ঢাকা ০৭:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
দেশ ও জাতি গঠনে “দৈনিক আমার দেশ” পত্রিকার কাছে নেত্রকোণার জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত ভুল অস্ত্রোপচার, যা ঘটেছিল প্রিয়াঙ্কা সঙ্গে সচিবালয়ে উপদেষ্টা হাসান আরিফের তৃতীয় জানাজা সম্পন্ন সাবেক সচিব ইসমাইল রিমান্ডে অবশেষে বিল পাস করে ‘শাটডাউন’ এড়াল যুক্তরাষ্ট্র চাঁদাবাজদের ধরতে অভিযান শুরু হচ্ছে: ডিএমপি কমিশনার নির্বাচনের পর নিজের নিয়মিত কাজে ফিরে যাবেন ড. ইউনূস ইয়েমেন থেকে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, আহত ১৬ জুলাই আন্দোলন বিগত বছরগুলোর অনিয়মের সমষ্টি: ফারুকী তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ‘সড়কে নৈরাজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব জড়িত

মাটির তলে গিয়ে ‘পদ্মাসেতু’ গড়ছেন যাঁরা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৩৮:১৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭
  • ৩১৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রমত্তা পদ্মার এপার-ওপার আসা-যাওয়ার পথে কিছু সময় পরপর একসঙ্গে ছয়টি কূপ দেখা যায়। মনে হবে, এর ভেতরে পড়ে গেলেই প্রাণবায়ু শেষ। কাছাকাছি এলে বোঝা যাবে, কূপগুলো আসলে বড় বড় পাইপের মুখ। নদীর বিশাল জলরাশি সরিয়ে এগুলো চলে গেছে গভীরে। একটু-আধটু নয়, ইস্পাতের তৈরি বড় পাইপগুলো হাইড্রোলিক হ্যামারের আঘাতে দাবানো হয়েছে মাটির ১২৮ মিটার গভীরে। পাইপকেই বলা হয় পদ্মা সেতুর ‘পাইল’।

এমন ছয়টি পাইলের ওপর দাঁড় করানো হচ্ছে একটি পিলার। সহজ ভাষায় ‘খুঁটি’ বলা যায়। এই খুঁটির ওপর স্থাপন করা হচ্ছে স্প্যান। ৪২টি খুঁটির ওপর ৪১টি স্প্যান জোড়া লাগিয়ে গড়ে উঠছে পদ্মা সেতু। কিন্তু ‘খুঁটি’ শব্দটি লেখা যত সহজ, গড়াটা তত কঠিন। এর চেয়ে কঠিন কাজ হলো, যার ওপর খুঁটি বসানো হয়, সেই পাইলগুলো মাটি ভেদ করে দাঁড় করানো।

এরই মধ্যে পদ্মার বুক চিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে চারটি খুঁটি। দুটি খুটির ওপর বসানো হয়েছে একটি স্প্যান। সময় যত গড়াচ্ছে, একের পর এক পাইল মুখ তুলছে আকাশের দিকে। পাইলের ভেতরে গিয়ে দুঃসাহসিক কাজ করছেন রাজু, তাজুল ইসলাম, জাকির, মোস্তফা, সোহাগ, মামুন, আনিসরা। তাঁরা সবাই পদ্মা সেতুর নির্মাণশ্রমিক। তিন বছর ধরে এই প্রকল্পে কাজ করছেন। নদীর তলদেশে পাইল দেবে দেওয়ার পর শুরু হয়ে তাঁদের আসল কাজ। ৪২ তলা ভবনের সমান উচ্চতার প্রতিটি পাইল প্রায় ১০ ফুট চওড়া। এরপর পাইলের ভেতর থেকে মাটি ও পানির পাম্প মেশিন দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। মাটি-পানি সরিয়ে পাইলের শেষ প্রান্তে ১০ মিটার অংশে পাথর ও সিমেন্ট দিয়ে সিল কংক্রিট করা হয়।

