মা ইন্দ্রাণীকে ডাইনি ভাবত মেয়ে শিনা

শিনা বোরা হত্যারহস্য উন্মোচনে তিন স্বামীর সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হয়েছে মূল অভিযুক্ত সাবেক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী চ্যানেল কর্ত্রী ইন্দ্রাণী মুখার্জিকে। বর্তমান স্বামী পিটার মুখার্জি ও দ্বিতীয় স্বামী সঞ্জীব খানাকে মুখোমুখি বসিয়ে একাধিকবার জেরা করা হয়েছে। এদিন জেরার তালিকায় যুক্ত হয়েছে প্রথম স্বামী বলে কথিত সিদ্ধার্থ দাসকেও। সিদ্ধার্থের ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে শিনা তার মেয়ে কিনা তা নিশ্চিত হতে। তবে এরই মধ্যেই নিহত শিনা বোরার একটি ১০ বছর আগের ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে। সেই ডায়েরি থেকে পুলিশ শিনার মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করছে। একদিকে হাই সোসাইটর ছাড়পত্র পেতে মা তাকে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাননি। এই অস্বীকৃতিতে জড়িয়ে ছিল মেয়ের প্রতি ঘৃণা। অন্যদিকে সন্তান পালনে অক্ষম পিতা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। দুজনের আলাদাভাবে পাতা সংসারের কোনটিতেই মেয়েটি বাঞ্ছিতা ছিলেন না। দশ বছর আগে ক্লাস টেনের ছাত্রী থাকার সময় ইংরেজিতে লেখা ডায়েরি থেকে শিনার মনস্তত্ত্বের যে রূপরেখা পাওয়া যায় তার ভরকেন্দ্রে রয়েছে বাবা-মায়ের সান্নিধ্য বঞ্চিত এক কিশোরী। যার মা তাকে ঘৃণাবশত সমাজের সামনে পরিচয় দেন নিজের বোন বলে। হস্তরেখা বিশারদদের মতে, শিনার হস্তাক্ষরেও রয়েছে মানসিক বিচ্ছিন্নতার নির্দেশ। কি লিখেছে শিনা নিভৃতে তার ডায়েরির পাতায় পাতায়? শিনা মাকে চরমভাবে ঘৃণা করত। মাকে কুক্কুরি বা ডাইনি অভিধা দিতেও তার লেখনী কাঁপেনি। আবার বাবার প্রতি ছিল প্রচণ্ড অভিমান। ২০০৩ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি শিনা লিখেছে, আজ আমার হ্যাপি বার্থ ডে। কিন্তু আমি একটুও হ্যাপি নয়। জীবনে আমি কিছুই পাইনি। নাথিং। মনে হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ? অন্ধকার। চারদিক থেকে হতাশা আমায় গ্রাস করছে। অত্যন্ত বিরক্তিকর জীবন। আমি মাকে ঘৃণা করি। সে আমার মা নয়, সে একটা ডাইনি। ইন্দ্রানীকে ‘ডাইনি’ বলে উল্লেখ করার পাশাপাশি ইন্দ্রানী যে তার চরম ক্ষতি করতে পারে, সে আশঙ্কার কথাও লেখা রয়েছে ডায়েরিতে। ইন্দ্রানীর সঙ্গে পিটার মুখার্জির বিয়েকে ভাল চোখে দেখেননি শিনা। ডায়েরির এক জায়গায় লেখা, এবার এক বৃদ্ধকে বিয়ে করল মা। দাদু-দিদিমা (ইন্দ্রানীর বাবা-মা) বিষয়টিকে ভালভাবে নিলেও আমি নিইনি। অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। ডায়েরিতে মায়ের প্রতি চরম ঘৃণা প্রকাশ পেলেও বাবা সিদ্ধার্থ দাসের প্রতি বেশ নরম শিনা। ডায়েরির পাতাজুড়ে বাবার সঙ্গে মান-অভিমানের নানা ছবি। শিনা লিখেছে, ড্যাডি, তোমার ওপর আমি খুব রেগে আছি। এটা ঠিক যে আমি তোমাকে চিঠি লেখার সময় পাই না। কিন্তু তোমার আমাকে চিঠি লেখা উচিত। তুমি তো জান বাবা, ক্লাস টেনে পড়ার কত চাপ। সকাল সাড়ে সাতটায় আমি স্কুলে যাই। বিকেল তিনটে থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত অঙ্কের কোচিং করতে হয়। সন্ধ্যে ৬টা থেকে ৮টা সায়েন্সের কোচিং থাকে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে আটটা। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছো আমাকে কতটা খাটতে হয়। আবার এক জায়গায় লিখেছে, ড্যাডি, আমি হাত-পায়ের নখ কেটেছি। বড় হতে দিইনি। আমি তোমার কথা শুনেছি। আমি জানি তোমারও আমাকে অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু দোহাই চিঠিতে কিছু লিখ না। আমি আশা করি আমার… পরীক্ষার আগে তুমি একবার আসবে। ডিসেম্বরে একবার তুমি গুয়াহাটিতে এসো না। তখন না হয় তুমি যা বলতে চাও বলো। আবার কখনও বাবার প্রতি অনুযোগ ধরা পড়েছে শিনার লেখায়। ডায়েরিতে শিনা লিখেছে, ড্যাডি, অন্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে তুমি নিজে কিছু করতে পারো না? ওই চাকরিটা ছেড়ে তুমি ভাল চাকরি খোঁজ। তোমাকে উপদেশ দেয়ার মতো শোনাচ্ছে না ড্যাডি! তুমি রাগ কোরো না। দুইদিন আগেই কলকাতায় সিদ্ধার্থ দাস দাবি করেছিলেন, শিনা যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন শেষবার তার সঙ্গে কথা হয়। কিন্তু শিনার এই ডায়েরিতে তার বাবাকে লেখা চিঠি বা বাবার সম্পর্কে তার যে ভাবনা, তাতে দুজনের সম্পর্ক যে কতটা গভীর ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তাই পুলিশ মনে করছে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাবা সিদ্ধার্থের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল শিনার। সিদ্ধার্থকে মুম্বাই নিয়ে গিয়ে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে পুলিশ। সিদ্ধার্থের জবাবে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর