রাজউকের মালেকের হাতে আলাদ্দিনের চেরাগ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৮৩ সালে গার্ডের চাকরি থেকে শুরু। সোনার হরিন রাজউকের এ চাকরি পাওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৩৫ বছরের চাকরি জীবনে পদোন্নতি পেয়ে তিনি এখন উচ্চমান সহকারী।

কিন্তু তাতে কি? চাকরি জীবনে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। আর যেহেতু চাকরি যেহেতু রাজউকে প্লট বা ফ্ল্যাট না থাকলে বেমানান লাগে। উচ্চমান সহকারী হলেও ঢাকা শহরের ৬/৭ প্লট আর  ৩টি বাড়ির মালিক। এমনকি মেয়েকে মালিকানা দিয়ে বানিয়েছেন রিয়েল এষ্টেট কোম্পানিও।

রাজউকের বিশাল ক্ষমতাধর মালেকের কথাই বলছি। মালেকের এ উথ্যানে অনেক বড় বড় কর্মকর্তাও ভ্রুকুঁচকে যায়। কিন্তু কথা বলার সাহস নেই। মালেক এখন রাজউকের সবচেয়ে আলোচিত এবং দূর্নীতিবাজ কর্মচারীর তালিকায় সবার উপরে। বর্তমানে দূর্নীতি দমন প্রতিরোধ সপ্তাহ শুরু হয়েছে। রাজউকের আলোচিত এ কর্মচারীর বিরুদ্ধে যে কোন সময় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে বলেও আভাস রয়েছে।

মাদারিপুরের শিবচরের নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা অর্ধশিক্ষিত এ ব্যক্তিটি রাজউকের যে কোন অফিসারের চাইতে অনেক ক্ষমতাবান। বিশেষ কৌশলে তিনি এখন কোটিপতিদের তালিকায় সবার উপরে। বাড়ি গাড়ি কি নেই তার। উচ্চমান সহকারী এমন বিলাসী জীবন রাজউকের আলাদ্দিনের চেরাগের মতই সবাই গল্প করে। কিন্তু গল্পতেই সীমাবদ্ধ। রাজউক চেয়ারম্যান যখন দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন তখন মালেক সিবিএ’র রুমে বসে মিটমিটিয়ে হাসেন। অন্য কর্মচারীরা যেখানে ভয়ে তটস্থ সেখানে মালেক তার দূর্নীতি অবলীলায় চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এমন অবস্থা রাজউকে তাকে ছোঁয়ার মত খোদ চেয়ারম্যানেরও ক্ষমতা নেই।

জানা গেছে, তার তিন মেয়ে। বড় মেয়ে শারমিন আক্তার জলি উত্তরার মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অধ্যায়নরত, মেজো মেয়ে মাসুমা আক্তার মিথি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ছোট মেয়ে জেসমিন আক্তার অ্যামি ঢাকা ন্যাশনাল আইডিয়ালের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। দুর্নীতি দমন কমিশনে একের পর এক অভিযোগ যাওয়ার পর থেকে এই তিন মেয়ের নামেই এখন সবকিছু। দূর্নীতি দমন কমিশন সবকিছু নিয়ে তদন্ত করছে। তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে।

 অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাকুরি জীবনে দূর্নীতির মাধ্যমে রাজধানীতেই তার রয়েছে তিনটি বাড়ি। এগুলো হলো আফতাবনগরের বি ব্লকে একটি, এফ ব্লকে একটি আর বাড্ডার ডিআইটিতে একটি। বাড্ডার ডিআইটির বাড়িতে থাকেন তিনি । আর বাকিগুলো ভাড়া দেয়া। এছাড়াও রয়েছে তিনটি গাড়ি। গাড়ি গুলো হলো এলিয়ন-ঢাকা মেট্রো গ-৩৯-১১০২, এক্সিও করোলা ঢাকা মেট্রো গ-২৮-৩১৪২, নোয়া ঢাকা মেট্রা চ-১৯-১১৬৮।

আফতাবনগরের বাড়ির নিচেই দিয়েছেন স্যানিটারির বড় দোকান আর রামপুরার রয়েছে বড় চালের আড়ৎ।  এছাড়াও উত্তরা ও কেরাণীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্পে ৬/৭টি প্লট রয়েছে। সুচুতর মালিক দুর্নীতি দমন কমিশনে তার বিরুদ্বে একের পর এক অভিযোগ যাওয়ার পর থেকে তিনি তার সম্পদগুলো মেয়ে, স্ত্রীসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নামে দেয়া শুরু করেন। লোকজন বলছেন, দূর্নীতি দমন কমিশনের হাত থেকে বাঁচতে এ কৌশল নিয়েছেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর মালেকের বিরুদ্ধে ২৩টির অধিক ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ দিয়েছেন উত্তরা এলাকার ১০ বাসিন্দারা। সেখানে উল্লেখ রয়েছে- গার্ড এম এ মালেক বর্তমানে রাজউকের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আতঙ্ক। শুধু আতঙ্ক নয়, তার নামে রয়েছে কোটি টাকার সম্পত্তি। এসএসসি পাশ না করে নিম্নমান মুদ্রণের চাকরি পেয়ে তার পদের উন্নতি হয়। বর্তমানে তিনি রাজউক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি। উত্তরা ৪নং সেক্টরের ১১নং রাস্তার ৫২নং প্লটের মালিক তিনি। প্লটটি সম্প্রতি তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। উত্তরা, পূর্বাচণ ও কেরাণীগঞ্জের ঝিলমিল প্রকল্পে ৬/৭টি প্লট রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, নবাবপুরে মালেকের ছোট স্ত্রীর ভাইয়ের ব্যাংক একাউন্ট থেকে সকল লেনদেন হয়ে থাকে। এছাড়া মালেকের নামে সিটি ব্যাংক জীবন বীমা ভবন মতিঝিল শাখা থেকে কোটি টাকার লেনদেন হয়।

কর্মচারীদের বদলী/প্রমোশন সব কিছু টাকার বিনিময়ে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে করান মালেক। রাজউকের সাবেক চেয়রাম্যান ইঞ্জিনিয়ার নুরূল হুদা ও ইঞ্জিনিয়ার জয়নাল আবেদিন মালেক বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলেও উল্লেখ রয়েছে অভিযোগপত্রে।

উত্তরা এলাকার ১০ বাসিন্দাদের অভিযোগ- ‘মালেকের দ্বিতীয় স্ত্রী সেলিনা বেগম রাজউকের কর্মচারী হলেও তিনি অফিসে কাজ করেন না। শুধু বেতন নিয়ে যান। এছাড়া দুদক বিরোধী মিছিলে ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট অংশ নেন মালেক। সে সময় দুদকের একজন কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করেন তিনি।’

এছাড়া রাজউক নিম্নমান সহকারীর অভিযোগে সম্পদের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে, মালেকের নামে ভাটারায় এক বিঘা রয়েছে। পূর্বাচলে ২টি ৩ কাঠা প্লট কিনেছে মালেক। উত্তরা সেক্টর-৫ এর রোড-৯ এর প্লট- ২৬, সেক্টর-১১ এর রোড-৭ এর প্লট-২১ এর মালিক মালেক।

মালেকের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি রাজউক চেয়রাম্যান বরাবর চিঠি পাঠান।

এদিকে মালেকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের তদন্ত এখনো দুদকে চলমান রয়েছে বলে সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন।

মেয়ের নামে রিয়েল এষ্টেট কোম্পানি : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালেকের মেজো মেয়ে মাসুমা আক্তার মিথির নামে মাসুমা কনষ্ট্রাকশন এ্যান্ড রিয়েল এষ্টেট ফার্ম নামে একটি কোম্পানি করা হয়েছে। ২০১৭ সালে কোম্পানির নামে জয়েন্ট ষ্টক থেকে  লাইসেন্স নেয়া হয়। জানা যায়, মিথি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। এই লাইন্সেসে তারপর থেকে মালেক তার জাল জালিয়াতির ব্যবসা আরো চাঙ্গা করে চালিয়ে আসছে।

এসব বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেন, রাজউককে দূর্নীতিমুক্ত করতে তিনি উদ্যোগ নিচ্ছেন। এখানে যার দূর্নীতি ধরা পড়বে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

তিনি আরও বলেন, দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে একাধিকবার মিটিংও হয়েছে দুদক রাজউকের কারও দূর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে রাজউক তাতে সহায়তা করবে।

অন্যদিকে মালেকের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইল ফোনেও তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর