ঢাকা ০১:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রতিবন্ধীদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে : অধ্যক্ষ আসাদুল হক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৪:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫
  • ৩৯৪ বার

পত্রপত্রিকার পাতায় প্রতিবন্ধী মানুষের সাফল্য ও স্বপ্ন নিয়ে নানা খবরাখবর; এগিয়ে যাওয়া অদম্য জীবনের গল্প, সাদাছড়ি, হুইল চেয়ার, ক্র্যাচ ইত্যাদি বিতরণের তথ্য আমরা প্রায়ই পড়ে থাকি। দেখেশুনে মনে হতেই পারে যে, উন্নয়নের জোয়ার লেগেছে দেশে। জোয়ার লেগেছে বৈকি। জনগণ, অভিভাবক এবং প্রতিবন্ধী মানুষরাও তা জানতে পারছেন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। উন্নয়ন ‘কেন’, ‘কীভাবে’, ‘কোথায়’, এ জাতীয় শব্দ নিয়ে আমরা অনেকেই হয়তো মাথা ঘামাই; কিন্তু মুখ ফুটে কেউ প্রকাশ করি না।

আমরা বিবেকের তিন স্তরের কথা কমবেশি জানি- অন্তরের উপলব্ধি, মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং সর্বশেষ শারীরিক শক্তি প্রয়োগ। অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি নির্বিশেষে সব মানুষের অবস্থা এ তিন স্তরের কাছাকাছিও যায় না। অন্তরের উপলব্ধির অভাব। জেনেবুঝেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থমকে থাকা। বিশ্বাসের জন্ম হলে এ চিন্তা অকপট স্বীকারোক্তিতে রূপান্তরিত হতে সময় নেয়ার কথা জন্মায় মনে। আর এভাবেই বাস্তবায়িত হয় উন্নয়নের স্বপ্নগুলো। কিন্তু আত্মবিশ্বাসই যদি না থাকে! যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ! কিন্তু যোগ্যতার অভাব কেন? ঘাটতি কোথায়? অনেক যুগ আগের ক্রীতদাসদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন প্রভুর অধীনে থাকতে থাকতে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যেত তাদের মনের ভেতর, তাদের যেন নিজস্ব চিন্তাচেতনা-স্বপ্ন বলে কিছুই থাকতে নেই। ইচ্ছা নেই। অধিকার নেই। নিজে থেকে কিছু করার নেই জীবনে। একসময় তারা ভাবতে শুরু করত যে, প্রভুর অধীনে থেকে বেরিয়ে নিজ পায়ে ভর করে চলতেই পারবে না কখনও। তার চেয়ে এই বেশ ভালো আছি। এক ধরনের পরনির্ভরশীলতা বলা যায়। এ পরনির্ভরশীলতার চরম পর্যায়ে গিয়ে তাদের মনেই হতো না যে, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা যায়। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া যায়। মানুষের মৌলিক প্রাপ্য অধিকারগুলো না পেতে পেতে এক পর্যায়ে সেটা অর্জন করে নেয়ার ‘সাহস’ চরম ভুল বলে মন করা শুরু করত তারা।

প্রতিবন্ধী মানুষের শতকরা ৯৯ ভাগই সম্ভবত ঠিক এ অবস্থার ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। হাতেগোনা অল্পসংখ্যক সমাজের বিভিন্ন বাধার সঙ্গে অসম্ভব এক প্রতিকূলতার মাঝে লড়াই করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করে চলছেন অবিরাম। আর বাকি বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীরা নিজেদের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে ‘অক্ষমতা’ ভেবে ভাগ্যকেই গালমন্দ করেন। বাবা, মা, পরিবার তথা সমাজ যেভাবে যা বলে, তাকেই নিয়তি ধরে চুপচাপ নিজের ভেতরে গুটিয়ে নেন নিজেকে। তারা হয় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন নতুবা পরনির্ভরশীলতায় ভর করে জীবনধারণে অভ্যস্ত বা বাধ্য হন। এ অবস্থার জন্য আসলেই কি তারা নিজেরা দায়ী? নাকি সমাজ ব্যবস্থা?

পরিবার তথা সমাজের কাছ থেকে ‘পারবে না’ এ শুনে বেড়ে ওঠা প্রতিবন্ধীরা নিজেদের অযোগ্য ভাবতে বাধ্য হওয়ার জন্য সমাজ ব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন। এ সমাজ ব্যবস্থার সবধরনের নেতিবাচক ধ্যানধারণাই তাদের নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের জন্য সুযোগ প্রদান বা এর জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরিতে সবচেয়ে বেশি বাধা দেয়। প্রতিবন্ধী মানুষের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বের হয়ে আসার এবং নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য কাজ করার মতো করে তোলার গুরুদায়িত্ব কার বা কাদের ওপর বর্তাবে? যার চোখে দৃষ্টি এবং মুখে ভাষা উচ্চারণের সক্ষমতাসহ শ্রবণশক্তি আছে তিনি যেমন যোগ্য, ঠিক তেমনি যিনি দেখতে পান না পৃথিবীর আলো, শুনতে পারেন না শব্দরাশি, উচ্চারণ করে জানাতে পারেন না মনের ভাব, তিনিও অবশ্যই সমান যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারেন। যদি তাদের সবার চাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী সর্বত্র ব্যবস্থা থাকে। সামান্য উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। প্রতিবন্ধীদের কারও কারও দরকার স্বাধীন চলাফেরার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা। আবার কারও কারও জন্য র‌্যাম্প, ব্রেইল বা টেকটাইল দিকনির্দেশনা, সাঙ্কেতিক ভাষা ইত্যাদি নানা জরুরি ব্যবস্থা সবধরনের প্রতিবন্ধী মানুষই একটু সুযোগ পেলে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে পারেন। সুযোগ চাওয়া তাদের নায্য অধিকার। কিন্তু আমাদের সমাজে চাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পায় না। তাই অধিকারবঞ্চিত হতে হতে একসময় এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন প্রতিবন্ধীরা। সমাজ আজও ভাবতেই শিখেনি যে, তারাও পারেন। উন্নয়নমূলক কর্মকা- পরিচালনা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা প্রতিবন্ধী মানুষের আছে এটা আমরা কেউই বিশ্বাস করার চেষ্টা করি না। সম্ভবত প্রতিবন্ধীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এভাবেই। তাই নয় কি? প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণের বিষয়ে যেখানে কথা বলা যায়, সেখানে কাদের প্রতিনিধিত্ব বেশি জরুরি এ প্রশ্ন খোদ প্রতিবন্ধীরা নিজেরাও নিজেদের করেন না। ভাবলেও স্বীকার করতে চান না। প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন তাদের নিজেদের হাতে, অপ্রতিবন্ধী মানুষের হাতে নয়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত অপ্রতিবন্ধী মানুষ যখন নিচ্ছে, তখন প্রতিবন্ধীরা হয়তো কোনো এক মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে। কিন্তু নিজেদের ভেতরে জমে থাকা অপমানবোধ, দিনের পর দিন সয়ে যাওয়া বৈষম্য বা বঞ্চনার ভয়াবহ প্রকটতা ঐক্যবদ্ধভাবে দৃপ্তকণ্ঠে প্রকাশ করতে সাহস পান না। পরাধীনতার অদৃশ্য শেকলে আবদ্ধ বন্দিদশাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নেন তারা। প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন ও তাদের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম অপ্রতিবন্ধী মানুষ দ্বারা শোষিত এবং নিয়ন্ত্রিত, এটা স্বীকার করতে আমাদের ভেতরে একরাশ দ্বিধা-কুণ্ঠা-ভয়; অধিকারের প্রশ্নে সঙ্কোচ। কিন্তু কেন? প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আনতে পারে প্রণীত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন। তার আলোকে গড়ে ওঠা অধিকার ও সুরক্ষা আইন। কিন্তু একজন প্রতিবন্ধী মানুষ এ আইন সম্পর্কে কতটুকু জানেন। প্রতিবন্ধীদের জানা দরকার, অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে দুর্দান্ত এক হাতিয়ার রয়েছে তাদের হাতে। অধিকার আইনের সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের হাতে তুলে দিয়ে বসে থাকলেই সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত হয়ে যাবে না। শিশু না কাঁদলে মা খেতে দেয় না। চিৎকার করে জানান দিতে হয় শিশুকে তার চাহিদার কথা। প্রতিবন্ধী মানুষেরও নিজেদের অধিকারের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হতে হবে। নতুবা অধিকার অর্জনের জন্য কথা বলতে না পারায় সঙ্কোচই ‘দুর্বলতা’ ও ‘অক্ষমতা’ বলে প্রতিভাত হবে। সমাজের প্রতিবন্ধকতাগুলো তাদের ‘প্রতিবন্ধী’ করে রেখেছে। এর সম্মুখীন হওয়া তাদের অক্ষমতা নয়, অবস্থা মাত্র। সমাজের সবার মতো বসবাস করার সক্ষমতা তাদেরও আছে তা স্বীকার করতে হবে, জানান দিতে হবে। যদি সোচ্চার না হয় তবে চলার পথ বাধামুক্ত করা যাবে না। এজন্যই প্রতিবন্ধীদের অধিকার অর্জন ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সমাজের সবার অর্থাৎ প্রতিবন্ধী এবং অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমন্বয়ে একত্রে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সরকারের পাশাপাশি কাজ করতে হবে সবাইকে, নিজ নিজ জায়গা থেকে। আগামী প্রজন্মের জন্য অবস্থার পরিবর্তনের শুরু এখন থেকেই হওয়া দরকার। সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা। তবে আসবে পরিবর্তন। পরিবর্তন আসছে এবং পরিবর্তন হবেই।

কলামিস্ট

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রতিবন্ধীদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে : অধ্যক্ষ আসাদুল হক

আপডেট টাইম : ১১:৪৪:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

পত্রপত্রিকার পাতায় প্রতিবন্ধী মানুষের সাফল্য ও স্বপ্ন নিয়ে নানা খবরাখবর; এগিয়ে যাওয়া অদম্য জীবনের গল্প, সাদাছড়ি, হুইল চেয়ার, ক্র্যাচ ইত্যাদি বিতরণের তথ্য আমরা প্রায়ই পড়ে থাকি। দেখেশুনে মনে হতেই পারে যে, উন্নয়নের জোয়ার লেগেছে দেশে। জোয়ার লেগেছে বৈকি। জনগণ, অভিভাবক এবং প্রতিবন্ধী মানুষরাও তা জানতে পারছেন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। উন্নয়ন ‘কেন’, ‘কীভাবে’, ‘কোথায়’, এ জাতীয় শব্দ নিয়ে আমরা অনেকেই হয়তো মাথা ঘামাই; কিন্তু মুখ ফুটে কেউ প্রকাশ করি না।

আমরা বিবেকের তিন স্তরের কথা কমবেশি জানি- অন্তরের উপলব্ধি, মৌখিক স্বীকারোক্তি এবং সর্বশেষ শারীরিক শক্তি প্রয়োগ। অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি নির্বিশেষে সব মানুষের অবস্থা এ তিন স্তরের কাছাকাছিও যায় না। অন্তরের উপলব্ধির অভাব। জেনেবুঝেও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থমকে থাকা। বিশ্বাসের জন্ম হলে এ চিন্তা অকপট স্বীকারোক্তিতে রূপান্তরিত হতে সময় নেয়ার কথা জন্মায় মনে। আর এভাবেই বাস্তবায়িত হয় উন্নয়নের স্বপ্নগুলো। কিন্তু আত্মবিশ্বাসই যদি না থাকে! যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ! কিন্তু যোগ্যতার অভাব কেন? ঘাটতি কোথায়? অনেক যুগ আগের ক্রীতদাসদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন প্রভুর অধীনে থাকতে থাকতে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যেত তাদের মনের ভেতর, তাদের যেন নিজস্ব চিন্তাচেতনা-স্বপ্ন বলে কিছুই থাকতে নেই। ইচ্ছা নেই। অধিকার নেই। নিজে থেকে কিছু করার নেই জীবনে। একসময় তারা ভাবতে শুরু করত যে, প্রভুর অধীনে থেকে বেরিয়ে নিজ পায়ে ভর করে চলতেই পারবে না কখনও। তার চেয়ে এই বেশ ভালো আছি। এক ধরনের পরনির্ভরশীলতা বলা যায়। এ পরনির্ভরশীলতার চরম পর্যায়ে গিয়ে তাদের মনেই হতো না যে, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা যায়। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া যায়। মানুষের মৌলিক প্রাপ্য অধিকারগুলো না পেতে পেতে এক পর্যায়ে সেটা অর্জন করে নেয়ার ‘সাহস’ চরম ভুল বলে মন করা শুরু করত তারা।

প্রতিবন্ধী মানুষের শতকরা ৯৯ ভাগই সম্ভবত ঠিক এ অবস্থার ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। হাতেগোনা অল্পসংখ্যক সমাজের বিভিন্ন বাধার সঙ্গে অসম্ভব এক প্রতিকূলতার মাঝে লড়াই করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করে চলছেন অবিরাম। আর বাকি বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীরা নিজেদের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে ‘অক্ষমতা’ ভেবে ভাগ্যকেই গালমন্দ করেন। বাবা, মা, পরিবার তথা সমাজ যেভাবে যা বলে, তাকেই নিয়তি ধরে চুপচাপ নিজের ভেতরে গুটিয়ে নেন নিজেকে। তারা হয় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন নতুবা পরনির্ভরশীলতায় ভর করে জীবনধারণে অভ্যস্ত বা বাধ্য হন। এ অবস্থার জন্য আসলেই কি তারা নিজেরা দায়ী? নাকি সমাজ ব্যবস্থা?

পরিবার তথা সমাজের কাছ থেকে ‘পারবে না’ এ শুনে বেড়ে ওঠা প্রতিবন্ধীরা নিজেদের অযোগ্য ভাবতে বাধ্য হওয়ার জন্য সমাজ ব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন। এ সমাজ ব্যবস্থার সবধরনের নেতিবাচক ধ্যানধারণাই তাদের নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণের জন্য সুযোগ প্রদান বা এর জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরিতে সবচেয়ে বেশি বাধা দেয়। প্রতিবন্ধী মানুষের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বের হয়ে আসার এবং নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য কাজ করার মতো করে তোলার গুরুদায়িত্ব কার বা কাদের ওপর বর্তাবে? যার চোখে দৃষ্টি এবং মুখে ভাষা উচ্চারণের সক্ষমতাসহ শ্রবণশক্তি আছে তিনি যেমন যোগ্য, ঠিক তেমনি যিনি দেখতে পান না পৃথিবীর আলো, শুনতে পারেন না শব্দরাশি, উচ্চারণ করে জানাতে পারেন না মনের ভাব, তিনিও অবশ্যই সমান যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে পারেন। যদি তাদের সবার চাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী সর্বত্র ব্যবস্থা থাকে। সামান্য উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। প্রতিবন্ধীদের কারও কারও দরকার স্বাধীন চলাফেরার জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা। আবার কারও কারও জন্য র‌্যাম্প, ব্রেইল বা টেকটাইল দিকনির্দেশনা, সাঙ্কেতিক ভাষা ইত্যাদি নানা জরুরি ব্যবস্থা সবধরনের প্রতিবন্ধী মানুষই একটু সুযোগ পেলে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করতে পারেন। সুযোগ চাওয়া তাদের নায্য অধিকার। কিন্তু আমাদের সমাজে চাহিদার ভিন্নতা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পায় না। তাই অধিকারবঞ্চিত হতে হতে একসময় এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন প্রতিবন্ধীরা। সমাজ আজও ভাবতেই শিখেনি যে, তারাও পারেন। উন্নয়নমূলক কর্মকা- পরিচালনা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা প্রতিবন্ধী মানুষের আছে এটা আমরা কেউই বিশ্বাস করার চেষ্টা করি না। সম্ভবত প্রতিবন্ধীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এভাবেই। তাই নয় কি? প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণের বিষয়ে যেখানে কথা বলা যায়, সেখানে কাদের প্রতিনিধিত্ব বেশি জরুরি এ প্রশ্ন খোদ প্রতিবন্ধীরা নিজেরাও নিজেদের করেন না। ভাবলেও স্বীকার করতে চান না। প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন তাদের নিজেদের হাতে, অপ্রতিবন্ধী মানুষের হাতে নয়। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত অপ্রতিবন্ধী মানুষ যখন নিচ্ছে, তখন প্রতিবন্ধীরা হয়তো কোনো এক মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে। কিন্তু নিজেদের ভেতরে জমে থাকা অপমানবোধ, দিনের পর দিন সয়ে যাওয়া বৈষম্য বা বঞ্চনার ভয়াবহ প্রকটতা ঐক্যবদ্ধভাবে দৃপ্তকণ্ঠে প্রকাশ করতে সাহস পান না। পরাধীনতার অদৃশ্য শেকলে আবদ্ধ বন্দিদশাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নেন তারা। প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন ও তাদের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম অপ্রতিবন্ধী মানুষ দ্বারা শোষিত এবং নিয়ন্ত্রিত, এটা স্বীকার করতে আমাদের ভেতরে একরাশ দ্বিধা-কুণ্ঠা-ভয়; অধিকারের প্রশ্নে সঙ্কোচ। কিন্তু কেন? প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আনতে পারে প্রণীত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন। তার আলোকে গড়ে ওঠা অধিকার ও সুরক্ষা আইন। কিন্তু একজন প্রতিবন্ধী মানুষ এ আইন সম্পর্কে কতটুকু জানেন। প্রতিবন্ধীদের জানা দরকার, অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে দুর্দান্ত এক হাতিয়ার রয়েছে তাদের হাতে। অধিকার আইনের সুরক্ষার দায়িত্ব সরকারের হাতে তুলে দিয়ে বসে থাকলেই সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত হয়ে যাবে না। শিশু না কাঁদলে মা খেতে দেয় না। চিৎকার করে জানান দিতে হয় শিশুকে তার চাহিদার কথা। প্রতিবন্ধী মানুষেরও নিজেদের অধিকারের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হতে হবে। নতুবা অধিকার অর্জনের জন্য কথা বলতে না পারায় সঙ্কোচই ‘দুর্বলতা’ ও ‘অক্ষমতা’ বলে প্রতিভাত হবে। সমাজের প্রতিবন্ধকতাগুলো তাদের ‘প্রতিবন্ধী’ করে রেখেছে। এর সম্মুখীন হওয়া তাদের অক্ষমতা নয়, অবস্থা মাত্র। সমাজের সবার মতো বসবাস করার সক্ষমতা তাদেরও আছে তা স্বীকার করতে হবে, জানান দিতে হবে। যদি সোচ্চার না হয় তবে চলার পথ বাধামুক্ত করা যাবে না। এজন্যই প্রতিবন্ধীদের অধিকার অর্জন ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সমাজের সবার অর্থাৎ প্রতিবন্ধী এবং অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমন্বয়ে একত্রে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। সরকারের পাশাপাশি কাজ করতে হবে সবাইকে, নিজ নিজ জায়গা থেকে। আগামী প্রজন্মের জন্য অবস্থার পরিবর্তনের শুরু এখন থেকেই হওয়া দরকার। সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা। তবে আসবে পরিবর্তন। পরিবর্তন আসছে এবং পরিবর্তন হবেই।

কলামিস্ট