হাওর থেকে ঘুরে এসেঃগরুর দলটির পানিতে সাতানোর সময় আগে পিছে কাউকে দেখা গেলো না। কিন্তু দলটি স্কাউট সদস্যদের মতো সুশৃঙ্খলভাবে সিরিয়াল হয়ে এলেংজুরির নদীতে সাতার কাটছে । গরুগুলো যেখানে ছিল তার চারদিকে পানি আর পানি। জেগে থাকা এক চিলতে জমি।
হাওর (কিশোরগঞ্জ) গরুর দলটির আগে-পিছে কাউকে দেখা গেলো না। কিন্তু দলটি স্কাউট সদস্যদের মতো সুশৃঙ্খলভাবে এলেংজুরির নদীতে নামছেও সাতার কেটে নদী পারাপার হচ্ছে। গরুগুলো যেখানে ছিল তার চারদিকে পানি আর পানি। জেগে থাকা এক চিলতে জমি। তাতে ঘাস খাপয়ার জন্য তারা সাতার কেটে পার হচ্ছে গরুরপাল। এরপর কী করে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম সাঁতরে সড়কে উঠে এলো।
গরুগুলোর এমন আচরণ দেখে বেশ অবাক লাগলো। হাওর এলাকায় আগে দেখেছিলাম, গরু নদী পার করার জন্য তিন জনের কসরত। একজন সামনে থেকে রশি টানছে, আর দুইজন পেছন থেকে পানির দিকে ঠেলছে গরুকে। রশি টানার কারণে জিহ্বা বেরিয়ে আসতে চাইছে তবুও পানিতে নামতে চায় না গরুটি। কখনও কখনও শপাত-শপাত করে বেতও মারা হচ্ছিলো। আবার ধাক্কা দিয়ে নদীতে নামিয়ে দিলেও ফিরে আসতে দেখা গেছে।
উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ গরু পানি দেখলে ভয়ে পালিয়ে যায়। কতগুলো তো পানিতে জন্মানো ঘাসও মুখে দেয় না। আর এই অঞ্চলের গরুর মধ্যে কতো ফারাক, জাত এক হলেও স্বভাব প্রায় পুরোটাই আলাদা। এসব গরু নিজ থেকে সাঁতরে ঘাস খেতে যাচ্ছে। আর বিকেলে সাঁতরে ফিরে আসছে ঘরে। দেশের উত্তর-পশ্চিমে গরুর যে বিষয়গুলেযা কল্পনাও করা যায় না, উত্তর-পূর্বে সেটাই বাস্তবতা।
হাওর অঞ্চলে এখন কিছু-কিছু জমিতে ধান কাটা শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ মাঠেই এখন ফাঁকা আছে। সে কারণে কোনো গরু ছাগলের গলার রশি দেখা গেলো না। সবই ছেড়ে দেওয়া। ইচ্ছা মতো ঘুরে ফিরে আহার করছে। কয়েক দিনের বর্ষণের ফলে হাওর ও বিলের পানি বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ ঘাসি জমি তলিয়ে গেছে। যেখানে দু’একটি জেগে আছে সেখানে গিয়ে ভিড় করছে পুরো গ্রামের গরুরপাল। কোথাও কোথাও কোমর পনিতে ঘাসের সবুজ মাথা উঁকি দিচ্ছে। সেই ঘাস খাওয়ার জন্য কতগুলো আবার বুক পর্যন্ত পানিতে সপে দিয়েছে নিজেকে।
গরুগুলোর এই আচরণ নিয়ে যখন নিজেদের মধ্যে কথা হচ্ছিলো। তখন সহকর্মীরা জানালেন আরও চমকপ্রদ তথ্য। তিনি হাওরে সফরের সময় দেখেছেন, ভাটার সময় একটি গুরু শুকনো জায়গায় ঘাস খাচ্ছিলো। একটু পরে জোয়ার এলে গেওয়া গাছের কাণ্ড তলিয়ে যায়। আর সেই সুযোগে গরুটি সাঁতরে গিয়ে গেওয়ার পাতা মুচড়ে উদরপূর্তি করে। পানি না থাকলে ওই গাছটির পাতা নাগাল পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। কিন্ত জোয়ারের সুযোগে সেই কাজটি সেরে নিলো।
কোথাও কোথাও বিশাল বড় মহিষের পালও দেখা যায়, পানিতে বুক ডুবিয়ে কচুরিপানা খাচ্ছে। এই হাওরঅঞ্চলে গরু নেই এমন কৃষক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কম করে হলে একটি গরু আছে। বেশির ভাগেই বাড়িতেই রয়েছে দশ-বারোটি করে গরু। গরুর পাল দেখাশুনার জন্য রাখাল অথবা চুক্তি করারও রেওয়াজ প্রচলিত আছে।
আপাত দৃষ্টিতে গরু পালন সহজ মনে হলেও আমন রোপণের পরে গরু পালনকারীরা পড়েন বিপাকে। তখন পুরো মাঠ বন্ধ হয়ে যায়। আবার বন্যা এলে সব তলিয়ে যায় তখন দুর্গতির অন্ত থাকে না গৃহপালিত এই পশুগুলোর।
গরুগুলোর যেমন স্বভাব আলাদা। তেমনি মানুষের জীবনচিত্রও আলাদা। বেশিরভাগ মানুষ মৌসুমের সঙ্গে তাদের পেশাও পাল্টে ফেলেন। বলা যায় পেশা পাল্টাতে তারা বাধ্য হন। অনেক এলাকার মানুষ যখন পাকা রাস্তার জন্য কাঙাল, কেউ বা আবার পাকা রাস্তার ধারে গিয়ে বাড়ি করেন। কিন্তু এ অঞ্চলে তার যেন কোনই বালাই নেই। তা না হলে গ্রাম ছেড়ে হাওরের ভেতরে (নতুন নামকরন) গিয়ে কেন ঘর তুলবেন। এই জায়গা গুলোতে বছরের ৮ মাস থাকে পানিবন্দি। নৌকা ছাড়া কোনোই গতিই থাকে না তাদের।
স্বাস্থ্য-শিক্ষা, হাটবাজার কিছুই নেই । গাড়ি তো দূরের কথা, বাড়ি পর্যন্ত রিকশা নিয়ে যাওয়া দুষ্কর। খুব শিগগিরই যে তাদের এই অবস্থার উন্নতি হবে, সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে এই হাওরে। ( ছবি নেওয়া হাওর এলাকার এমপির ফেইজবুক থেকে)