ঢাকা ০৪:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৃজনশীলের কারণে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:২৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ মে ২০১৮
  • ৩৬৩ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে ফলাফলের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল পদ্ধতি তুলনামূলক কম রপ্ত করতে পারছে। এটি রপ্ত করা বিষয়ে গ্রামের শিক্ষকেরাও শহরের তুলনায় পিছিয়ে। রয়েছে অভিভাবকদেরও সমস্যা। সব মিলিয়ে গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত ফলাফল করতে পারছে না। এ নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।

যেসব স্কুল থেকে এক সময় নিয়মিত অনেক শিক্ষার্থী প্রথম বিভাগ পেত, সৃজনশীল চালুর পর থেকে দেখা গেছে ওইসব স্কুল থেকে কখনো কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পায়নি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক শ’ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েও একজনও জিপিএ ৫ পাচ্ছে না।

জিপিএ পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে প্রথম বিভাগ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিশেষ মর্যাদা ছিল; কিন্তু এখন জিপিএ ৫ না পেলে তাদের তেমন মেধাবী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। জিপিএ পদ্ধতি চালুর পর মেধাবী শিক্ষার্থীর এখন একমাত্র মাপকাঠি যেন জিপিএ ৫।

এ অবস্থায় আগামীতে এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দিয়ে সব প্রশ্ন সৃজনশীলের আওতায় নিয়ে আসা হলে গ্রামের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন অনেক শিক্ষক।

গ্রামের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রতি বছরই আশা করে, কয়েকজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ অর্জন করতে পারবে; কিন্তু দেখা যায় কখনোই তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পায় না।

ময়মনসিংহ ত্রিশালে অবস্থিত আর জি উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, তাদের স্কুল থেকে এবার ৭২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে কেউই জিপিএ ৫ পায়নি। অনেকে চার দশমিক পাঁচ পেয়েছে। অথচ কমপক্ষে পাঁচজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাবে এমন আশা করেছিলেন শিক্ষকেরা।

কিশোরগঞ্জ কুলিয়ারচরে অবস্থিত আগরপুর গোকুল চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফারুক মিয়া জানান, তাদের স্কুল থেকে এ বছর ৩৯৪ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দুইজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পায়। আশা ছিল আরো অনেক বেশি।

পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আলকীরহাট হক বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো: আজিবুর রহমান শেখ বলেন, আমাদের স্কুল থেকে ৩৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩০ জন পাস করেছে। আটজন এ গ্রেড পেয়েছে; কিন্তু কেউ জিপিএ ৫ পায়নি। আমাদের আশা ছিল, অন্তত একজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাবে। আজিবুর রহমান বলেন, আমি ২৯ বছর ধরে শিক্ষকতা করি। সৃজনশীল আর জিপিএ ৫ পদ্ধতি চালুর আগে এ স্কুল থেকে নিয়মিত অনেক শিক্ষার্থী প্র্রথম বিভাগ পেত।

তিনি বলেন, শুধু সৃজনশীলের কারণেই গ্রামের শিক্ষার্থীরা ফলাফলে অনেক পিছিয়ে পড়ছে। গ্রামের অনেক শিক্ষকও এটা ভালো বোঝেন না এখনো। ছাত্রছাত্রীরা কী বুঝবে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের যদি এটা ভালোভাবে বোঝানো যেত, তাহলে তারা আরো ভাল ফলাফল করতে পারত।

চাঁদপুর মতলব থানায় অবস্থিত নীলনগর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, তাদের স্কুল থেকে এবার ৮২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। কেউ জিপিএ ৫ পায়নি। আমাদের আশা ছিল চার থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থী অন্তত জিপিএ ৫ পাবে।

গাজীপুর কাপাসিয়ায় অবস্থতি তারাগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক আইউব আলী জানান, তাদের স্কুল থেকে এবার ১৭৩ জন পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ৬ জন জিপিএ ৫ পায়। আশা ছিল আরো ৭ জন পাবে।

মানিকগঞ্জ দৌলতপুরে অবস্থিত বাঁচামারা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রউফ বলেন, তাদের স্কুল থেকে ২০০ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। কেউ জিপিএ ৫ পায়নি। সৃজনশীল পদ্ধতিসহ এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন গত বছর থেকে তাদের এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙনের কবলে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী এবং তাদের পড়ালেখায় ক্ষতি হয়।

রায়পুর লক্ষ্মীপুর হায়দারগঞ্জ হাসমতেন্নেসা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার ৬২ জন পরীক্ষায় অংশ নেয় কিন্তু কেউ জিপিএ ৫ পায়নি। যদিও বেশ কয়েকজনের পাওয়ার আশা করেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।

বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহরের শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতি বেশি ভালো বোঝেন। তা ছাড়া শহরের শিক্ষার্থীরা সাধারণ জ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে গ্রামের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। তাদের প্রকাশক্ষমতা যেমন বেশি, তেমনি দৃষ্টিভঙ্গিরও বিভিন্নতা রয়েছে। ফলে যেখানে শহরের একজন সাধারণ ছাত্রও অনেক সময় জিপিএ ৫ পায়, সেখানে গ্রামের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও সঠিক পরিচর্যার অভাবে ভালো ফল করতে পারছে না। এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফলে পিছিয়ে থাকার কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও তারা এখন অনেক সময় পিছিয়ে পড়ছে। অথচ আগে বিভিন্ন নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে গ্রামের শিক্ষার্থীদের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ে।

আগপুর গোকুল চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফারুক মিয়া বলেন, এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দেয়া হলে গ্রামের শিক্ষার্থীদের ফলাফল আরো ভয়ানক খারাপ হবে। এ কারণে তারা এমসিকিউ পদ্ধতির মাধ্যমে সহজে কিছু নম্বর পেত। তিনি বলেন, না বোঝার কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলে ভালো করতে পারছে না। এখন যদি এমসিকিউ তুলে দিয়ে পুরো পরীক্ষা সৃজনশীল করা হয় তাহলে তারা আরো খারাপ করবে।

তিনি বলেন, যখন সৃজনশীল, জিপিএ পদ্ধতি ছিল না তখনকার দ্বিতীয় শ্রেণী, তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরাও অনেক ভালো ছিল এখনকার অনেক ভালো ফলাফলকারীদের তুলনায়।

অনেক শিক্ষক-অভিভাবক জানিয়েছেন আগে যে পরীক্ষা এবং পড়ালেখার পদ্ধতি ছিল তাতে মা-বাবা অশিক্ষিত হলেও শিক্ষার্থীরা নিজেরা চেষ্টা করলে ভালো ফল করতে পারত। কোচিং প্রাইভেট ছাড়াও অনেক গরিব সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীরা নিজেদের চেষ্টায় অসাধ্য সাধন করত। কিন্তু বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে কোচিং প্রাইভেট নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু গ্রামের অনেক মা-বাবার সামর্থ্য নেই কোচিং প্রাইভেট পড়ানোর। আবার অনেক শিক্ষকও এটা ঠিকমত বোঝাতে পারেন না শিক্ষার্থীদের। ফলে গ্রামের সাধারণ মানের অনেক শিক্ষার্থী এ পদ্ধতির কারণে দিশেহারা অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু শহরের প্রায় সব শিক্ষার্থী কোচিং প্রাইভেটের দ্বারস্থ হচ্ছে। তাদের মা-বাবাও অনেক বেশি শিক্ষিত। ফলে তাদের জন্য এটি রপ্ত করা যত সহজ গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়টি তত সহজ নয়।

২০১৬ সালের শুরুতে প্রকাশিত সরকারি এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। এদের মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ শিকের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না। মাধ্যমিক ও উচ্চশিা অধিদফতরের (মাউশি) মনিটরিং শাখা প্রতিবেদনটি তৈরি করে। ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতির বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনটি বছরের শুরুতে প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় সৃজনশীল পদ্ধতির বাস্তবায়ন হার আগের বছরের তুলনায় নিমুখী হয়েছে। ২০১৪ সালের নভেম্বরের রিপোর্ট অনুযায়ী এ হার ছিল ৫৭ শতাংশ।

২০১৩ সালে মাউশি সারা দেশে সৃজনশীল পদ্ধতির বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে সরেজমিন তথ্যানুসন্ধান করে। ‘অ্যাকাডেমিক সুপারভিশন’ নামে ওই অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাত্র ৫৬ ভাগ স্কুল সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারে। এই পদ্ধতিতে একেবারেই প্রশ্ন করতে পারে না- এমন স্কুল রয়েছে ১৭ ভাগ। বাকি প্রায় ২৭ ভাগ প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাঝামাঝি পর্যায়ে।

তবে মাঠপর্যায়ের শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন বাস্তবে সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের হার আরো করুণ। সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ শিক এ পদ্ধতি বোঝেন। অন্যরা বোঝেন না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

সৃজনশীলের কারণে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা

আপডেট টাইম : ০৯:২৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ মে ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে ফলাফলের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল পদ্ধতি তুলনামূলক কম রপ্ত করতে পারছে। এটি রপ্ত করা বিষয়ে গ্রামের শিক্ষকেরাও শহরের তুলনায় পিছিয়ে। রয়েছে অভিভাবকদেরও সমস্যা। সব মিলিয়ে গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত ফলাফল করতে পারছে না। এ নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।

যেসব স্কুল থেকে এক সময় নিয়মিত অনেক শিক্ষার্থী প্রথম বিভাগ পেত, সৃজনশীল চালুর পর থেকে দেখা গেছে ওইসব স্কুল থেকে কখনো কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পায়নি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক শ’ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েও একজনও জিপিএ ৫ পাচ্ছে না।

জিপিএ পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে প্রথম বিভাগ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিশেষ মর্যাদা ছিল; কিন্তু এখন জিপিএ ৫ না পেলে তাদের তেমন মেধাবী হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। জিপিএ পদ্ধতি চালুর পর মেধাবী শিক্ষার্থীর এখন একমাত্র মাপকাঠি যেন জিপিএ ৫।

এ অবস্থায় আগামীতে এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দিয়ে সব প্রশ্ন সৃজনশীলের আওতায় নিয়ে আসা হলে গ্রামের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন অনেক শিক্ষক।

গ্রামের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রতি বছরই আশা করে, কয়েকজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ অর্জন করতে পারবে; কিন্তু দেখা যায় কখনোই তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পায় না।

ময়মনসিংহ ত্রিশালে অবস্থিত আর জি উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, তাদের স্কুল থেকে এবার ৭২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে কেউই জিপিএ ৫ পায়নি। অনেকে চার দশমিক পাঁচ পেয়েছে। অথচ কমপক্ষে পাঁচজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাবে এমন আশা করেছিলেন শিক্ষকেরা।

কিশোরগঞ্জ কুলিয়ারচরে অবস্থিত আগরপুর গোকুল চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফারুক মিয়া জানান, তাদের স্কুল থেকে এ বছর ৩৯৪ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দুইজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পায়। আশা ছিল আরো অনেক বেশি।

পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আলকীরহাট হক বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো: আজিবুর রহমান শেখ বলেন, আমাদের স্কুল থেকে ৩৪ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩০ জন পাস করেছে। আটজন এ গ্রেড পেয়েছে; কিন্তু কেউ জিপিএ ৫ পায়নি। আমাদের আশা ছিল, অন্তত একজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাবে। আজিবুর রহমান বলেন, আমি ২৯ বছর ধরে শিক্ষকতা করি। সৃজনশীল আর জিপিএ ৫ পদ্ধতি চালুর আগে এ স্কুল থেকে নিয়মিত অনেক শিক্ষার্থী প্র্রথম বিভাগ পেত।

তিনি বলেন, শুধু সৃজনশীলের কারণেই গ্রামের শিক্ষার্থীরা ফলাফলে অনেক পিছিয়ে পড়ছে। গ্রামের অনেক শিক্ষকও এটা ভালো বোঝেন না এখনো। ছাত্রছাত্রীরা কী বুঝবে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের যদি এটা ভালোভাবে বোঝানো যেত, তাহলে তারা আরো ভাল ফলাফল করতে পারত।

চাঁদপুর মতলব থানায় অবস্থিত নীলনগর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, তাদের স্কুল থেকে এবার ৮২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। কেউ জিপিএ ৫ পায়নি। আমাদের আশা ছিল চার থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থী অন্তত জিপিএ ৫ পাবে।

গাজীপুর কাপাসিয়ায় অবস্থতি তারাগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক আইউব আলী জানান, তাদের স্কুল থেকে এবার ১৭৩ জন পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ৬ জন জিপিএ ৫ পায়। আশা ছিল আরো ৭ জন পাবে।

মানিকগঞ্জ দৌলতপুরে অবস্থিত বাঁচামারা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রউফ বলেন, তাদের স্কুল থেকে ২০০ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। কেউ জিপিএ ৫ পায়নি। সৃজনশীল পদ্ধতিসহ এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন গত বছর থেকে তাদের এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙনের কবলে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী এবং তাদের পড়ালেখায় ক্ষতি হয়।

রায়পুর লক্ষ্মীপুর হায়দারগঞ্জ হাসমতেন্নেসা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার ৬২ জন পরীক্ষায় অংশ নেয় কিন্তু কেউ জিপিএ ৫ পায়নি। যদিও বেশ কয়েকজনের পাওয়ার আশা করেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।

বিভিন্ন জরিপ ও গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহরের শিক্ষকরা সৃজনশীল পদ্ধতি বেশি ভালো বোঝেন। তা ছাড়া শহরের শিক্ষার্থীরা সাধারণ জ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে গ্রামের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। তাদের প্রকাশক্ষমতা যেমন বেশি, তেমনি দৃষ্টিভঙ্গিরও বিভিন্নতা রয়েছে। ফলে যেখানে শহরের একজন সাধারণ ছাত্রও অনেক সময় জিপিএ ৫ পায়, সেখানে গ্রামের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও সঠিক পরিচর্যার অভাবে ভালো ফল করতে পারছে না। এসএসসি ও এইচএসসি ফলাফলে পিছিয়ে থাকার কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও তারা এখন অনেক সময় পিছিয়ে পড়ছে। অথচ আগে বিভিন্ন নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে গ্রামের শিক্ষার্থীদের সাফল্য ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ে।

আগপুর গোকুল চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফারুক মিয়া বলেন, এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দেয়া হলে গ্রামের শিক্ষার্থীদের ফলাফল আরো ভয়ানক খারাপ হবে। এ কারণে তারা এমসিকিউ পদ্ধতির মাধ্যমে সহজে কিছু নম্বর পেত। তিনি বলেন, না বোঝার কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলে ভালো করতে পারছে না। এখন যদি এমসিকিউ তুলে দিয়ে পুরো পরীক্ষা সৃজনশীল করা হয় তাহলে তারা আরো খারাপ করবে।

তিনি বলেন, যখন সৃজনশীল, জিপিএ পদ্ধতি ছিল না তখনকার দ্বিতীয় শ্রেণী, তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরাও অনেক ভালো ছিল এখনকার অনেক ভালো ফলাফলকারীদের তুলনায়।

অনেক শিক্ষক-অভিভাবক জানিয়েছেন আগে যে পরীক্ষা এবং পড়ালেখার পদ্ধতি ছিল তাতে মা-বাবা অশিক্ষিত হলেও শিক্ষার্থীরা নিজেরা চেষ্টা করলে ভালো ফল করতে পারত। কোচিং প্রাইভেট ছাড়াও অনেক গরিব সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীরা নিজেদের চেষ্টায় অসাধ্য সাধন করত। কিন্তু বর্তমানে সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে কোচিং প্রাইভেট নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু গ্রামের অনেক মা-বাবার সামর্থ্য নেই কোচিং প্রাইভেট পড়ানোর। আবার অনেক শিক্ষকও এটা ঠিকমত বোঝাতে পারেন না শিক্ষার্থীদের। ফলে গ্রামের সাধারণ মানের অনেক শিক্ষার্থী এ পদ্ধতির কারণে দিশেহারা অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু শহরের প্রায় সব শিক্ষার্থী কোচিং প্রাইভেটের দ্বারস্থ হচ্ছে। তাদের মা-বাবাও অনেক বেশি শিক্ষিত। ফলে তাদের জন্য এটি রপ্ত করা যত সহজ গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়টি তত সহজ নয়।

২০১৬ সালের শুরুতে প্রকাশিত সরকারি এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। এদের মধ্যে প্রায় ২২ শতাংশ শিকের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না। মাধ্যমিক ও উচ্চশিা অধিদফতরের (মাউশি) মনিটরিং শাখা প্রতিবেদনটি তৈরি করে। ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতির বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনটি বছরের শুরুতে প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় সৃজনশীল পদ্ধতির বাস্তবায়ন হার আগের বছরের তুলনায় নিমুখী হয়েছে। ২০১৪ সালের নভেম্বরের রিপোর্ট অনুযায়ী এ হার ছিল ৫৭ শতাংশ।

২০১৩ সালে মাউশি সারা দেশে সৃজনশীল পদ্ধতির বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে সরেজমিন তথ্যানুসন্ধান করে। ‘অ্যাকাডেমিক সুপারভিশন’ নামে ওই অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাত্র ৫৬ ভাগ স্কুল সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারে। এই পদ্ধতিতে একেবারেই প্রশ্ন করতে পারে না- এমন স্কুল রয়েছে ১৭ ভাগ। বাকি প্রায় ২৭ ভাগ প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাঝামাঝি পর্যায়ে।

তবে মাঠপর্যায়ের শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা এবং শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন বাস্তবে সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের হার আরো করুণ। সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ শিক এ পদ্ধতি বোঝেন। অন্যরা বোঝেন না।