ঢাকা ০১:৩৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাগাতিপাড়ায় তাল পাখার গ্রাম হাঁপানিয়া

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৪১:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মার্চ ২০১৮
  • ৩১১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ তালের পাখা, প্রাণের সখা। গ্রীষ্মের খরতাপে কাহিল প্রকৃতির বুকে তৃষাতপ্ত শরীর একরাশ শান্তির পরশে জুড়িয়ে দিতে অনবদ্য তালপাখা। শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি আর মমতার বুননে হাতে তৈরী তালপাখাই জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের হাঁপানিয়া ফকিরপাড়া গ্রামের মানুষদের। বছরের ছয়টি মাসে হাতপাখা তৈরি তাদের দিয়েছে বাড়তি উপার্জনের সুযোগ। মহিলাদের করেছে স্বাবলম্বী।

তবে প্রয়োজনীয় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণ সুবিধা না থাকায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি বিকশিত হচ্ছে না। নাটোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাঁপানিয়া গ্রামটিতে তালগাছ না থাকলেও এখন তালপাতার গ্রাম নামেই এর পরিচয়।

সরেজমিন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার পাখা শিল্পের সাথে জড়িত। পরিবারের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ছোট-বড় সকলেই তালপাখা তৈরির সাথে জড়িত। ফাল্গুনের শুরুতে তালপাখার চাহিদা বেশি থাকে বলেই একনাগাড়ে সকলেই তা তৈরি করেন। তালপাখা তৈরির কারিগররা জানান, এর প্রধান কাঁচামাল ডাগুরসহ তালপাতা। উত্তরের জেলা নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তালপাতা কিনে আনতে হয় পৌষ মাসের শুরুতে। প্রতিটি পাতা ডাগুরসহ কিনতে খরচ পড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা। এই ডাগুরগুলোকে পাখার আকারে গোল করে কাটা হয় সতর্কতার সাথে। কাটার পর রোদে শুকানো হয় কয়েকদিন। শুকানো শেষে গুচ্ছ হয়ে থাকা ডাগুরের সংকুচিত পাতা প্রসারিত করা হয় বাঁশের তৈরি কাঠির মাধ্যমে।

পাতার এক একটি শিরা প্রসারিত করে কয়েক শিরা মিলে দুই প্রান্তে আটকানো থাকে কাঠি। এভাবে রাখার পর তালপাতা স্বাভাবিক প্রসারিত আকার ধারণ করলে গোলাকার পাখাটি রং করা বাঁশের খিল দিয়ে দুপাশ আটকে সেলাই করে দেয়া হয়।

একটি তালপাখা কাঁচামাল থেকে তৈরি করতে খরচ হয় আরো ২ থেকে ৩ টাকা। গড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা খরচে তৈরি তালপাখা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ১২ থেকে ১৫ টাকায়। প্রধানত রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, খুলনা, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে তালপাখার চাহিদা মেটায় হাঁপানিয়ার পাখা।

তালপাখা তৈরিতে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করে নারীরাও। সংসারের নিত্য কাজকর্মের পাশাপাশি পৌষের শুরু থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করছে নারীরা। তবে এর মজুরী একেবারেই কম। একশ’ পিস পাখা তৈরি করলে মজুরী পাওয়া যায় ৩৫ টাকা। ৩ থেকে ৫ জন নারী একসাথে বসলে ঘন্টায় ৩০০ টি পাখা অনায়াসে তৈরি করতে পারে।

হাঁপানিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ বয়সী বৃদ্ধা সাবেজান বেগম জানান, তিনি এ গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকে অদ্যবধি তালপাখা তৈরি করছেন। তালপাখা তৈরি করেই তিনি তার সন্তানদের মানুষ করেছেন ও বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার পুত্রবধূও সংসারে বাড়তি উপার্জনের জন্য পাখা তৈরি করেন।

সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আলাউদ্দীন বলেন, গত ৪ দশক ধরে তালপাখাই আমার জীবিকার উৎস। দীর্ঘসময় পাখা তৈরি করলেও সরকারী কোন সহায়তা বা ঋণ পাইনি। পাখার চাহিদা বরাবরই বেশি আর ঋণ পেলে আরো বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব।

মুনসুর আলী নামের অপর এক পাখা প্রস্তুতকারী বলেন, গ্রীষ্মের শুরুতে যে পরিমাণে পাখা এ গ্রাম থেকে সরবরাহ করা হয়, তাতে সরকারের উচিত পাখাপল্লী হিসেবে গ্রামটিকে ঘোষণা করা। নিজস্ব পুঁজি কম থাকায় কোন কারিগরের পক্ষে বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব হয়না।

স্কুলছাত্রী সুমি খাতুন জানায়, গরমের শুরুতে পাখা তৈরি করায় ভাই ও নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে দিনমজুর বাবার উপর চাপ দিতে হয় না। তালপাখা তাকে অল্প বয়সেই আতনির্ভর করেছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী মাহাতাব হোসেন বলেন, শৌখিন অথচ প্রয়োজনীয় এ পণ্যটির জন্যই এই গ্রমের পরিচিতি বেড়েছে। সেইসাথে এখানকার মানুষদের বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হবার অনন্য দৃষ্টান্ত এখন এই তালপাখার গ্রাম হাঁপানিয়া। তবে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অনেকেক সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া ঋণের টাকার সুদ বেশি হওয়ায় লাভের পরিমান কম হয় তাদের।

বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাসরিন বানু বলেন, তাল পাখার গ্রাম হাঁপানিয়া সরেজমিনে ঘুরে দেখেছি, তাল পাখার এই শিল্পকে ধরে রাখতে হবে। তাদের জীবন মানের উন্নয়ন দরকার। গ্রামের মানুষদের নিয়ে সমিতি গঠন করে তাদের মাঝে টাকা প্রদানের জন্য একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পকে বলা হয়েছে। এছাড়া তাদের মাঝে নগদ অর্থ প্রদান সহ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বাগাতিপাড়ায় তাল পাখার গ্রাম হাঁপানিয়া

আপডেট টাইম : ১২:৪১:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মার্চ ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ তালের পাখা, প্রাণের সখা। গ্রীষ্মের খরতাপে কাহিল প্রকৃতির বুকে তৃষাতপ্ত শরীর একরাশ শান্তির পরশে জুড়িয়ে দিতে অনবদ্য তালপাখা। শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি আর মমতার বুননে হাতে তৈরী তালপাখাই জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের হাঁপানিয়া ফকিরপাড়া গ্রামের মানুষদের। বছরের ছয়টি মাসে হাতপাখা তৈরি তাদের দিয়েছে বাড়তি উপার্জনের সুযোগ। মহিলাদের করেছে স্বাবলম্বী।

তবে প্রয়োজনীয় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণ সুবিধা না থাকায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি বিকশিত হচ্ছে না। নাটোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাঁপানিয়া গ্রামটিতে তালগাছ না থাকলেও এখন তালপাতার গ্রাম নামেই এর পরিচয়।

সরেজমিন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার পাখা শিল্পের সাথে জড়িত। পরিবারের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ছোট-বড় সকলেই তালপাখা তৈরির সাথে জড়িত। ফাল্গুনের শুরুতে তালপাখার চাহিদা বেশি থাকে বলেই একনাগাড়ে সকলেই তা তৈরি করেন। তালপাখা তৈরির কারিগররা জানান, এর প্রধান কাঁচামাল ডাগুরসহ তালপাতা। উত্তরের জেলা নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তালপাতা কিনে আনতে হয় পৌষ মাসের শুরুতে। প্রতিটি পাতা ডাগুরসহ কিনতে খরচ পড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা। এই ডাগুরগুলোকে পাখার আকারে গোল করে কাটা হয় সতর্কতার সাথে। কাটার পর রোদে শুকানো হয় কয়েকদিন। শুকানো শেষে গুচ্ছ হয়ে থাকা ডাগুরের সংকুচিত পাতা প্রসারিত করা হয় বাঁশের তৈরি কাঠির মাধ্যমে।

পাতার এক একটি শিরা প্রসারিত করে কয়েক শিরা মিলে দুই প্রান্তে আটকানো থাকে কাঠি। এভাবে রাখার পর তালপাতা স্বাভাবিক প্রসারিত আকার ধারণ করলে গোলাকার পাখাটি রং করা বাঁশের খিল দিয়ে দুপাশ আটকে সেলাই করে দেয়া হয়।

একটি তালপাখা কাঁচামাল থেকে তৈরি করতে খরচ হয় আরো ২ থেকে ৩ টাকা। গড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা খরচে তৈরি তালপাখা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ১২ থেকে ১৫ টাকায়। প্রধানত রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, খুলনা, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে তালপাখার চাহিদা মেটায় হাঁপানিয়ার পাখা।

তালপাখা তৈরিতে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করে নারীরাও। সংসারের নিত্য কাজকর্মের পাশাপাশি পৌষের শুরু থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করছে নারীরা। তবে এর মজুরী একেবারেই কম। একশ’ পিস পাখা তৈরি করলে মজুরী পাওয়া যায় ৩৫ টাকা। ৩ থেকে ৫ জন নারী একসাথে বসলে ঘন্টায় ৩০০ টি পাখা অনায়াসে তৈরি করতে পারে।

হাঁপানিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ বয়সী বৃদ্ধা সাবেজান বেগম জানান, তিনি এ গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকে অদ্যবধি তালপাখা তৈরি করছেন। তালপাখা তৈরি করেই তিনি তার সন্তানদের মানুষ করেছেন ও বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার পুত্রবধূও সংসারে বাড়তি উপার্জনের জন্য পাখা তৈরি করেন।

সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আলাউদ্দীন বলেন, গত ৪ দশক ধরে তালপাখাই আমার জীবিকার উৎস। দীর্ঘসময় পাখা তৈরি করলেও সরকারী কোন সহায়তা বা ঋণ পাইনি। পাখার চাহিদা বরাবরই বেশি আর ঋণ পেলে আরো বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব।

মুনসুর আলী নামের অপর এক পাখা প্রস্তুতকারী বলেন, গ্রীষ্মের শুরুতে যে পরিমাণে পাখা এ গ্রাম থেকে সরবরাহ করা হয়, তাতে সরকারের উচিত পাখাপল্লী হিসেবে গ্রামটিকে ঘোষণা করা। নিজস্ব পুঁজি কম থাকায় কোন কারিগরের পক্ষে বেশি পাখা তৈরি করা সম্ভব হয়না।

স্কুলছাত্রী সুমি খাতুন জানায়, গরমের শুরুতে পাখা তৈরি করায় ভাই ও নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে দিনমজুর বাবার উপর চাপ দিতে হয় না। তালপাখা তাকে অল্প বয়সেই আতনির্ভর করেছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী মাহাতাব হোসেন বলেন, শৌখিন অথচ প্রয়োজনীয় এ পণ্যটির জন্যই এই গ্রমের পরিচিতি বেড়েছে। সেইসাথে এখানকার মানুষদের বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হবার অনন্য দৃষ্টান্ত এখন এই তালপাখার গ্রাম হাঁপানিয়া। তবে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অনেকেক সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া ঋণের টাকার সুদ বেশি হওয়ায় লাভের পরিমান কম হয় তাদের।

বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাসরিন বানু বলেন, তাল পাখার গ্রাম হাঁপানিয়া সরেজমিনে ঘুরে দেখেছি, তাল পাখার এই শিল্পকে ধরে রাখতে হবে। তাদের জীবন মানের উন্নয়ন দরকার। গ্রামের মানুষদের নিয়ে সমিতি গঠন করে তাদের মাঝে টাকা প্রদানের জন্য একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পকে বলা হয়েছে। এছাড়া তাদের মাঝে নগদ অর্থ প্রদান সহ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।