ঢাকায় থেকে থেকে মনটা ছোট হয়ে গিয়েছিল

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ঢাকায় থেকে থেকে মনটা খুব ছোট হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার জ্যাম, বিশ্রী পাবলিক পরিবহন, মানুষের ভীড়, গাড়ির অবিরাম বিকট হর্ন, নিষ্ঠুর নানা প্রতিযোগিতা দেখে দেখে ভুলেই গিয়েছিলাম বাংলাদেশ একটা সুন্দর দেশ; যে দেশে নদী আছে, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ আছে, অচেনা খালের বাঁক আছে, সাগর আছে, বিশ্বের দীর্ঘতম সাগর সৈকত আছে, পাহাড় আছে। ভুলেই গিয়েছিলাম সূর্য উদয় আর অস্ত চুপচাপ বসে দেখা যায় এদেশে, ভুলে গিয়েছিলাম যে দেশের সব রাস্তা ভাঙা নয়; অনেক রাস্তা আছে খুব মসৃণ। তাও সাধারণ রাস্তা নয়, এ রাস্তার একপাশে সবুজ পাহাড়, আরেক পাশে নীল সাগর।

আজীবন পাহাড়, সাগর আর নদীর সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ আমাদের হয়ত কখনো হবে না; কিন্তু কয়েকদিন সে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে মনে হচ্ছে এই মানুষ আর ইট–পাথরের জঙ্গলে টিকে থাকার জ্বালানী ভালোই সংগ্রহ করা গেল। ৩০ এপ্রিল উবারের গাড়িতে জ্যাম ঠেলে কমলাপুর রেলস্টেশন পৌঁছে রাতের মহানগর দিয়ে পরিবার সমেত যে যাত্রার শুরু করেছিলাম, সে যাত্রা ৫ তারিখ পর্যন্ত ক্রমশ আকর্ষণীয় এবং মনোমুগ্ধকর হয়েছে। প্রকৃতি আমাদের হতাশ করেনি মোটেই। এমনকি হঠাৎ কালবোশেখি ঝড়ের হুমকি বা আকাশ ভেঙ্গে মেঘের পতনও আমাদের ভ্রমণে নূতন মাত্রা যোগ করেছে। অবকাশ যাপনে যতটুকু অসঙ্গতির অস্তিত্ব ছিল, সেটা একান্তই আমার, আপনার মত মানুষের একটা অংশের সৃষ্টি। তবে জনপ্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের কোনো কাজ আমাদের মনে ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।

মে মাসের ১ তারিখে ভোরের স্নিগ্ধতায় যখন চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে গিয়ে গতরাতের মহানগর গিয়ে পৌঁছল, তখন শরীর জুড়ে ক্লান্তি থাকলে নতুন জায়গা দেখার আনন্দে তা খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ট্রেনের ভেতরে সারারাত ঘুম আসেনি খুব একটা। এসি বগি হলেও লাইট অফ করা হয়নি। এটেনডেন্ট জানালেন, এসি বগিতে লাইট নিরাপত্তাজনিত কারণে অফ করা হয় না। ৬/৭ ঘণ্টার ভ্রমণে ঘুমাতে না পারলে শরীর ক্লান্ত হবেই । তবে কেবিনে তুলনামূলক আরাম। কিন্তু সবাই তো আর এসি বগি আর কেবিনে যাবে না। তাছাড়া মহানগরে নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া এবং কসবার হাজার হাজার যাত্রী উঠেন। ঢাকার কাছের জেলাগুলোর জন্য বিশেষ ভালো ট্রেনের ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলে কাছের এবং দূরের সব যাত্রীই আরামে আসা-যাওয়া করতে হবে। এসি বগিতে এত ভিড় ছিল যে, প্রথম তিন ঘণ্টায় টয়লেটে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ ছিল। কসবা পার হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা ফাঁকা হয় ট্রেন। সে সুযোগে টয়লেটে ঢুকে বমি চলে আসার উপক্রম। আমরা ছেলেরা এই গন্ধে টিকতে পারি। কিন্তু ছোট বাচ্চা বা বউ-বাবা-মাদের জন্য খুব কষ্ট। একটা এসি বগির টয়লেট এই ২০১৮ সালে এসে এত দুর্গন্ধময় হবে, ভাবলে খারাপ লাগে খুব। এসি বগির টয়লেট যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে ননএসি বগির গুলোর অবস্থা কেমন হয় সেটা ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়।

এরপরেও মানুষ ট্রেনকেই বেছে নেয়, কারণ সড়ক পথে এখন চট্টগ্রাম থেকে আসা-যাওয়া নাকি ১৭/১৮ ঘণ্টাও লেগে যায়। তবে এই রুটে সরকার প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করছে, হয়ত সে কারণেই জ্যাম বেড়েছে। আশা করি একদিন এই কর্মযজ্ঞ শেষ হবে, মানুষ সরকারের উন্নয়ন কর্মের সুফল ভোগ করে বলবে, ‘জয়বাংলা’। ১ তারিখ ভোরে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে নেমে মোটেল সৈকত এ যাওয়ার জন্য নতুন চালু হওয়া সার্ভিস উবার সার্চ করলাম। না পেয়ে সিএনজি অটোরিকশার চালককে বলাতে সে বলল, দুই মিনিট হেঁটে গেলেই মোটেল সৈকত পাবেন। আসলেই তাই, আমি জানতাম না যে এত কিছু আমাদের থাকার জায়গা! কিন্তু ছোট বাচ্চা নিয়ে সেই ভোরে এই রাস্তা পাড়ি দিতেই বুঝে ফেললাম, মানুষ এই চট্টগ্রাম শহরকেও ঢাকার মত ময়লা করে ফেলছে। একদিন চট্টগ্রাম ছিলাম। বাংলাদেশ নেভাল একাডেমীর অভ্যন্তরে সাগর সান্নিধ্য, যাওয়ার পথে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে দূরে ছোট-বড় জাহাজ দেখে মনে হল ঢাকায় তো কিছু নেই, সব দেখি চট্টগ্রামে! দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী তো এমনি এমনি বলা হয় না।

তবে চট্টগ্রাম যে কত সুন্দর একটি জায়গা সেটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গিয়ে বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করেছি। পাহাড়, লেক, বুনো নানা পশু-পাখি, জঙ্গল ইত্যাদির সমন্বয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাস এলাকা এক অজানা সৌন্দর্য নিয়ে বিরাজমান। কিছু এলাকা বাদে নানা স্থানে বাইরের মানুষ ঘুরতে আসতে পারে। সানসেট পয়েন্ট আছে একটা। সেখানে বাইরের সবাই বসে চা-কফি খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখে মুগ্ধ হতে পারেন। চট্টগ্রাম শহর হতে পারত বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সুন্দর শহর। নদী,সাগর, পাহাড় আছে যে শহরকে ঘিরে সে শহর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর হবে না, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এই শহরে কীভাবে রাস্তায় পানি জমে, বৃষ্টিতে মানুষের ঘরে পানি ঢুকে আমাদের মাথায় ঢুকে না। শুধু বুঝতে পারি, দুর্নীতিবাজ আমলা আর রাজনীতিবিদরা পুরো দেশের মত চট্টগ্রামকেও ধ্বংস করে দিতে চাইছেন।

পরের দিন সকালে এসি বাসে করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। রাস্তায় একটি চমৎকার রেস্টুরেন্ট এ যাত্রা বিরতি হল। ৪ ঘণ্টা ভ্রমণ করে কক্সবাজারে গিয়ে পৌঁছলাম। কক্সবাজার শহরের ডলফিন মোড়ে নেমে অটো রিকশায় করে হোটেল সিগালে পৌঁছলাম। সাগর দেখতেই যেন পৃথিবীটা আমাদের বদলে গেল! পুরো পৃথিবী নীল বর্ণ ধারণ করল। আকাশ নীল, সাগর নীল, হোটেল নীল, সুইমিং পুল নীল। শুধুই নীলের খেলা। হোটেলে ঢুকে রুম পেতে একটু বিলম্ব হয়েছিল। খানিক বাদে রুমে ব্যাগ রেখে, লাঞ্চ সেরে বিকেলে যখন সাগর পাড়ে যখন গেলাম তখন ভুলে গেলাম আমার পেশাগত পরিচয়ের কথা। মনে হল, এখানে আমার পরিচয় একটাই, আমি একজন পর্যটক। হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে আমি আজ আমার গন্তব্যে পৌঁছেছি। সাগর যেন নাটোরের বনলতা সেনের মত আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছে।

সাগরের পাড়ের কটা দিন শুধুই মুগ্ধতা উপহার দিয়েছে। হোটেলের সবুজ লন, সুইমিং পুল, শিশুদের খেলার জায়গা, সামনের ঝাউবন, সাগর সৈকতের পেশাদার ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরায় চমৎকার সব ছবি তোলা, সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে খেলা করা, ওয়াটার বাইকে সাগরের পানিতে ছুটে চলা, সৈকতে মোটর বাইক চালানো, ঘোড়ায় সওয়ারি হওয়া, সৈকতের চেয়ারে বসে সাগরের উত্তাল বিশালত্ব উপভোগ করা ইত্যাদি নানা আয়োজন কক্সবাজার সফরকে যে কোন মানুষের জীবনে অমর স্মৃতি করে রাখবে। ট্র্যাডিশনালি এই সময়টা কক্সবাজারের জন্য অফ-সিজন হলেও টানা ছুটি পেয়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসেছিল বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে।

কক্সবাজারে এবার আমার প্রথম সফর না। ফলে আমার নাগরিক চোখে কিছু পরিবর্তন ধরা পড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ ভালো। টুরিস্ট পুলিশ খুব তৎপর। সন্ধ্যা নামলেই টর্চ হাতে সৈকতের নানা স্থানে পুলিশের টহল। দারুন স্মার্ট পোশাক আর বাহন নিয়ে টুরিস্ট পুলিশ তৎপর হয়ে উঠে। এই সুযোগে রাত ১২/১ টা পর্যন্ত সৈকতে মানুষের ভিড় লেগে থাকে। বিশেষ করে ভালো হোটেলগুলোর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সৈকত ব্যবস্থাপনা আছে। সেখানে পুলিশের পাশাপাশি নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী নিয়োজিত থাকে। নিজের দামি জিনিসপত্র বিচের উপরে রাখা বাক্সে হেফাজতে রেখে সাগরে ইচ্ছেমত মজা করা যায়। সৈকতের উপর একটি বাদামের খোসা ফেললেও নিরাপত্তা এবং পরিচ্ছন্ন কর্মীরা এসে বাধা দিবে। এতে করে মানুষের মাঝেও সচেতনতা বেড়েছে।

সৈকতের সময়কে অমর করার জন্য আছে কয়েকশ ফটোগ্রাফার। জেলা প্রশাসন থেকে এসব ফটোগ্রাফারদের তালিকা এবং নির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্দ করা আছে, নির্দিষ্ট পোশাকও আছে এদের। লিমিটেড সংখ্যার ছবি তোলে সফট কপি নিয়ে নিলে দিতে প্রতি ছবি পাঁচ টাকা। আর ছবি যদি হয় অসংখ্য তাহলে দিতে হবে তিন টাকা করে। ফটোগ্রাফারদের অনেকের ইনকাম মাসে এক লাখ টাকাও আছে। তবে বেশিরভাগের ইনকাম মাসে ৩০/৪০ হাজার টাকা। লাভবান হওয়ায় অনেক যুবক ক্যামেরা কিনে এই পেশায় ঝুঁকছে। এরা আপনার ছবি তোলে আপনাকে দিয়ে ডিলিট করে দিবে। প্রশাসনের প্রতি এরা খুব অনুগত।

কক্সবাজারে গিয়ে কেউ যদি মেরিন ড্রাইভ না দেখে আসে তাহলে তার সফর পরিপূর্ণতা পাবে না। এক অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। একপাশে পাহাড়, আরেকপাশে সাগর। মাঝখান দিয়ে মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার। ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক মেরিন ড্রাইভ বঙ্গোপসাগর এর পাশ দিয়ে কক্সবাজারের কলাতলী সৈকত থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বর্তমানে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক। ২০১৭ সালের ৬ মে এটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এটি নির্মাণ করে নিজেদের এবং বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।

তবে মেরিন ড্রাইভ খুব মসৃণ হলেও কক্সবাজার শহরের রাস্তাঘাট অনেকাংশে ভাঙ্গা এবং খানা-খন্দে ভরা। কক্সবাজার এমনিতেই সারা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর। তদুপরি রোহিঙ্গা সংকটের ফলে এই শহরে বিদেশি মানুষের আগমন খুব বেশি এখন। এই বিদেশিদের বড় একটা অংশ কক্সবাজারে নিয়মিত থাকছেন। ফলে কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে সরকার আরও ব্যপকভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। এতে কক্সবাজারের সুনাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। বিদেশি পর্যটক আসলে দেশের অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে কক্সবাজার বিমানবন্দরের অবকাঠামো আরও উন্নত করতে হবে। যাত্রীদের একটু ভিড় বাড়লেই ওয়েটিং রুমে বসার জায়গা পাওয়া যায় না। ভেতরে স্ন্যাক্স/হালকা খাবারের কোন দোকান নেই। একটা টং দোকান আছে শুধু বাইরের দিকে। তাছাড়া আনসার/পুলিশ/সিভিল এভিয়েশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা পর্যটকদের কাছে টিপস চায় যেটি একটা বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনার জন্য ভালো কিছু নয়।

কক্সবাজার শহরের মর্যাদা এবং আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে নতুন একটি স্থাপনা। রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড। নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর বিশাল এক একুরিয়াম এই ফিশ ওয়ার্ল্ড। শিশু-কিশোরদের জন্য তো বটেই, বড়দের জন্যও এই ফিশ ওয়ার্ল্ড এক বিস্ময়কর জায়গা। অনেক অজানারে জানার সুযোগ করে দিয়েছে এই ফিশ ওয়ার্ল্ড।

ঢাকা থেকে যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও আরামদায়ক, দ্রুত আর সস্তা করতে পারলে দেশ-বিদেশের আরও পর্যটক আসবে কক্সবাজারে। আমরা যারা নগরের নানা যন্ত্রণায় হাঁপিয়ে উঠেছি, তাদের জন্য এই কক্সবাজার,  সেইন্টমারটিন, টেকনাফসহ , তিন পার্বত্য এলাকা সুন্দরের এক আজব পৃথিবী নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। সুযোগ করে সবারই যাওয়া দরকার সে সুন্দর পৃথিবীতে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর