মহিষ প্রাণিজসম্পদ। বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদকের উৎস। দুধ ও গোশত উৎপাদন ছাড়াও ভারি কাজের জন্য মহিষের তুলনা নেই। চামড়ার যথেষ্ট অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। গোবরও জৈব সারের উৎকৃষ্ট উৎস। মহিষের হাড় দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী। এসবই মানবজাতির অনন্য শিক্ষা। এরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই গবাদিপশুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। তাদের উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য থেকে তোমাদের পান করাই বিশুদ্ধ দুধ, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু।’ (সূরা নাহল : ৬৬)।
মহিষের নানা প্রজাতি
মহিষ প্রধানত দুই ধরনের। জলাভূমির মহিষ ও নদীর মহিষ। জলাভূমির মহিষ বিভিন্ন কাজ করার জন্য শক্তির উৎস। এদের গায়ের রঙ সাধারণত ধূসর, গাঢ় ধূসর হয়ে থাকে। কখনও কখনও সাদা রঙের মহিষও দেখা যায়। তবে এ মহিষের কোনো নির্দিষ্ট জাত নেই। পক্ষান্তরে নদীর মহিষ দুধ ও গোশত উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। এ মহিষ সাধারণত গাঢ় কালো বর্ণের, শরীর মধ্যম থেকে বৃহদাকৃতির এবং শিং বাঁকানো হয়ে থাকে। এদের ১৮টি প্রজাতি রয়েছে। তন্মধ্যে নিলি, রাভি, মুররাহ, সুরটি, জাফরাবাদি, মেহসানা, কুনদি, ভাদোয়ারি এবং ইতালীয় ভূমধ্যসাগরীয় মহিষ উল্লেখযোগ্য।
প্রাণিজসম্পদ হিসেবে মহিষ
মহিষের আকার বড়, গোশতও বেশি। বেশি অাঁশ ও সেলুলোজযুক্ত খাদ্য হজম করতে পারে। বাসস্থান তৈরির খরচ কম। শস্য উৎপাদনে কর্দমাক্ত জমিতে চাষাবাদের সুবিধা। রোগ কম, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। গোশত ও দুধ বেশ পুষ্টিকর। দুধে কঠিন পদার্থ ও চর্বির পরিমাণ বেশি, যা রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এ দুধ গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের জন্য খুব উপকারী। এতে মাখনের পরিমাণ শতকরা ছয় থেকে দশ ভাগ। মহিষ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তর দুগ্ধ উৎপাদনকরী পশু হিসেবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাই আমাদের দেশে মহিষের খামার গরুর খামারের তুলনায় বেশি লাভজনক।
মহিষের গোশতের কার্যকারিতার শেষ নেই। এ গোশতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন আছে, যা মাংসপেশি গঠনে অত্যন্ত জরুরি। আছে আয়রনের উৎসও। চার বছরের বেশি বয়সের শিশুদের এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতিদিন ১৮ মিলিগ্রাম আয়রনের চাহিদা থাকে। মহিষের গোশতে সে আয়রন সহজেই পাওয়া সম্ভব। জিঙ্কের উপস্থিতিও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে, যা মাংসপেশি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-বি। এতে নিয়াসিন থাকে, যা হজমে সহায়তা করে এবং রয়েছে রিবোফ্লাবিন, যা চোখ ও ত্বক ভালো রাখে।
মহিষের দুধ, গোশত ও চামড়া ছাড়াও চাষাবাদ ও গাড়ি টানার জন্য মহিষ বেশ শক্তিশালী উপযোগী প্রাণী। এর গোবর উৎকৃষ্ট জৈব সার। আর হাড় থেকে বিভিন্ন পণ্য- যেমন- বোতাম, চিরুনি ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
কোরবানির পশু
শরিয়ত নির্ধারিত গৃহপালিত পশু ব্যতীত কোরবানি করা জায়েজ নেই। মহিষ কোরবানির পশু। আল্লাহর রাসুল (সা.) উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো জন্তু কোরবানি করেননি বা কোরবানি করতে বলেননি। কোরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট ও অধিক গোশত সম্পন্ন হওয়া ভালো। এজন্য মহিষ কোরবানির বিকল্প নেই। কেননা মহিষই অধিক গোশতসম্পন্ন হয়। এরশাদ হয়েছে, ‘হে মোমিনরা! অসম্মান করো না আল্লাহর নির্দেশগুলো, সম্মানিত মাসগুলো, হারামে কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট জন্তু এবং ওইসব জন্তুকে যাদের গলায় কণ্ঠাভরণ রয়েছে।’ (সূরা মায়েদা : ২)। অথচ মহিষ কোরবানি করতে কারও মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। যে মহিষ সাত ভাগে কোরবানি দেয়া যায়। দুই বছর বয়স হলেই চলে।
স্বভাব-প্রকৃতি
গৃহপালিত মহিষ শান্ত প্রাণী হলেও বন্যরা খুবই হিংস্র। বাঘও এদের ভয় করে চলে। এরা চলে দল বেঁধে। মাংসাশী প্রাণীরাও সহজে এদের ঘাটাতে চায় না। আফ্রিকার বন্য মহিষ কেপবাফেলো আরও বড় ও ভয়ঙ্কর। এদের একেকটার শিং তিন ফুটের মতো লম্বা। শিং খুবই শক্ত। গায়ের চামড়াও বেশ পুরু। আফ্রিকার মানুষ এই মহিষকেই পোষ মানিয়ে গৃহপালিত পশুতে পরিণত করেছে। আমেরিকায়ও বন্য মহিষ রয়েছে। মহিষ পানিতে নেমে উৎসবে মেতে ওঠে, গায়ে কাদা মাখায়। সহজে পানি থেকে উঠতে চায় না। যখন অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গে লড়াইয়ে নামে তখন সহজে থামে না বা পরাজয় মানতে পারে না।
মহিষ বহু আগে থেকেই গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এরা উচ্চতায় ১.৮ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। দেহের রঙ ধূসর কালো, পৃষ্ঠভাগ সোজা এবং দেহ অল্প পরিমাণ খাটো লোমে আবৃত। এদের শিং বৃহৎ, গোড়ার অংশ বাইরের দিকে এবং শীর্ষপ্রান্ত একে অন্যের দিকে ফেরানো। গৃহপালিত মহিষের জাতগুলোর মধ্যে আকার, দেহের গড়ন এবং শিংয়ের আকার-আকৃতির বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। স্ত্রী মহিষ গর্ভধারণের ১০ মাস পর একটি শাবক প্রসব করে।
বাংলাদেশে মহিষ সম্পদের সম্ভাবনা
দেশের গবাদিপশু খাতে মহিষ এক বড় সম্পদ। মহিষ পালনের মাধ্যমে গোশত ও দুধের বিরাট জোগান আসে। বাংলাদেশ মহিষ পালনে এশিয়ায় নবম স্থানে। দেশে মহিষের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এসব মহিষের জাতগুলো পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গৃহপালিত মহিষ বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কমবেশি বিদ্যমান। ব্রহ্মপুত্র নদ, যমুনা ও মেঘনা নদীর অববাহিকা, সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় বিশেষভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে এদের বেশি দেখা যায়। তবে আশানুরূপ দুধ পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা বাংলাদেশে দুধের জন্য উন্নত জাতের কোনো মহিষ নেই। একসময় গ্রামাঞ্চলে গরুর বিকল্প হিসেবে মহিষ পালন করা হতো। বিশেষ করে মালবোঝাই গাড়ি টানতে কৃষকরা গরুর চেয়ে মহিষের ওপরই নির্ভর করতেন।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে মহিষ উৎপাদন বৃদ্ধি, বেকার যুবসমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জাতীয় অর্থনৈতিক খাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা মহিষের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন। মহিষের জিন নকশা উন্মোচন গবেষণা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য একটি মাইলফলক। এতে মলিকিউলার মাধ্যমে প্রজনন হবে। মহিষের নির্দিষ্ট কোনো প্রজনন ঋতু নেই। সারা বছরই প্রজনন করা যায়। তবে শীতে এর পরিমাণ বেশি দেখা যায়। এ প্রজননে বাড়বে দুধ ও গোশতের পরিমাণ।
মহিষ পালন করে আশানুরূপ উৎপাদন পেতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং উপযুক্ত পরিচর্যা জরুরি। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অাঁশযুক্ত, দানাদার, পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য। তবেই মহিষ থেকে আমাদের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লাভ করা সম্ভব।