হাওর বার্তা ডেস্কঃ সদ্য সমাপ্ত সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে জামায়াতকে ‘ছাড়’ দিয়েই আওয়ামী লীগ পিছলে পিছিয়ে গেছে। পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মামলার শিকার হওয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়াটাও তাদের পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ। সিসিক নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত হওয়ার পর এমনই বক্তব্য সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে নির্বাচন বিশ্লেষকদেরও।
দলীয় প্রতীকে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন। স্থানীয় নির্বাচন হলেও ছিল সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বছরে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ। আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের হাতে দলীয় প্রতীক তুলে দিয়ে সবাইকে নৌকার বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নৌকা প্রতীক হাতে নিয়ে সিলেটে ফেরার পর থেকে নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত উজ্জীবিত ছিলেন নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। নৌকার পক্ষে নেতাকর্মী-সমর্থকদেরও ছিল জোর প্রচার-প্রচারণা।
অন্যদিকে নৌকা প্রতীক নিয়ে কামরান যখন মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন, তখনও বিএনপি দলীয় প্রতীক পাওয়া নিয়ে দোদুল্যমান সদ্য সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রচারণায় ছিলেন পিছিয়ে। পাশাপাশি বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় এবং নিজেদের সক্ষমতার জানান দিতে জোট থেকে বেরিয়ে প্রার্থী দেয় জামায়াত। সব মিলিয়ে অনেকটা বেকায়দায় ছিলেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী। শেষতক কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রণেভঙ্গ দিলে যদিও কিছুটা হাফছেড়ে বাঁচেন আরিফুল হক চৌধুরী।
প্রচার-প্রচারণায় প্রাধান্য পায় উন্নয়ন বনাম ব্যক্তি ইমেজ নিয়ে বাকযুদ্ধ। প্রার্থীদের পক্ষে নেতা-কর্মী-সমর্থকরা ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে যান। শেষ পর্যন্ত গত সোমবার (৩০ জুলাই) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৩৪টির মধ্যে ১৩২টি কেন্দ্রের ফলাফলে দেখা যায়, নৌকা প্রতীকের কামরান পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট। আর ধানের শীষ প্রতীকে আরিফুল হক চৌধুরী পেয়েছেন ৯০ হাজার ৪৯৬ ভোট পান। স্থগিত দুই কেন্দ্র ছাড়া প্রাপ্ত কেন্দ্রের ফলাফলে কামরানের চেয়ে ৪ হাজার ৬২৬ ভোটে এগিয়ে গেছেন আরিফ।
ভোটের দিন বড় ধরনের কোনো সংঘাত, সংঘর্ষ না হলেও কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোট জালিয়াতির নানা অভিযোগ ছিল ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নৌকা প্রতীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরও ফলাফলে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের পিছিয়ে পড়া অনেকটা ভাবিয়ে তুলেছে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের। হিসাবে বসতে হচ্ছে নির্বাচন বিশ্লেষকদেরও।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতের প্রার্থী অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দেখে আশীর্বাদ হিসেবে নেয় আওয়ামী লীগ। আর ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় দলে দলে নগর চষে বেড়িয়েছেন জুবায়ের।
দাগী জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা আচরণবিধি ভেঙে শোডাউন করেছে। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটালেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বিষয়টি আওয়ামী লীগ দেখেও না দেখার ভান করলেও দৃষ্টি এড়ায়নি নগরবাসীর। ভোটাররা নেতিবাচকভাবে নিয়ে ব্যালটের মাধ্যমে জবাব দিয়েছেন এই ‘আড়াল-সন্ধির’।
এদিকে, জোটের শরিক জামায়াতের প্রার্থী নিয়ে মোটেই শংকিত দেখা যায়নি বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীকে। তিনি বারবার বলেছিলেন, ভোটের জোয়ারে সব যড়যন্ত্রই ভেসে যাবে। জামায়াত বিএনপির সঙ্গে না থাকলে সংখ্যালঘু ভোট আরিফের বাকসে আসবে, এমনটি চেয়েছিল বিএনপিও।
পর্যবেক্ষদের মতে, নির্বাচন ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জামায়াতের প্রতি সদয় এবং বিএনপির প্রতি নির্দয় থাকতে দেখা গেছে। যে কারণে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও তাদের গ্রেফতার কামরানের বিপক্ষে জনসমর্থন তৈরিতে সহায়ক ছিল।
আর যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াতের ক্যাডারদের নগরে শোডাউন দেখে ভোটের দিন সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন নগরের বাসিন্দারা। ফলে প্রায় সোয়া লাখ ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। এসব কারণে নিরপেক্ষ ভোটাররা প্রতিবাদ স্বরূপ নৌকার বিপক্ষে গিয়ে আরিফকে সমর্থন দেন। যা ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয়ে প্রভাব ফেলে।
এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ বলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রকাশ্যে না হলেও অভ্যন্তরীণ ভাঙন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি এবং জামায়াতকে সুযোগ করে দেওয়া ভালভাবে নেননি সচেতন নগরবাসী। জামায়াতের দাগী মামলার আসামিরা সবাই আচরণেবিধি ভেঙে শোডাউন করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে নিরপেক্ষ ভোটাররা ব্যালটের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে অন্তত ২ লাখ ভোট কাস্ট না হওয়ায় ফলাফল সঠিক হয়েছে বলা যায় না। এছাড়া আওয়ামী লীগ নৌকায় ঐক্যবদ্ধ দেখালেও কামরানকে মনপ্রাণ দিয়ে সমর্থন না করাও ছিল ভোটে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।
সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সুব্রত চক্রবর্তী জুয়েল বলেন, দৃশ্যমান উন্নয়ন করলে মানুষ মনে রাখে। যে কারণে সরকার বরাদ্দ দিলেও উন্নয়ন করেছেন আরিফ। এক্ষেত্রে মানুষ বিএনপিকে নয়, ব্যক্তি আরিফকে বেছে নিয়েছে।
তিনি বলেন, জামায়াতকে ছাড় দেওয়ায় মানুষের মনে ধারণা জন্মে যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্ত দলটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গেছে। এ কারণে সংখ্যালঘু ভোটও অনেকটা আরিফের দিকে গেছে। তবে দলের কর্মী-সমর্থকদের তৎপরতায়ই কামরান এতো ভোট পেয়েছেন মনে করেন তিনি।
নগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, আরিফুল হক চৌধুরী নগরের উন্নয়নে শ্রম দিয়েছেন। তার উন্নয়েনে জনপ্রিয়তায় বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌকা প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ সাংবাদিকদের জানান, আরিফের বিজয় ও কামরানের পরাজয়কে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে দেখছেন তারা।
মিসবাহ উদ্দিন আরও বলেন, দলের প্রার্থীকে জেতাতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। তবে ভোটে সাধারণ মানুষের মতামতের প্রতিই শ্রদ্ধা রয়েছে আমাদের।