ঢাকা ০৩:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাথি ও ফুঁ দিয়ে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৫৩:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭
  • ২৭৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ লাথি ও ফুঁ দিয়ে প্যারালাইসিস, গ্যাস্ট্রিক, চোখের সমস্যা, পেট ব্যথা থেকে শুরু করে দুরারোগ্য যেকোনো ব্যাধির চিকিৎসা দিচ্ছে এক প্রতিবন্ধী কিশোর। এর বিনিময়ে প্রতিজনের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা।

তবে গোপন রোগ থেকে মুক্তি পেতে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। আর তার লাথি চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন শত শত নারী-বৃদ্ধ ও শিশু নাটোরের সিংড়া উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে ভিড় করছে।

স্থানীয়রা জানায়, মাহমুদপুর গ্রামের কৃষক আশরাফ আলীর তিন সন্তান। দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মনির হোসেন (১২) ছোট। জন্মগতভাবে মনির শারীরিক ও বাক্প্রতিবন্ধী। হঠাৎ করে গত রমজানের পর একজনকে সে বাড়ির পাশের জঙ্গল থেকে শিকড় তুলে দেয়। পরে সে সুস্থ হয়ে যায় বলে গুজব ছড়ানো হয়। পরে তার বড় মা রাবেয়া বেগম বিয়ের ১২ বছর পর অন্তঃসত্ত্বা হন। এর নেপথ্যে শিশুটির ছোঁয়া রয়েছে বলে প্রচারণা চালানো হয়।

এর পর থেকে আশপাশের গ্রাম থেকে রোগী আসা শুরু হয়।

গত ২ ডিসেম্বর দুপুর ১টায় মাহমুদপর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কথিত কবিরাজের বাড়িতে অসংখ্য রোগীর ভিড়। বেশির ভাগ রোগী নারী ও শিশু। শিশু মনির বাড়ির আঙিনায় মাটিমাখা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তখনো কবিরাজের গোসল ও খাওয়া হয়নি। তাই আগত রোগীদের অপেক্ষার পালা। এদিকে কবিরাজের মা মমতাজ বেগমের কথা, চিকিৎসা নিতে হলে সবাইকে বসতে হবে। কেউ তাড়াহুড়া করলে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।

অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে আস্তানায় না বসে বাড়ির আঙিনায় শুরু হয় চিকিৎসা। আগত রোগীদের উদ্দেশে মা নির্দেশ দেন, ‘২০ টাকা দেন। আরো দুইবার কিন্তু আসতে হবে। একবার এলে রোগ ভালো হবে না। ’ টাকা নেওয়ার পর শুরু হয় পেটের ও চোখের সমস্যার জন্য ফুঁ দেওয়া আর কোমর-পায়ে বাত ব্যথার জন্য লাথি ও তেল-পানি পড়া। যারা তেল-পানি আনেনি তাদের জন্যও রয়েছে টাকার বিনিময়ে বিশেষ ব্যবস্থা। তা ছাড়া গোপন রোগের জন্য রয়েছে ঘরের ভেতরে বিশেষভাবে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা।

এই বাড়ির সঙ্গে নাগর নদে নৌকা পারাপারে ব্যস্ত মাঝি আলম হোসেন জানান, প্রতিদিন শত শত লোক তার নৌকায় পার হয়ে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এই কবিরাজের ঝাড়-ফুঁকে রোগ ভালো হয় কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যতই দিন যাচ্ছে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। আর আমারও আয় অনেক বেড়ে গেছে। এতটুকু আমি জানি, এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না। ’

সিংড়া পৌর শহরের নিংগইন মহল্লার আলেয়া বেগম জানান, তাঁর কিছু সমস্যার জন্য এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রথম দিন তাঁকে তাবিজ ও পানি পড়া দেওয়া হয়েছে। তাঁকে তিনবার আসতে বলা হয়েছে। তাই তিনি আজও এসেছেন। সঙ্গে তাঁর ছেলে নিংগইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র আলিফ হোসেন (৬)। সে রাতে ঘুমের মধ্যে ভয় পায়।

তারও চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। লোকমুখে কবিরাজের কথা শুনে গোডাউন পাড়া-মহল্লার তাথইকে (৬) চিকিৎসা দিতে নিয়ে এসেছেন তার মা ও মাসি। এদিকে ছোট ছোট শিশুদের চিকিৎসায় তাদের ভয়-ভীতি ও চড়-থাপ্পর দিতে দেখা যায় মনির এবং তার মাকে। আর এই প্রতারকচক্রের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে তার শিশুকে চিকিৎসার নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সিংড়া উপজেলা সভাপতি ও বিলহালতী ত্রিমোহনী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র এই অপচিকিৎসায় চালিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। আর কোনো শিশু বা বৃদ্ধ যেন চিকিৎসার নামে এই ধরনের অপচিকিৎসার শিকার না হয়, সে বিষয়ে কমিশন দ্রুত উদ্যোগ নেবে। ’

সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘বর্তমানে এ ধরনের অপচিকিৎসা একটি দুঃখজনক বিষয়। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

নাটোর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ বিশ্বাস করে এর পেছনে দৌড়াচ্ছে। এটা একটা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ফুঁ দিয়ে কোনো চিকিৎসা নেই।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

