হাওর বার্তা ডেস্কঃ সবুজে ঘেরা এক গ্রাম। আছে সারি সারি পাকা-কাঁচা বাড়ি। তবে একটি গ্রামের সবকিছুই সেখানে থাকলেও কোনও মানুষের বাস নেই সেখানে। ঘরবাড়ি, দালান, উঠান থেকে রাস্তাঘাটসহ পুরো গ্রামটিকে গ্রাস করে নিয়েছে সবুজ লতাপাতা। লোকেরা এই গ্রামের নাম দিয়েছে ‘ভূত গ্রাম’। সাংহাইয়ের উপকূল থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরত্বে শেঙশান দ্বীপের ছোট্ট গ্রাম হাওটাও ওয়ান। সাংহাই থেকে জলপথে গ্রামটিতে যেতে সময় লাগে ঘণ্টা পাঁচেক। পুরোপুরি সবুজে ছাওয়া গ্রামটি দীর্ঘদিনই ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে।
গ্রামটির ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সবই সবুজ গাছপালায় ঢাকা। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও মাত্রা ছাড়া দূষণ যখন সবুজ প্রকৃতিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে, এই রকম একটা গ্রামের ছবি দেখে বিস্ময় হতবাক গোটা বিশ্ব। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা গ্রামটি এক সময় পাহাড় কেটেই তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ছোট ছোট মাটির বাড়িগুলিও পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সাজানো।
গ্রামটির আয়তন প্রায় ৫০০ বর্গ কিলোমিটার। এক সময় প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস ছিল এই গ্রামে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন পেশায় জেলে। কমপক্ষে ৬০০ পরিবারের বাস ছিল এই গ্রামে।
১৯৫০ সালে পাহাড় কেটে গ্রামটি তৈরি করা হয়। শহরাঞ্চল থেকে অনেকটাই দূরে প্রান্তিক এই গ্রামটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল একেবারেই অনুন্নত। সেই সঙ্গে খাবার ও পানীয় জলের জন্যও গ্রামবাসীদের অনেক দূরে পাড়ি দিতে হত।
একদিকে পাহাড়ে ঘেরা রুক্ষ পরিবেশ, অন্যদিকে জীবনধারণের নানা অসুবিধার মুখোমুখি হয়ে একে একে গ্রামবাসীরা তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে শুরু করেন। কাজের সূত্রেও জেলে পরিবারের অনেকে তাদের ভিটে ছেড়ে শহরে পাড়ি দেন।
১৯৯০ সাল নাগাদ হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার ছাড়া গোটা গ্রাম প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ বাড়িই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে।
স্থানীয়রা জানান, পরিত্যক্ত বাড়িগুলিতে ধীরে ধীরে ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করে গাছগাছালি। সমস্ত বাড়িগুলির গা বেয়ে উঠতে থাকে আঙুর গাছ। এক সময় দেখা যায় গোটা গ্রামটিই সবুজে আবৃত হয়ে গিয়েছে। ঘরবাড়ি, দালান, উঠান কোনও কিছুই বাকি নেই।
গ্রামের আদি বাসিন্দাদের দাবি, উপযুক্ত খাদ্য, পানীয়, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবেই তারা শহরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল গ্রামটি। যারা থেকে গিয়েছিলেন তারাও অনেকটা দূরে পাহাড়ের উপর আশ্রয় নিয়েছিলেন। লোকজনের বাস না থাকায় গ্রামটির নাম হয়ে যায় ‘ভূত গ্রাম’।
প্রকৃতির কোলে হারিয়ে গিয়ে গ্রামটিও এক সময় চলে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। ২০১৫ প্রথম এই গ্রামের খোঁজ পান চীনের এক তরুণ ফটোগ্রাফার কুইং জিয়ান। তিনিই প্রথম এই গ্রামের বেশ কিছু ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করেন। সবুজে ছাওয়া এমন গ্রাম দেখে হতবাক হয়ে যায় গোটা বিশ্ব।
পরবর্তীকালে গবেষণার কাজে হোক বা নিছক পর্যটনের জন্য, বহু মানুষ এখানে ভ্রমণ করেন। খোঁজ শুরু হয় এক সময় গ্রামে বসবাস করা পরিবারদের। ছবি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্র ধরে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায় হাওটাওওয়ান। খবর আনন্দবাজারের।
গ্রামটি নিয়ে প্রথম মুখ খোলেন ওয়াং পরিবার। বছর সাতাশের ওয়াং জানিয়েছেন, তিনি ও তার পরিবার যখন গ্রাম ছাড়েন তখন তার বয়স ছিল পাঁচ বছর। কাজের সন্ধানেই গ্রাম ছেড়ে চলে যায় তার পরিবার। এখন তাদের ছোট্ট বাড়িটি নাকি আঙুরলতায় ছেয়ে গিয়েছে।
একই অভিজ্ঞতা ঝু মান্ডিরও। তিনি জানিয়েছেন, পাহাড়ের ঢালে তাদের তিন তলা বাড়িটা সবুজ লতাপাতায় ভরে গিয়েছে। কাঠের দরজা ভেঙে ডালপালা মেলেছে আঙুর গাছের সারি।
তবে, গ্রামটির একপাশে এখনও জনা পাঁচ লোক বাস করেন। তারা পাহাড়ের উপর নিজেদের জন্য আলাদা ঘর বানিয়ে নিয়েছেন। এমনই একজন গ্রামবাসী বছর বাষট্টির প্রৌঢ় জানিয়েছেন, গ্রামটিতে এক সময় বহু মানুষের বাস ছিল। এখন কান পাতলে গাছপালার শিরশিরানি শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।
ইদানীং গ্রামটিতে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। এমনই একজন ২২ বছর বয়সী কলেজ ছাত্রী হুয়াং ডান বলেছেন, চারদিকে যখন গাছপালা সাফ করে ঘরবাড়ি গড়ে তুলছে মানুষ, সেই সময় এমন একটা জায়গার খোঁজ পাওয়াটা সত্যিই বিস্ময়কর। তার কথায়, ‘এখানে এসে মনে হচ্ছে শুরু থেকেই জায়গাটা প্রকৃতিরই ছিল। মানুষ চলে গিয়েছে, প্রকৃতি আবার তার ঠাঁই ফিরে পেয়েছে।’
গোটা গ্রামটিরই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখন সরকারের হাতে। পর্যটনস্থল হিসেবেই হাওটাও ওয়ানের পরিচিতি বেড়েছে। আগে বিনামূল্যে গ্রামে ঘোরার সুযোগ করে দেওয়া হলেও বর্তমানে মাথাপিছু প্রায় ৬০০ টাকা টিকিটের দাম ধার্য করেছে কর্তৃপক্ষ।