলাম সমর্থন করে না। পরিবেশের বিপর্যয় কেবল শিল্পোন্নত বা পাশ্চাত্যের সমস্যা নয়, তা সমগ্র পৃথিবীর জন্য এক মহাসমস্যা। গোটা পৃথিবীকে এর জন্য সচেতন হতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ইসলামের অনুসারীদের অধিকতর দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণে ইসলামের শিক্ষা সবার সামনে উপস্থাপন করতে হবে। তাহলেই আমরা পাব আদর্শ এক সমাজ, দূষণমুক্ত নগরী।