লাথি ও ফুঁ দিয়ে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা

আপডেট টাইম : ০৩:৫৩:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ লাথি ও ফুঁ দিয়ে প্যারালাইসিস, গ্যাস্ট্রিক, চোখের সমস্যা, পেট ব্যথা থেকে শুরু করে দুরারোগ্য যেকোনো ব্যাধির চিকিৎসা দিচ্ছে এক প্রতিবন্ধী কিশোর। এর বিনিময়ে প্রতিজনের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা।

তবে গোপন রোগ থেকে মুক্তি পেতে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। আর তার লাথি চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন শত শত নারী-বৃদ্ধ ও শিশু নাটোরের সিংড়া উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে ভিড় করছে।

স্থানীয়রা জানায়, মাহমুদপুর গ্রামের কৃষক আশরাফ আলীর তিন সন্তান। দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মনির হোসেন (১২) ছোট। জন্মগতভাবে মনির শারীরিক ও বাক্প্রতিবন্ধী। হঠাৎ করে গত রমজানের পর একজনকে সে বাড়ির পাশের জঙ্গল থেকে শিকড় তুলে দেয়। পরে সে সুস্থ হয়ে যায় বলে গুজব ছড়ানো হয়। পরে তার বড় মা রাবেয়া বেগম বিয়ের ১২ বছর পর অন্তঃসত্ত্বা হন। এর নেপথ্যে শিশুটির ছোঁয়া রয়েছে বলে প্রচারণা চালানো হয়।

এর পর থেকে আশপাশের গ্রাম থেকে রোগী আসা শুরু হয়।

গত ২ ডিসেম্বর দুপুর ১টায় মাহমুদপর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কথিত কবিরাজের বাড়িতে অসংখ্য রোগীর ভিড়। বেশির ভাগ রোগী নারী ও শিশু। শিশু মনির বাড়ির আঙিনায় মাটিমাখা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তখনো কবিরাজের গোসল ও খাওয়া হয়নি। তাই আগত রোগীদের অপেক্ষার পালা। এদিকে কবিরাজের মা মমতাজ বেগমের কথা, চিকিৎসা নিতে হলে সবাইকে বসতে হবে। কেউ তাড়াহুড়া করলে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।

অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে আস্তানায় না বসে বাড়ির আঙিনায় শুরু হয় চিকিৎসা। আগত রোগীদের উদ্দেশে মা নির্দেশ দেন, ‘২০ টাকা দেন। আরো দুইবার কিন্তু আসতে হবে। একবার এলে রোগ ভালো হবে না। ’ টাকা নেওয়ার পর শুরু হয় পেটের ও চোখের সমস্যার জন্য ফুঁ দেওয়া আর কোমর-পায়ে বাত ব্যথার জন্য লাথি ও তেল-পানি পড়া। যারা তেল-পানি আনেনি তাদের জন্যও রয়েছে টাকার বিনিময়ে বিশেষ ব্যবস্থা। তা ছাড়া গোপন রোগের জন্য রয়েছে ঘরের ভেতরে বিশেষভাবে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা।

এই বাড়ির সঙ্গে নাগর নদে নৌকা পারাপারে ব্যস্ত মাঝি আলম হোসেন জানান, প্রতিদিন শত শত লোক তার নৌকায় পার হয়ে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এই কবিরাজের ঝাড়-ফুঁকে রোগ ভালো হয় কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যতই দিন যাচ্ছে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। আর আমারও আয় অনেক বেড়ে গেছে। এতটুকু আমি জানি, এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না। ’

সিংড়া পৌর শহরের নিংগইন মহল্লার আলেয়া বেগম জানান, তাঁর কিছু সমস্যার জন্য এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রথম দিন তাঁকে তাবিজ ও পানি পড়া দেওয়া হয়েছে। তাঁকে তিনবার আসতে বলা হয়েছে। তাই তিনি আজও এসেছেন। সঙ্গে তাঁর ছেলে নিংগইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র আলিফ হোসেন (৬)। সে রাতে ঘুমের মধ্যে ভয় পায়।

তারও চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। লোকমুখে কবিরাজের কথা শুনে গোডাউন পাড়া-মহল্লার তাথইকে (৬) চিকিৎসা দিতে নিয়ে এসেছেন তার মা ও মাসি। এদিকে ছোট ছোট শিশুদের চিকিৎসায় তাদের ভয়-ভীতি ও চড়-থাপ্পর দিতে দেখা যায় মনির এবং তার মাকে। আর এই প্রতারকচক্রের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে তার শিশুকে চিকিৎসার নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সিংড়া উপজেলা সভাপতি ও বিলহালতী ত্রিমোহনী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র এই অপচিকিৎসায় চালিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। আর কোনো শিশু বা বৃদ্ধ যেন চিকিৎসার নামে এই ধরনের অপচিকিৎসার শিকার না হয়, সে বিষয়ে কমিশন দ্রুত উদ্যোগ নেবে। ’

সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘বর্তমানে এ ধরনের অপচিকিৎসা একটি দুঃখজনক বিষয়। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

নাটোর জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ বিশ্বাস করে এর পেছনে দৌড়াচ্ছে। এটা একটা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ফুঁ দিয়ে কোনো চিকিৎসা নেই।