আল্লাহর সমীপে নবীদের আদব

হাওর বার্তা ডেস্কঃ হজরত ইবরাহিম (আ.) আপন মূর্তিপূজারি সম্প্রদায়কে একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানালেন এবং নিজ প্রভুর পরিচয় পেশ করলেন এভাবে ‘তিনি হচ্ছেন সেই প্রভু যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। আর তিনিই খাওয়ান ও পান করান। এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আরোগ্য দান করেন।’ (সূরা আশ-শুয়ারা : ৭৮-৮০)। সুবহানাল্লাহ! কত আদবপূর্ণ বক্তব্য। এতে কত সূক্ষ্মতা, দূরদর্শিতা, বিনয় ও নম্রতা বিদ্যমান।

হজরত নুহ (আ.) নিজ সম্প্রদায়কে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসার জন্য সাড়ে ৯০০ বছর পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু তার জাতি পথভ্রষ্টতা, সীমালঙ্ঘন, বেআদবি ও নাফরমানিতে অবিচল থাকে। যেমনটি মহান আল্লাহ এরশাদ করছেন, ‘নিশ্চিত তারা ছিল অন্ধ (অন্তরচক্ষু/বিবেক-চক্ষুহীন) জাতি-সম্প্রদায়।’ সুরা-আরাফ : ৬৪)।

একদা তার স্বীয় জাতির সীমালঙ্ঘন ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হজরত নুহ (আ.) প্রার্থনা করলেন, ‘হে প্রভু! এসব কাফের-অবিশ্বাসীদের একটি গৃহও যেন ধরাপৃষ্ঠে অবশিষ্ট না থাকে।’ (সূরা নূহ : ২৬)। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর প্রার্থনা কবুল করে ওহি অবতীর্ণ করলেন, তুমি নৌকা প্রস্তুত করো! অচিরেই ঝড়-বন্যা এসে পড়বে। তোমাকে ও তোমার পরিবারের সদস্যদের বাঁচানো হবে এবং কাফেরদের নাম-চিহ্ন মিটিয়ে দেওয়া হবে। হজরত নুহ (আ.) একটি নৌকা বানালেন এবং লোকজনকে তাতে আরোহণ করালেন। তার এক ছেলে অবাধ্য ছিল। সে নৌকায় উঠতে অস্বীকার করল। হজরত নুহ (আ.) বারবার তাকে বোঝালেন; কিন্তু সে তার হঠকারিতায় অনড় রইলো; শেষ পর্যন্ত মহাপ্লাবনে ডুবে যাবে এমন অবস্থায় তিনি পিতৃস্নেহ মমতার আবেগে প্রার্থনা করেন, ‘হে প্রভু! আমার ছেলে তো আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আর আপনার ওয়াদা তো অবশ্যই সত্য এবং আপনি তো বিচারকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক।’ (সূরা হুদ : ৪৫)।

ওই প্রার্থনার প্রতিটি শব্দই মহান আল্লাহর মহা দরবারের আদবের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চিন্তা করুন! হজরত নুহ (আ.) এমনটি বলেননি, ‘হে আল্লাহ আমার ছেলে ডুবে গেল! অথচ আপনার অঙ্গীকার পূর্ণ হলো না।’ তারপরও আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করলেন, ‘হে নুহ! সে তোমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়। সে অবশ্যই অসৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই সে বিষয়ে আমাকে অনুরোধ করবে না। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, তুমি যেন অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত না হও।’ (প্রাগুক্ত-৪৬)।

হজরত নুহ (আ.) আল্লাহ তায়ালার ওই সতর্কবাণীতে ভয়ে কম্পমান হলেন এবং নিবেদন করলেন, ‘হে আমার রব! যে-বিষয়ে আমার জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে যাতে আপনাকে অনুরোধ না করি, এ জন্য আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’ (প্রাগুক্ত-৪৭)।

আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী (রহ.) আয়াতটির তাফসিরে এভাবে লিখছেন, ‘হজরত নুহ (আ.) কেঁপে উঠলেন এবং তওবা করলেন। এমনটি বললেন না যে, পুনরায় এমনটি করব না, কারণ তাতে দাবি করা প্রকাশ পায়। বান্দার কী ক্ষমতা আছে! সমীচীন হচ্ছে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করা যে, আমার দ্বারা যেন তেমনটি সংঘটিত না হয় এবং তেমনটি না করার সংকল্প অন্তরে থাকা চাই। হজরত আদম (আ.) ও হজরত ইউনুস (আ.) এর তওবার যে বাক্য পবিত্র কোরআনে উদ্ধৃত হয়েছে তাতেও এই একই আদব রক্ষিত হয়েছে।’ হজরত ইবরাহিম (আ.) এর উদাহরণ

হজরত ইবরাহিম (আ.) আপন মূর্তিপূজারি সম্প্রদায়কে একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানালেন এবং নিজ প্রভুর পরিচয় পেশ করলেন এভাবে ‘তিনি হচ্ছেন সেই প্রভু যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনিই আমাকে হেদায়েত দিয়েছেন। আর তিনিই খাওয়ান ও পান করান। এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আরোগ্য দান করেন।’ (সূরা আশ-শুয়ারা : ৭৮-৮০)।

সুবহানাল্লাহ! কত আদবপূর্ণ বক্তব্য। এতে কত সূক্ষ্মতা, দূরদর্শিতা, বিনয় ও নম্রতা বিদ্যমান। সবগুলো গুণের সংশ্লিষ্টতা আল্লাহর প্রতি নিবেদন করা হলো, সৃষ্টি করা, হেদায়েত দান, পানাহার করানো ও আরোগ্যদান করা। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নিজের শারীরিক রোগকে নিজের প্রতি সম্পৃক্ত করেছেন। যদিও রোগ-বালাইও আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসে থাকে; কিন্তু বাহ্যিকভাবে রোগকে একটা দোষ বা ত্রুটি হিসেবে দেখা হয় বিধায় সেটির সম্পৃক্ততা আল্লাহর প্রতি করতে যাওয়া আদব-পরিপন্থি ছিল। যে-কারণে তিনি এভাবে বলেননি, ‘যিনি আমাকে রোগ দিয়েছেন তিনিই আমাকে আরোগ্যদান করেন।’ বরং বাক্যের ভাবধারা পরিবর্তন করে এভাবে বলেছেন, ‘যখন আমি অসুস্থ হই তখন তিনিই আমাকে শেফা দান করেন।’ সন্দেহাতীতভাবে আল্লাহর নবীর এমন কালামই তাঁর দরবারের শোভনীয় ও সর্বোত্তম আদবের পরিচায়ক।

হজরত আইয়ুব (আ.) এর উদাহরণ
হজরত আইয়ুব (আ.) কে আল্লাহ তায়ালা প্রথমদিকে সবদিক থেকে জাগতিকভাবে সুখ-সমৃদ্ধি দান করেছিলেন। রিজিকের প্রশস্ততা এ পরিমাণ যে, তিন হাজার উট, তিন হাজার ঘোড়া, এক হাজার ছাগল, পাঁচশত খাদেম ও কাজের লোক এবং ফল-ফসলের অনেক বড় বড় বাগান দান করেছিলেন। এছাড়া অতিরিক্ত নেক সন্তান ও পুণ্যবতী, সৎ চরিত্রের অধিকারিণী ও রূপসী স্ত্রী দান করেছিলেন। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এক পর্যায়ে

পরীক্ষামূলকভাবে তার ওপর বিপদ-আপদের যুগ শুরু হলো। সবগুলো বাগান জ্বলে গেল, চতুষ্পদ জন্তুগুলো মরে গেল, সন্তানগুলো ঘর বিধ্বস্ত হয়ে মারা গেল। শারীরিক রোগ-ব্যাধি তাকে ঘিরে ধরল। প্রথম প্রথম শরীরে ফোস্কার জন্ম হলো, যা ক্ষতস্থানে রূপ নিল। হজরত আইয়ুব (আ.) ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক হয়ে রইলেন। এক পর্যায়ে এমন বাক্যে প্রার্থনা জানালেন ‘সে তার রবকে ডেকে বলেছিল, আমি তো দুঃখ-কষ্টে পড়েছি, আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৮৩)।

ওই প্রার্থনায় কাকুতি-মিনতির এক বিস্ময়কর ধারা বিদ্যমান। তিনি যদি ‘হে আল্লাহ! আমাকে আরামদায়ক অবস্থা ও আরোগ্যদান করেন’ বাক্যে প্রার্থনা করতেন তাও বৈধ হতো; কিন্তু দাসত্বের দাবি ছিল, আদবের বহিঃপ্রকাশ। তাই তিনি ধৈর্য ও আদবের সম্মিলিত এমন শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পেশ করলেন যে, মহান প্রভু তার প্রতি বাণী পাঠিয়ে দিলেন
‘নিশ্চয় আমি তাকে পেয়েছি ধৈর্যশীল। কতই না উত্তম বান্দা সে! নিশ্চয় সে ছিল আমার অভিমুখী।’ (সুরা সোয়াদ : ৪৪)। মহান আল্লাহ তিনটি শব্দ-বাক্যে ‘ধৈর্যশীল’, ‘কতই না উত্তম বান্দা’ ও ‘আল্লাহ অভিমুখী’ বলে হজরত আইয়ুব (আ.) কে সম্মানীত করেছেন। কেয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলমানই কোরআন তেলাওয়াতকালীন ওই বাক্যগুলো পাঠ করে মহান আল্লাহর প্রতি আদব প্রদর্শনে প্রাপ্ত বিনিময়ের কথা স্মরণ করতে থাকবে।

হজরত মুসা (আ.) এর উদাহরণ
‘তারীখুর-রুসুল ওয়াল-মুলুক’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, হজরত মুসা (আ.) যখন একাধারে সাতদিন ও সাত রাত সফর করে মাদয়ানে পৌঁছলেন তখন মারাত্মক ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে এভাবে দোয়া করলেন ‘হে প্রভু! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবেন আমি তার কাঙাল।’ (সূরা কাসাস : ২৪)। হজরত মুসা (আ.) যদি স্বীয় প্রার্থনায় ‘হে আল্লাহ! আমাকে খাবার দান করুন!’ এভাবে বলতেন, তারও সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি এমন বাক্যে প্রার্থনা করলেন যা মহান আল্লাহর শাহি দরবারের আদব রক্ষার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে আছে।

লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর