কিশোরগঞ্জ হাওরে হাওরে ধান কাটার ধুম ও উৎসব

জাকির হোসাইনঃমাথার ওপর সুর্য খাঁ খাঁ করছে। কাঠফাঁটা রোদে বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারো।

এমনকি, প্রকৃতিকে ভ্রুকুটি হেনে কেউ কেউ বেসুরো গলায় প্রিয় কোনো গানের দু’এক লিরিক গাইছেন কখনো কখনো জমিনে আইলে আইলে ঘুরছেন।

তবে এখন সবার মন নিবিষ্ট কাজে। সেখানে কারো বিরাম নেই।কি চাকুরীজীবী,কি সাহেব, কি ছেলে, কি বুড়ো। পরিবারের সবাই নিজ জন্মভূমিতে এসেছেন বিস্তীর্ণ হাওরের বুকে ধান কাটার এ উৎসবে অংশগ্রহন করতে ।এসেছেন হাওর এলাকার এমপি ও।

Image may contain: one or more people and outdoor

বোরো ধান কাটার এ উপলক্ষকে স্বচক্ষে দেখে উৎসব না বলে উপায়ও নেই। যেদিকে চোখ যায় হাওরের বুকজুড়ে নানা বয়সী মানুষের বোরো মৌসুমের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যস্ততা।

সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলাগুলোর বিভিন্ন হাওর ঘুরে এরকম দৃশ্য চোখে পড়ে আমার।

হাওরে ধান কাটার এই ধুম মানেই এক মাসের অন্যরকম এক উৎসব। এ উৎসব চলবে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে।

ধান গোলায় তোলার এই উৎসবের কাছে তুচ্ছ বৈশাখে আগুন ঢালা রোদ, কালবৈশাখীর চোখ রাঙানি, বৃষ্টি কিংবা শারীরিক পরিশ্রম সবকিছু। মিঠামইন,ইটনা ও অষ্টগ্রাম উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েকটি হাওরে সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পেলাম, বোরো ধান কাটার এ উৎসবে শুধু কিষাণ-কিষাণীই নয়, বাড়ির সব বয়সী মানুষই এসে হাত লাগিয়েছে।

Image may contain: one or more people, people standing, people walking, sky, outdoor and nature

 

এদের কেউ খেত থেকে ধান ‍কাটছে। কেউ কেউ খেতেরই ফাঁকা স্থানে ‘খলা’ (ধান মাড়াই ও শুকানোর স্থান) তৈরিতে ব্যস্ত। এ খলা তৈরিতে প্রধান ভূমিকা অবশ্য কৃষাণীদের। ধান উৎসবের এই একটি মাস খলাতেই কাটে তাদের সারাদিন ও সারারাত।

এদিকে, বোরো ধান কাটার ধুম পড়ায় এ সময়টাতে এ অঞ্চলের প্রত্যেক কৃষক পরিবারেই কর্মক্ষম লোকের প্রয়োজন পড়ে। ফলে যাদের পরিবারে সমর্থ লোকের স্বল্পতা তারা নিয়ে আসেন ভিনদেশী শ্রমিক।

হাওর অঞ্চলে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এ মৌসুমে ধান কাটতে আসা শ্রমিকদের এখানকার মানুষেরা বলেন দাওয়াইল্লা।

Image may contain: outdoor and nature

ধান কাটা, মাড়াই ও গোলায় তোলা অব্দি এ দাওয়াইল্লারা খেতেই বিভিন্ন উরা (খড়ের তৈরি ঘর) তৈরি করে বসবাস করেন। পুরো মৌসুমজুড়ে মাঠেই চলে তাদের ‍নাওয়া-খাওয়া।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় দাওয়াইল্লাদের পারিশ্রমিক হিসেবে নগদ অর্থ দেওয়ার চল থাকলেও হাওরে ভিন্নতা দেখা যায়। এ অঞ্চলে দাওয়াইল্লাদের একরপ্রতি বোরো জমির ধান কাটলে এক মণ থেকে দুই মণ ধান তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে তাদের দেওয়‍া হয়।

Image may contain: one or more people, outdoor and nature

মিঠামইন,ইটনা ও অষ্টগ্রাম এসব হাওর ঘুরে দেখা পেলাম, এ বছর বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে যারা বেশি জমির মালিক তাদের খুশি বেশি। ধান কাটা শেষে ইঞ্জিনচালিত ট্রাক্টর,গরু গাড়ি,ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে তা জমি থেকে খলায় নিয়ে আসা হচ্ছে। খলায় বুংগা মেশিন (মাড়াই কল) দিয়ে চলে মাড়াই। পরে সেখানেই শুকানো হচ্ছে মাড়াইকৃত ধান। তীব্র রোদে শুকানো ধান বস্তাভর্তি করে নিয়ে যাওয়‍া হচ্ছে গোলায়।

এদিকে, ধান মাড়‍াই শেষে বন (খড়) রোদে শুকানো হচ্ছে। পরে ‍তা সেখানেই বনগাছ (খড়ের গাঁদা)গ্রামের ভাষা বনের পাড়া দিয়ে রাখা হবে।

এছাড়া জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম,নিকলী ও তাড়াইল উপজেলার হাওরে লেগেছে বোরো কাটা ও মাড়াইয়ে ধুম।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মতে, এই মৌসুমে অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন, নিকলী, বাজিতপুর ও তাড়াইলের হাওর এলাকায় প্রায় এক লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে এই এলাকাতে।

Image may contain: sky, house, outdoor and nature

এই সব হাওর এলাকা ঘুরে জানা যায়, হাওরাঞ্চলের ৯৫ ভাগ মানুষ একমাত্র ফসল বোরো উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। এ ধান তাদের নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

এদিকে, কার্তিক মাসে বোরো বীজতলা থেকে শুরু করে বৈশাখে ধান কাটা ও মাড়াই পর্যন্ত কয়েক মাসে এ অঞ্চলে বাড়তি কয়েক হাজার শ্রমজীবী নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। এ সময়ে কাজ করে অন্তত সাত-আট মাসের ঘরের খাবারের সংস্থান করে ‍স্থানীয় দরিদ্র ও দিনমজুর পরিবারগুলো।

মিঠামইন উপজেলার ঢাকী ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের কয়েক জন কৃষক জানান, এ বছর তাদের এলাকায় বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। যদি কোনো গজব (বৈরী প্রকৃতি) না আসে, তবে এবার তাদের ঘরের গোলা ভরে যাবে ইনশাল্লাহ।

Image may contain: sky, house, outdoor and nature

অষ্টগ্রাম উপজেলার একজন কয়েকজন কৃষক জানান, তার ধানের জমি ২৫ একর। তার আশা আবহাওয়া ভালো থাকলে এ জমি থেকে অন্তত ১২০০থেকে ১৫০০ মণ ধান পাবেন।

প্রতিবছর ৮-১০ জনের একটি দল নিয়ে হাওরে ধান কাটতে আসেন। তারা এখানে মাঠেই উরা তৈরি করে থাকছেন।
এই এক মাসের কাজ শেষে তারা ১০ জনে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ মণ ধান পাবেন বলেও জানান।

হাওর বার্তা

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর