হাওর বার্তা ডেস্কঃ গ্রামীণ খেলাধুলা নিয়ে কাজী ইমদাদুল হকের বহুল আলোচিত ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসের ‘বরিহাটির স্কুল’ অংশে শিক্ষক আবদুল্লাহর সঙ্গে ইংরেজ স্কুল ইন্সপেক্টরের কথোপকথন স্মরণ করা যেতে পারে। আবদুল্লাহকে সরাসরি অভিযোগ করে ইংরেজ ইন্সপেক্টর বললেন, ‘আমি শুনেছি, তুমি না-কি ছাত্রদের শুধু দেশী খেলাধুলা করতে উৎসাহিত কর। ক্রিকেট, বাস্কেটবল, ফুটবল এই খেলাগুলোর প্রতি ছাত্রদের আগ্রহী করতে চাও না।’ আবদুল্লাহর উত্তর ছিল, ‘স্যার ছাত্ররা সব ধরনের খেলাধুলার প্রতিই যাতে আগ্রহী হয় সেই চেষ্টাই করি। অন্য স্কুলগুলোর বিপক্ষে আমাদের ছেলেরা বেশিরভাগ সময়ই জেতে।’
আলোচনার এক পর্যায়ে ইন্সপেক্টর দেশী খেলাধুলা কেমন সে বিষয়ে জানতে চাইলেন। অল্প কথায় আবদুল্লাহ দেশীয় খেলাধুলা যেমন কাবাডি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা প্রভৃতি খেলাগুলো বুঝিয়ে দিলেন সাহেবকে। মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে ইন্সপেক্টর বললেন, ‘দেশীয় খেলাগুলো তো বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। ওয়েল মৌলভি। তবে বিদেশী খেলাগুলোও বাদ দেয়া উচিৎ নয়। আর খেলাধুলার দিকে মন দিলে ছাত্ররা বদ খেয়ালের দিকে যাবে না।’ দেশীয় খেলাধুলার উপযোগিতা বুঝাতে গিয়ে ইংরেজ ইন্সপেক্টরকে আবদুল্লাহ বলেছিলেন, খুব অল্প জায়গা নিয়ে অল্প আয়োজনেই এই খেলাগুলো করা যায়।
আমাদের ছেলেবেলা মানে, এক পকেটে মার্বেলের ঝনঝনানি, অন্য পকেটে লাটিম আর দড়ি। একটু সময় পেলেই মার্বেল আর লাটিম নিয়ে মেতে ওঠা। এক লাটিমেরই যে কত কসরৎ! লাটিম মাটিতে না ঘুরিয়ে হাতের ওপর ঘোরানো; হাতের ওপর লাটিম কে কতক্ষণ ঘোরাতে পারে চলত সেই প্রতিযোগিতা। লাটিম ঘোরানোর ক্ষেত্রে কে কত বড় বিশারদ এই প্রতিযোগিতা মাঝে মধ্যেই চরম আকার ধারণ করত। অতঃপর ডুয়েল, কে কার লাটিমের গায়ে কত বেশি ক্ষত করতে পারে। এজন্য লাটিমের মাথায় লোহার যে পেরেক থাকে সেটা আরো ধারালো করা হতো। এভাবে পাল্টাপাল্টি আঘাত করার চেষ্টা। আর ধারালো পেরেকের ঘা খেয়ে লাটিম ফেটে যেত- এমন ঘটনা ঘটত প্রায়ই।
সেই বয়সে মার্বেল নিয়ে কত যে গবেষণা তার শেষ নেই। এক চোখ বন্ধ করে বৃদ্ধাঙুলের সাহায্যে সজোরে দূরের মার্বেল আঘাত করলেই চিৎকার আলটপকা। যে সফল হলো সেতো বটেই, আশপাশের সবারই সে কি সশব্দ উল্লাস! ক্লাসের মধ্যে পকেটের মার্বেল ঝনঝন শব্দে বেজে উঠলে আর রক্ষা নাই। অবধারিতভাবে স্যারদের পিটুনি। পকেটের মার্বেল যাতে শব্দ না করে এজন্য কত যে বুদ্ধি খরচ করতে হয়েছে, তার কোনো শেষ নাই। গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা টাকা রাখার জন্য খুব ছোট আকারে সুতা দিয়ে বুনানো এক ধরনের নেট ব্যবহার করে। মার্বেল যাতে শব্দ না করে সেজন্য এগুলো ব্যবহার করেছি আমরা। এই ছোট নেটের মধ্যে মার্বেল রেখে টাইট করে বেঁধে দিলে মার্বেল আর শব্দ করত না। আবার অনেক সময় স্কুলের আশপাশে নিজেরা কোনো গোপন জায়গা বের করে মার্বেল পুঁতে রাখার কৌশলও নিতে হয়েছে।
চিরায়ত গ্রামবাংলার খেলাধুলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে ইচিংবিচিং। এর থেকে সর্বজনীন খেলা আর হয় না। যে কোনদিন মার্বেল, লাটিম হাতে নেয়নি সেও অংশ নিয়েছে এই খেলায়। এই খেলা ভীষণ প্রিয় ছিল বিশেষ করে গ্রামের কিশোরীদের। খেলার মূল বৈশিষ্ট্য উচ্চতা অতিক্রম। দুজন মুখোমুখি বসে গোড়ালি মাটিতে রেখে পায়ের পাতা উঁচু করে আরেক পায়ের আঙুলের উপর রাখা হয়। এরপর করতল স্থাপন করে উচ্চতা বাড়ানো হয়। আর লাফিয়ে এই উচ্চতা অতিক্রম করতে হয় বাকিদের। দুজনের চার পা আর চার হাতের আঙুল পরপর সাজিয়ে উচ্চতা যথাসম্ভব বাড়ানো হতো। এই ইচিংবিচিং খেলায় পারদর্শীরা গ্রামের স্কুলের হাইজাম্প প্রতিযোগিতায় ভালো করত। মুখে বিচিত্র সব ছড়া কাটতে কাটতে লাফিয়ে এই উচ্চতা টপকানোর চ্যালেঞ্জ আমোদিত করত সবাইকে। গ্রাম বাংলার মেয়েদের খেলাধুলার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে কুতকুত ও বউচি। কুতকুত খেলায় আয়তাকার অনেকগুলো ছোট ঘর কাটা হয়।
আর সবশেষে থাকে একটা বড় ঘর। একটা খাপড়া (চাড়া) ফেলা হয় প্রথম ঘরে। মুখে কুতকুত বা কিতকিত শব্দ করে এক পা শূন্যে রেখে ওই চাড়াটিকে বড় ঘরে আনতে হয়। কিন্তু একটার পর একটা ঘর অতিক্রমের সময় চাড়া কিংবা পা দাগে পড়লেই শেষ। পরপর সবগুলো ঘর অতিক্রম শেষে বড় ঘরে এসে বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ মেলে। এই খেলার মজার একটা বৈশিষ্ট্য ঘর কেনা। একটি চাড়া কপালে নিয়ে সবগুলো ঘর অতিক্রম করতে পারলে একটি ঘর কেনা যায়। ঘর কেনার অর্থ ওই ঘরে আর কেউ পা ফেলতে পারবে না কিংবা চাড়াও নেয়া যাবে না। এভাবে সবগুলো ঘর কিনতে পারলে বিজয়ী হওয়া যাবে। পায়ের টোকায় চাড়া নিয়ে ঘর অতিক্রম করার মেয়েদের আরেকটি খেলা এক্কাদোক্কা। এই খেলায় কুতকুতের মতো আলাদা কোনো বিশ্রাম ঘর থাকে না। একটি বৃত্তাকার ঘর লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি চারভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিটি ঘরেই চাড়া ফেলে দাগ এড়িয়ে আঙুলের টোকায় চাড়াগুলোকে নিয়ে ঘর অতিক্রম করতে হয়।
বউচি খেলা দু’দলের মধ্যে হয়। গ্রামের মেয়েদের প্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। প্রতি দলে ৫ থেকে ১০ জন নিয়ে এটি খেলা যায়। খেলায় মাঝখানে বেশ খানিকটা দুরত্ব রেখে দাগ দিয়ে দুটি ঘর কাটা হয়। একটি বড় ঘর ও একটি ছোট ঘর। এক পক্ষের দলের একজনকে বউ নির্বাচন করা হয়। আর বউ পক্ষের দলের বাকিরা থাকে বড় ঘরে। অন্য দলের সবাই থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। প্রতিপক্ষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে ছোট ঘর থেকে বউকে যেতে হয় বড় ঘরে। ছোট ঘর থেকে বউ বড় ঘরে পৌঁছানোর আগে যদি প্রতিপক্ষের কেউ বউকে ছুঁয়ে দেয় তাহলে ওই পক্ষের খেলা শেষ। আবার বউ পক্ষের লোকজন যদি অপর পক্ষের কাউকে স্পর্শ করে তবে সেও মারা যাবে অর্থাৎ আর বউ ছুঁতে পারবে না। বাইরে যেতে হবে তাকে। মূল কথা বউকে বড় ঘরে পৌঁছানোর জন্য সহযোগী হিসেবে থাকবে একই দলের বাকি সদস্যরা। ছিঃ বুড়ি খেলাও অনেকটা বউচির অনুরুপ। এই খেলায় বউয়ের জায়গায় থাকে বুড়ি। মানে নির্বাচন করা হয় বুড়ি।
আমাদের সময়ের কেউ গোল্লাছুট খেলেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। খেলায় একটা গাছ বা খুঁটি পুঁতে একটা গোলাকার ঘর তৈরি করা হয়। দু’ দলে সমান সমান প্রতিযোগী থাকে। কিছুটা দূরে আরেকটা জায়গা নির্ধারণ করা হয়। সেখানে গাছ কিংবা লাঠি পুঁতে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা হয়। দুই দলেই একজন করে দলনেতা অর্থাৎ গোদা থাকে। এরপর হাতে হাত ধরে ওই খুঁটি কিংবা গাছের চারপাশে ঘুরতে থাকে এক দল। হাতে হাত ধরাদের স্পর্শ এড়িয়ে অপরপক্ষ থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এরপর হাতে হাত ধরা দলের সবাই এক এক করে দৌড়ে লক্ষ্যবস্তু স্পর্শ করার চেষ্টা করে। আর লক্ষবস্তু ছোঁয়ার আগে অপরপক্ষ তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। বিপক্ষ দলের স্পর্শ বাঁচিয়ে কেউ যদি লক্ষবস্তু স্পর্শ করতে না পারে তাহলে বিপক্ষ দল দান পায়। এরপর বিপক্ষ দল হাতে হাত রেখে চেষ্টা করে লক্ষ্যবস্তু স্পর্শ করার। বৃত্তাকারে ঘুরতে হয় বলে গোল্লা এবং দৌড় মানে ছুট এ থেকেই গোল্লাছুট নামের উৎপত্তি।
গ্রাম বাংলার প্রচলিত খেলাগুলোর আরেকটি দাড়িয়াবান্ধা। নারী-পুরুষ, শিশু, কিশোর-কিশোরী নির্বিশেষে সবাই এই খেলায় অংশ নিতে পারে। প্রতিটি দলে ৬-৭ জন করে সদস্য থাকে। আয়তাকার একটা মাঠ থাকে। প্রথম ঘরটিকে দু’ভাগ করে কাটা হয়। বাকি ঘরগুলো ছোট হয়। প্রতিটি ঘরে একজন করে পাহারা দেয়। প্রথমে এক দল খেলার সুযোগ পায়। বিপক্ষ দল থাকে পাহারায়। আগে খেলার সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়রা নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে নিজেদের প্রথম ঘরে ফিরে আসার চেষ্টা করে। আর তাদের স্পর্শ করার চেষ্টা করে বিপক্ষ দল। প্রতিপক্ষ শিবিরের ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিজেদের ঘরে ফিরে আসতে পারলে জয় পাওয়া যায়। আর যদি ফিরে আসার আগে স্পর্শ করে তবে খেলার সুযোগ পায় বিপক্ষ দল।
দাড়িয়াবান্ধা খেলা অবশ্য অঞ্চলভেদে আলাদা হয়। বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার খেলাকে দুটো সময়ে ভাগ করা যায়। বর্ষা আর বাকি মৌসুম। কাগজে কলমে ঋতু দুই মাসের হলেও, একটা সময়ে বর্ষা মৌসুম অনেক দীর্ঘায়িত হতো। স্বভাবতই এই সময় মানুষের অনেক অবসর থাকে। সময় কাটানোর জন্য ঘরের মধ্যে বসে খেলা যায় এমন বেশ কিছু খেলা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাঘ-বন্দী, ১৬ গুটি, লুডু, কড়ি খেলা, পাশা খেলা। বাঘ-বন্দী খেলায় বেশ বুদ্ধি করে বাঘ আটকানোর কৌশল করতে হয়। সুযোগ পেলেই ছাগল খেয়ে ফেলে বাঘ। আর চারপাশ থেকে ছাগল দিয়ে বাঘকে আটকানোর ফন্দি করা হয়। ছাগল খেতে হলে একই সরলরেখায় পরের ঘরটি ফাঁকা থাকতে হবে। যাতে বাঘ ফাঁকা ঘরে আশ্রয় নিতে পারে। একটা সময় বাঘের যদি আর যাওয়ার জায়গা না থাকে মানে কোনো ফাঁকা ঘর না থাকে তবে বাঘ বন্দী হিসেবে গণ্য হয়। বাঘ-বন্দী খেলা কোথাও কোথাও আবার বাঘ-বকরী বা বাঘ-ছাগল খেলা নামেও পরিচিত।
১৬ গুটি বা ১২ গুটি কিংবা ১৪ গুটি খেলার ধরন অনেকটা বাঘ-বন্দী খেলার মতই। এখানে দু’পক্ষেই গুটির সংখ্যা সমান থাকে। গুটি খাওয়ার নিয়ম হচ্ছে, একই সরলরেখায় পরের ঘরটি ফাঁকা থাকতে হবে। এভাবে প্রতিপক্ষের সবগুলো গুটি খাওয়ার চেষ্টা করা হয়। যার গুটি আগে শেষ হয়ে যাবে তার হার হবে। দাবা খেলার সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে খেলাটির। গ্রাম থেকে আসা ঢাকার মেহনতি মানুষের মধ্যে এই ১৬ গুটি ও বাঘ-বন্দী খেলার প্রবনতা দেখা যায়। আমার বাসার কাছে রিকশা গ্যারেজের দিকে চোখ পড়লেই দেখি ঘর কেটে এই খেলা চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকে, হলগুলোর গেটে দয়িত্বরত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বাঘ-বকরী কিংবা ১৬ গুটি খেলা খেলতে দেখেছি। ঘরের মধ্যে কড়ি খেলার ঐতিহ্য বেশ পুরনো। নারী-পুরুষ বয়স নির্বিশেষে এই খেলা করে। চারটি কড়ি নিয়ে কখনো দুজন কিংবা কখনো আরও বেশি সংখ্যক এই খেলায় অংশ নিয়ে থাকে। চার চোখ হলে ১৬ পয়েন্ট। আঙুলের সাহায্যে একটা কড়ি দিয়ে আরেকটা কড়িকে আঘাত করে এক এক পয়েন্ট সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত যে আগে একশোতে পৌঁছায় সে বিজয়ী হয়। বাংলার গ্রামীণ জনপদে অন্যতম দুই প্রধান খেলা ডাংগুলি, সাতচাপড়া কিংবা সাত খাপড়া খেলা। ডাংগুলি খেলায় এক থেকে দেড় হাত লম্বা একটা লাঠি কিংবা ডাং ব্যবহার করা হয়।
আর চার আঙুল (দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি) লাম্বা ছোট একটি গুলি নেয়া হয়। এ দুটোই সাধারণত তৈরি হয় বাঁশের কঞ্চি দিয়ে। একটা গর্তের মধ্যে গুলি রেখে সেটিকে বড় ডান্ডা দিয়ে মেরে দূরে পাঠানো হয়। যদি শূন্যে সেটি বিপক্ষ দলের কেউ ধরে ফেলে তাহলে সে আউট। গুলি দূরে যাওয়ার পর ডাং দিয়ে আঘাতকারী এড়ি বেড়ি তেড়ি এভাবে গুনতে থাকে। ডাংগুলি খেলাটির সঙ্গে ক্রিকেটের কিছুটা মিল রয়েছে। সাত খাপড়া বা সাত চাড়া খেলাটির প্রচলনও ছিল বেশ। দুই দলের এই খেলায় সাতটি চাড়া বা খাপড়া একটার পর একটা সাজানো থাকে। এরপর বল দিয়ে ওই চাড়াগুলোকে আঘাত করে দে ছুট। আঘাতকারী দলের লক্ষ্য থাকে সাতটি চাড়াকে আগের মতো পরপর সাজানো। আর বিপক্ষ দলের লক্ষ্য থাকে ওই চাড়াগুলোক পুনর্বিন্যাস করার আগে বল দিয়ে আঘাত করা।
গ্রাম বাংলায় বড় আয়োজনের খেলাধুলার মধ্যে আছে লাঠিখেলা, হাডুডু বা কাবাডি, নৌকাবাইচ ইত্যাদি। একটা সময় লাঠি খেলা ছাড়া মুহররম, বৈশাখি মেলা ভাবা যেত না। কোনো অনুষ্ঠানে শান্তি রক্ষীবাহিনীর হাতে লাঠি মনে করিয়ে দেয় অনেক কিছু। বাঙালির প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় প্রতীক লাঠি। বাংলাসাহিত্য-সংগীত-সিনেমার বিশাল অংশজুড়ে আছে লাঠির উপস্থিতি। হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ নাটকের লাঠিয়াল হানিফ-বদরুল, ‘লাঠিয়াল’সিনেমায় কিংবা জসীমউদদীনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’র রুপাইয়ের লাঠি এদেশের মানুষের জীবনেরই যেন প্রতিচ্ছবি। গ্রাম-বাংলাজুড়ে লেঠেলদের বীরত্বগাঁথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্বভাবতই লাঠির কসরৎ এদেশের সাধারণ মানুষের অতি প্রিয়। ‘এক ধামা চাল একটা পটল’ ঢোলের এমন বাজনা বেজে চলেছে। চারদিক থইথই করছে মানুষ। আশপাশে বসেছে মেলা। চলছে লাঠিয়াল বাহিনীর দারুণ সব শিহরণ জাগানো কসরৎ। লেঠেলদের মাথায় লাল পট্টি, হাতে বহু যত্নে রাখা তৈলাক্ত লাঠি। লাঠির ঠোকাঠুকির ঘর্ষণে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে- ছেলেবেলায় এর চেয়ে পুলক জাগানো রোমাঞ্চ আর কি হতে পারে?
বড় আয়োজনের খেলাধুলার মধ্যে হাডুডু বা কাবাডি ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ছেলেবেলায় এমন কত দেখেছি যে, একদিনে ১৬ দলের কাবাডি খেলার আয়োজন। বিজয়ী দল পাবে একটি বড় ষাঁড়। ঢাকঢোল বাজিয়ে শুরু হলো বর্নাঢ্য প্রতিযোগিতা। মাঠের এক পাশে মেলা। দিনভর উপচে পড়ছে মানুষ। ষোলো দল থেকে ফাইনালে উঠল দু’দল। লাল ষাঁড়ের মালিকানা কে পাবে? তুঙ্গস্পর্শী উত্তেজনা। ‘কাবাডি’ ‘কাবাডি’ শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে চারদিক। একজনকে আটকানোর জন্য কৌশল করছে প্রতিপক্ষ। হালে গ্রামেও এমন দৃশ্য বিরল। তবে কাবাডি এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতপ্রাপ্ত খেলা।
শুধু উপমহাদেশ নয়, এশিয়ান গেমসেও বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে কাবাডি। গ্রাম বাংলার আকর্ষণীয় খেলার অন্যতম নৌকাবাইচ। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ছিপ খান তিন দাঁড় তিন জন মাল্লা/চৌপর দিনভর দেয় দূর পাল্লা।’ছন্দের জাদুকরের এই ছড়ার দ্যোতনার মতো ছলাৎ ছলাৎ জলতরঙ্গ তুলে বাইচের নৌকা এগিয়ে চলে। জন-উৎসবের প্রাণ যেন এই নৌকাবাইচ। নদীর দুই পাশে মানুষের সারি। চলছে গান বাজনা। হেইও হেইও-রব তুলছে মাঝিরা। পাল্লা দিয়ে ছুটছে বাইচের নৌকাগুলো। কেউ কেউ তাল সামলাতে না পেড়ে পড়ে যাচ্ছে নদীতে। কিন্তু থামবার সময় নাই। আরও জোরে আরও জোরে প্রাণপণে বৈঠা চালাচ্ছে মাঝিরা। ‘মাটির ময়না’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় দারুণভাবে উঠে এসেছে গ্রামের নৌকাবাইচ। নদীমাতৃক বাংলদেশের সংস্কৃতি সর্বোপরি যাপিত জীবনের অংশ এই নৌকাবাইচ।
অন্য সব ঐতিহ্যবাহী খেলার মতো সর্বোপরি বাংলাদেশের নদীগুলোর মতোই দশা যেন নৌকাবাইচের। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাশয়। বাইচ কমে আসছে দিনকে দিন। বাইচের মাঝিদের একটা বিশাল অংশ তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে। এক নৌকাবাইচ দিয়েই বোঝা যায় বিদেশী খেলার দাপটে দেশী খেলাগুলোর কি মুমূর্ষু দশা। বিদেশী খেলা আর দেশী এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব চোখ এড়ায়নি খ্যাতনামা কথাশিল্পী কাজী ইমদাদুল হকের। দেশী খেলাধুলার সঙ্গে এদেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশী খেলাগুলোর সঙ্গেও যাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে তার ওপর জোর দিয়েছিলেন ইংরেজ সাহেব। কাল পরিক্রমায় বিদেশী খেলাগুলো হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রধান খেলা। আর হারিয়ে যেতে বসেছে দেশীয় খেলা। দেশীয় খেলাগুলোকে প্রধান রেখে বিদেশী খেলাগুলো খেলতে হবে, এমন অনুধাবন নেই এসময়ের আবদুল্লাহদের। ফল হিসেবে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য। আর ক্রমশই হেরে যাচ্ছি আমরা।