সদকাতুল ফিতর প্রদান করার পদ্ধতি

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইমাম আজম (রহ.) এর মতে অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। ইমাম মালিক (রহ.) এর মতে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম এবং খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ‘আজওয়া’ খেজুর দ্বারাই আদায় করা উত্তম।

ঈদের নামাজের পূর্বে যে সদকা আদায় করা হয় তা-ই সদকাতুল ফিতর। একে সংক্ষেপে ফিতরা বলা হয়। ঈদের দিন সকালবেলা যিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের (সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা সমমূল্যের ব্যবসাপণ্যের) মালিক থাকবেন তার নিজের ও পরিবারের ছোট-বড় সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা তার প্রতি ওয়াজিব। রুপার হিসাবে বর্তমান বাজার মূল্যে এটি পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রায়।

যারা সাহিবে নিসাব তথা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নন তাদের জন্যও ফিতরা আদায় করা সুন্নত ও নফল ইবাদত। একে অন্যের ফিতরা আদায় করতে পারবেন। রমজানেও ফিতরা আদায় করা যায়। যারা জাকাত গ্রহণের যোগ্য তারাই ফিতরার হকদার। ফিতরা নির্ধারিত খাদ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও আদায় করা যায় এবং অন্য কোনো বস্তু কিনেও দেওয়া যায়। বাবা-মা ও ঊর্ধ্বতন এবং ছেলেমেয়ে ও অধস্তন এবং যার ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে (যেমন স্ত্রী), তাদের ওয়াজিব ফিতরা প্রদান করা যায় না।

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা (সাড়ে তিন কেজি প্রায়) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (বোখারি : ১/২০৪)। তিনি আরও বলেন, আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু, যেমন এক সা যব, এক সা খেজুর, এক সা পনির, এক সা কিশমিশ। (বোখারি : ১/২০৫)।

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাদের মাঝে ছিলেন, তখন আমরা ছোট-বড়, মুক্ত ক্রীতদাস সবার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য অর্থাৎ এক সা পনির বা এক সা যব বা এক সা খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ। আমরা এভাবেই আদায় করছিলাম। একবার মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) হজ বা ওমরা করার জন্য এলেন, তিনি জনগণের উদ্দেশে মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন।

তখন তিনি আলোচনা করলেন সে বিষয়, যে বিষয়ে মানুষ প্রশ্ন করেছে। তিনি বললেন, আমি দেখছি শামের দুই মুদ (নিসফ সা বা পৌনে দুই কেজি) আটা সমান হয় (মূল্যমান হিসাবে) এক সা (সাড়ে তিন কেজি) খেজুরের। অতঃপর মানুষ (সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়িরা) এই মত গ্রহণ করলেন। (মুসলিম : ১/৩১৭-৩১৮)। হাসান বসরি (রহ.) বর্ণনা করেন, আলী (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ যখন তোমাদের প্রাচুর্য দিয়েছেন তোমরাও উদার হও, গমও এক সা দাও।’ (নাসায়ি : ১/২৬৮-২৭০)।

ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে সদকাতুল ফিতর যে-কোনো খাদ্যবস্তু এক সা; তবে গম হলে নিসফ সা। ইমাম মালিক (রহ.), ইমাম শাফিয়ি (রহ.) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর মতে সদকাতুল ফিতর যে-কোনো খাদ্যবস্তু এক সা (সাড়ে তিন কেজি প্রায়)। (আল ফিকাহ আলা মাযাহিবিল আরবাআহ)।

ইমাম আজম (রহ.) এর মতে অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা। ইমাম মালিক (রহ.) এর মতে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম এবং খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ‘আজওয়া’ খেজুর দ্বারাই আদায় করা উত্তম। ইমাম শাফিয়ি (রহ.) এর মতে হাদিসে উল্লিখিত বস্তুগুলোর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা আদায় করা শ্রেয়। অন্য সব ইমামের মতও অনুরূপ। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর মতে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এর অনুসরণ হিসেবে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম। এছাড়াও সদকার ক্ষেত্রে সব ফকিহের ঐকমত্য হলো ‘যা গরিবের জন্য বেশি উপকারী।’ (আল মুগনী : ৪/২১৯; আওজাযুল মাসালিক শরহে মুআত্তা মালিক : ৬/১২৮)।

ফকিহদের মতে, যেখানে যা প্রধান খাদ্য তা দ্বারা আদায় করাই শ্রেয়। মুজতাহিদ ইমামদের মতে, যেসব খাদ্যবস্তু ক. সহজে সংরক্ষণযোগ্য, খ. সহজে বিনিময়যোগ্য ও গ. বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকে সেসব খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। উল্লেখ্য, চালের মধ্যে ওই তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং সৌদি আরবসহ সব আরব দেশ এবং প্রায় সব মুসলিম দেশ বর্তমানে চালের হিসাব গ্রহণ করেছে।

খেজুর বা চাল বিভিন্ন দামের রয়েছে, এর মধ্যে কোনটি দ্বারা ফিতরা আদায় করা হবে? উত্তম হলো, সর্বোচ্চ মূল্যের খেজুর বা চালের মূল্যে আদায় করা। তবে ধনীরা সর্বোচ্চ এবং সাধারণদের মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করাই শ্রেয়। ইনসাফ হলো, যারা যে চালের ভাত খান বা যারা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন তারা সে সমমানের বা সমমূল্যে ফিতরা আদায় করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তাই উত্তম, দাতার কাছে যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’ (বোখারি : ৩/১৮৮)। বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বেফাক বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ নিয়মই অনুসরণ করে।

সদকাতুল ফিতর, রোজার ফিদইয়া, রোজার কাফফারা, কসমের কাফফারা, যিহারের কাফফারা ও হজের সদকা একই পরিমাণ। হজের সদকা সম্পর্কে বলা আছে, তিন সদকা যদি একটি হজের দম বা কোরবানির পরিমাণের সমান বা তারও বেশি হয় তবে কোরবানি দ্বারা তা আদায় করবে। এতে বোঝা যায়, তিন সদকা এক কোরবানির সমান বা আরও বেশি হবে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, সদকা হলো কোরবানির তিন ভাগের একভাগ। হজের দম বা কোরবানি হলো উট, গরু ও মহিষের এক-সপ্তমাংশ বা একটি দুম্বা, ছাগল, ভেড়া। (কিতাবুল হাজ্জ ও কিতাবুস সওম)।

লেখক : সদস্য, জাতীয় ফিতরা নির্ধারণ কমিটি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর