হাওর বার্তা ডেস্কঃ জামালগঞ্জের ফেনারবাঁক ও ভীমখালী ইউনিয়নের আওতাধীন পাগনার হাওরে পূর্ব এলাকায় জলাবদ্ধতায় এবারও অনেক বোরো জমিতে চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাপাউবোর দাবি পানি নিস্কাশনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তবে যেভাবে পানি হ্রাস পাচ্ছে এতে করে অন্যান্য বছরের ন্যায় চলতি মৌসুমেও অনেক জমি অনাবাদী থাকবে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। কৃষকরা জানিয়েছেন ২৭ টি গ্রামের কয়েক হাজার কৃষকের জমি পানির নিচে রয়েছে।
জলাবদ্ধতার শিকার গ্রামগুলো হচ্ছে, ফেনাবাঁক ইউনিয়নের উজান দৌলতপুর, ভাটি দৌলতপুর, রাজাবাজ, মাতারগাঁও, ছয়হারা, গঙ্গাধরপুর, রাজাপুর, ফেনারবাঁক (একাংশ)। ভীমখালী ইউনিয়নের রাজাবাজ, ভান্ডা, মল্লিকপুর, হারারকান্দি, সন্তোষপুর, কামলাবাজ, গাজীপুর, হাসনাবাজ, ভীমখালী, বিছনা, মাহমুদপুর, ফেকুল মাহমুদপুর, কান্দাগাঁও, তেরানগরসহ আরও কয়েকটি গ্রাম। পাশাপাশি সদর ইউনিয়নের কাশিপুর, কালাগুজা, সোনাপুর, চাঁনপুর, গুচ্ছগ্রামের অনেক কৃষকের জমি পানির নিচে থাকে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ড. সাফায়েত।
আহমদ সিদ্দিকী জানিয়েছেন, গত বোরো মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা সম্ভব হয়নি। চলতি বোরো মৌওসুমে জলাবদ্ধ জমির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এবার অন্তত ৫ হাজার হেক্টর জমি পানির নিচে থাকবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা ২ হাজার হতে পারে। ৩০ কোটি টাকার ধান কম উৎপাদন হবে। ’
হাওরের তলদেশ থেকে বিভিন্ন নদীর তলদেশের উচ্চতা কমে যাওয়া ও পানি নিস্কাশনের নদী-নালা ও খালগুলো পর্যায়ক্রমে ভরাট হওয়ার ফলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা নিহার রঞ্জন দাস জানিয়েছেন, ভরাটকৃত কানাইখালী নদী ও গজারিয়া খাল খনন করতে ৩০ লাখ বরাদ্দ হয়েছে। খুব দ্রুত খনন কাজ শুরু করা হবে।
ভীমখালী ইউনিয়নের ফেকুল মাহমুদপুর গ্রামের বাসিন্দা আখতারুজ্জামান বলেন,‘ কানাইখালী নদী ভরাটের ফলে এলাকার কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। এই নদী খনন হচ্ছে-হবে বলেই বছর বছর পার হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে কৃষকের কোন উপকার হচ্ছে না। প্রতি বছরই জলাবদ্ধতার পরিমাণ বাড়ছে। চলতি মৌসুমে অনেক জমি পানির নিচে রয়েছে।’
একই ইউনিয়নের বাসিন্দা ভান্ডা গ্রামের কৃষক সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল মালিক বলেন,‘কানাইখালী নদী ভরাটের ফলে আমাদের কপাল পুড়ছে। গত ২০ বছর ধরে হাওরের জমি পানির নিচে থাকে। আমার ৭ হাল (৮৪ কেদার) জমি এখনও পানির নিচে রয়েছে। যা এই বছর চাষ করা সম্ভব হবে না। এভাবে ২২টি গ্রামের কয়েক হাজার কৃষকের জমি অনাবাদী থাকছে।’
ফেনারবাঁক ইউনিয়নের উজান দৌলতপুর গ্রামের কৃষক গৌরাঙ্গ সরকার বলেন,‘ কানাইখালী নদী কৃষকদের শ্রমিক বানিয়ে দিচ্ছে। দাদার আমলের উচ্চ ফলনশীল বোরো জমিতে এখন সারা বছরই পানি থাকে। গত ১৫-২০ বছর ধরেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এখন প্রতি বছর পানির উচ্চতা বাড়ছে। এসব জমির আশা বাদ দিয়ে এখন এলাকা ছাড়ার উপক্রম হয়েছে।
জামালগঞ্জ সদর ইউপি চেয়ারম্যান সাজ্জাদ মাহমুদ তালুকদার বলেন,‘ কানাইখালী নদী খননের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এই নদী ভরাটের ফলে হাওরে জলাবদ্ধতার পরিমাণ প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
ভীমখালী ইউপি চেয়ারম্যান দুলাল মিয়া বলেন,‘হাওরের জলাবদ্ধতার কারণে এলাকার লোকজনের দূরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কৃষক পরিবারগুলো খুব তাড়াতাড়ি এলাকা ছাড়তে বাধ্য হবে। আমার ইউনিয়নের ৩৩ টি গ্রামের মধ্যে ছোট-বড় অন্তত ২৮টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কৃষক জলাবদ্ধতার শিকার। ৩ হাজার কৃষক এখন পর্যন্ত একটি ধানের চারাও রোপন করতে পারেনি। ’
ফেনারবাঁক ইউপি চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু তালুকদার বলেন, ‘জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে অন্তত ২৫ বছর ধরে। পরিস্থিতি দিন দিন জটিল রূপ ধারণ করছে। অনেক কৃষক এই বছর হাওরে যেতেই পারেনি। আমার নিজেরই ২ হাল জমি পানির নিচে রয়েছে। কানাইখালী ও গজারিয়া খাল খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এবার খনন কাজ শেষ করা সম্ভব হলে আগামীতে হয়তো জমি চাষাবাদ করা যেতে পারে। ’
পাগনার হাওরের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাপাউবোর উপ সহকারি প্রকৌশলী নিহার রঞ্জন দাস বলেন,‘পাগনার হাওরের পানি অনেক বেশী কিন্তু পানি নিস্কাশনের রাস্তা খুব কম। তাই প্রতি বছরই পানি নিস্কাশনে সমস্যা হয়। পাশাপাশি পানি নিস্কাশনের খাল ভরাটসহ নানা সমস্যা রয়েছে। চেষ্টা চলছে দ্রুত পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করার। যেসব জমিতে এখনও পানি রয়েছে; সেগুলোতে ধান চাষ সম্ভব নাও হতে পারে। তবে আমরা চেষ্টা করছি ভরাটকৃত কানাইখালী নদী ও গজারিয়া খাল খনন করতে।’
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আল ইমরান বলেন,‘ কানাইখালী নদী ও গজারিয়া খাল ভরাট দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্যা নিরসন করতে আমরা স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। হাওরের জলাবদ্ধতা দূর করতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে। ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জ কার্যাালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন,‘পাগনার হাওরের জলাবদ্ধতার সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। তবু জলাবদ্ধতা দ্রুত নিরসন করার জন্য ৩০ লাখ টাকার একটি বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন করা হবে। ভরাটকৃত কানাইখালী নদী ও গজারিয়া খালের তিন কিলোমিটারের বেশী জায়গা খনন করা হবে। আমরা আশা করি এই খনন কাজ বাস্তবায়ন হলে পাগনার হাওরের জলাবদ্ধতা দূর হবে।