পদ্মা নদীর এপার-ওপার আসা-যাওয়ার পথে কিছু সময় পরপর একসঙ্গে ছয়টি কূপ দেখা যায়। এমন ছয়টি পাইলের ওপর দাঁড় করানো হচ্ছে একটি খুঁটি। সংগৃহীতএই কাজের পর পাইলের ৫৫ থেকে ৬০ মিটার অংশে স্বচ্ছ বালি দেওয়ার কাজ চলে। তবে ঢিলেঢালাভাবে নয়, বালির আস্তরণটি থাকে প্রচণ্ড শক্ত। বালির স্তর এতটাই শক্ত থাকে যে একটি আলপিনও এর মধ্যে গাঁথা যাবে না। পরের পাঁচ মিটার অংশে আবারও সিল কংক্রিট করা হয়। এর পর রডের খাঁচা বসিয়ে ১৩ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত অংশে আরসিসি ঢালাই দেওয়া হয়। ঢালাইয়ের আগে ফাঁকা পাইলের ভেতর ঘষা-মাজার কাজ করতে হয়। এ জন্য প্রায় ১০ তলা পর্যন্ত গভীরে নামতে হচ্ছে রাজু, তাজুল ইসলাম, জাকির, মোস্তফা, সোহাগ, মামুন, আনিসদের। দিন বা রাতের কোনো বিষয় নেই। ২৪ ঘণ্টার মধ্য যেকোনো সময়ই এমনটা করতে হয় তাঁদের।

অন্ধকার পাইলের মধ্যে নামতে ভয় করে না?
এমন প্রশ্ন শুনে অনেকটা অবাক হলেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ভয় কিসের! কাজ করতে এসে ভয় কিসের! অন্যরা যেমন কাজ করে, আমরাও তেমনই কাজ করি। আর দশটা কাজের মতো এইটারেও কাজ মনে করি।’ এর সঙ্গে যুক্ত করেন, ‘ভয় করে না, কারণ পাইলের মুখের চারপাশ ঘিরে রাখা হয়। তবে পাইলের মধ্যে নামলে ভীষণ গরম লাগে। এত গরম যে বলার মতো না। ঘামে শরীর ভিজে যায়। তাই পাতলা কাপড় পরে নামতে হয়। ঝড়-বৃষ্টি হলেও কাজ করতে হয়। অবশ্য বেশি ঝড় হলে উঠে পড়ি।’

পদ্মা সেতুর খুঁটির নকশা। সংগৃহীতপাইলে নামার সময় সব ধরনের নিরাপত্তাই থাকে বলে জানান রাজু নামে আরেক শ্রমিক। তিনি বলেন, মই বেয়ে নিচে নামতে হয়। কোমরে সেফটি বেল্ট পরতে হয়। হেলমেট পরতে হয়। এর সঙ্গে টর্চলাইট যুক্ত থাকে। শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিতে হয়। পাইলের নিচের জায়গা বেশ ফাঁকা। সেখানে ফুটবলও খেলা যায়। তবে গরমে বেশি সময় পাইলের মধ্যে থাকা যায় না। শীতকাল, গরমকাল সব সময়ই পাইলের ভেতর গরম লাগে।

পাইলের ভেতরে কাজের ধরন সম্পর্কে তাজুল ইসলাম বলেন, ইস্পাতের ওপর মরচে পড়ে যায়। আরসিসি ঢালাইয়ের আগে মরিচা তুলতে হয়। তাই ব্রাশ দিয়ে ঘষে মরিচা তুলতে হয়। তবে আধা ঘণ্টার বেশি পাইলের ভেতর থাকা যায় না। আধা ঘণ্টা পরপর বিরতি দিয়ে মরিচা তোলার কাজ করতে হয়। দল ভাগ করে কাজটি করতে হয়। প্রতি দলে ২০ জন শ্রমিক থাকেন।

তাজুল, জাকির, মোস্তফার মতো তিন হাজার শ্রমিকের বিন্দু বিন্দু ঘামে গড়ে উঠছে পদ্মা সেতু। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে ছাড়তে হবে পদ্মার পাড়। তবু কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ পদ্মা সেতু দেখিয়ে দিচ্ছে বড় পথ। যেখানে বুক ফুলিয়ে আরও গভীরে নামতে হবে তাঁদের।

কমল জোহা খান

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

দেশ ও জাতি গঠনে “দৈনিক আমার দেশ” পত্রিকার কাছে নেত্রকোণার জনগণের প্রত্যাশা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

মাটির তলে গিয়ে ‘পদ্মাসেতু’ গড়ছেন যাঁরা

আপডেট টাইম : ০৩:৩৮:১৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রমত্তা পদ্মার এপার-ওপার আসা-যাওয়ার পথে কিছু সময় পরপর একসঙ্গে ছয়টি কূপ দেখা যায়। মনে হবে, এর ভেতরে পড়ে গেলেই প্রাণবায়ু শেষ। কাছাকাছি এলে বোঝা যাবে, কূপগুলো আসলে বড় বড় পাইপের মুখ। নদীর বিশাল জলরাশি সরিয়ে এগুলো চলে গেছে গভীরে। একটু-আধটু নয়, ইস্পাতের তৈরি বড় পাইপগুলো হাইড্রোলিক হ্যামারের আঘাতে দাবানো হয়েছে মাটির ১২৮ মিটার গভীরে। পাইপকেই বলা হয় পদ্মা সেতুর ‘পাইল’।

এমন ছয়টি পাইলের ওপর দাঁড় করানো হচ্ছে একটি পিলার। সহজ ভাষায় ‘খুঁটি’ বলা যায়। এই খুঁটির ওপর স্থাপন করা হচ্ছে স্প্যান। ৪২টি খুঁটির ওপর ৪১টি স্প্যান জোড়া লাগিয়ে গড়ে উঠছে পদ্মা সেতু। কিন্তু ‘খুঁটি’ শব্দটি লেখা যত সহজ, গড়াটা তত কঠিন। এর চেয়ে কঠিন কাজ হলো, যার ওপর খুঁটি বসানো হয়, সেই পাইলগুলো মাটি ভেদ করে দাঁড় করানো।

এরই মধ্যে পদ্মার বুক চিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে চারটি খুঁটি। দুটি খুটির ওপর বসানো হয়েছে একটি স্প্যান। সময় যত গড়াচ্ছে, একের পর এক পাইল মুখ তুলছে আকাশের দিকে। পাইলের ভেতরে গিয়ে দুঃসাহসিক কাজ করছেন রাজু, তাজুল ইসলাম, জাকির, মোস্তফা, সোহাগ, মামুন, আনিসরা। তাঁরা সবাই পদ্মা সেতুর নির্মাণশ্রমিক। তিন বছর ধরে এই প্রকল্পে কাজ করছেন। নদীর তলদেশে পাইল দেবে দেওয়ার পর শুরু হয়ে তাঁদের আসল কাজ। ৪২ তলা ভবনের সমান উচ্চতার প্রতিটি পাইল প্রায় ১০ ফুট চওড়া। এরপর পাইলের ভেতর থেকে মাটি ও পানির পাম্প মেশিন দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। মাটি-পানি সরিয়ে পাইলের শেষ প্রান্তে ১০ মিটার অংশে পাথর ও সিমেন্ট দিয়ে সিল কংক্রিট করা হয়।

পদ্মা নদীর এপার-ওপার আসা-যাওয়ার পথে কিছু সময় পরপর একসঙ্গে ছয়টি কূপ দেখা যায়। এমন ছয়টি পাইলের ওপর দাঁড় করানো হচ্ছে একটি খুঁটি। সংগৃহীতএই কাজের পর পাইলের ৫৫ থেকে ৬০ মিটার অংশে স্বচ্ছ বালি দেওয়ার কাজ চলে। তবে ঢিলেঢালাভাবে নয়, বালির আস্তরণটি থাকে প্রচণ্ড শক্ত। বালির স্তর এতটাই শক্ত থাকে যে একটি আলপিনও এর মধ্যে গাঁথা যাবে না। পরের পাঁচ মিটার অংশে আবারও সিল কংক্রিট করা হয়। এর পর রডের খাঁচা বসিয়ে ১৩ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত অংশে আরসিসি ঢালাই দেওয়া হয়। ঢালাইয়ের আগে ফাঁকা পাইলের ভেতর ঘষা-মাজার কাজ করতে হয়। এ জন্য প্রায় ১০ তলা পর্যন্ত গভীরে নামতে হচ্ছে রাজু, তাজুল ইসলাম, জাকির, মোস্তফা, সোহাগ, মামুন, আনিসদের। দিন বা রাতের কোনো বিষয় নেই। ২৪ ঘণ্টার মধ্য যেকোনো সময়ই এমনটা করতে হয় তাঁদের।

অন্ধকার পাইলের মধ্যে নামতে ভয় করে না?
এমন প্রশ্ন শুনে অনেকটা অবাক হলেন তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ভয় কিসের! কাজ করতে এসে ভয় কিসের! অন্যরা যেমন কাজ করে, আমরাও তেমনই কাজ করি। আর দশটা কাজের মতো এইটারেও কাজ মনে করি।’ এর সঙ্গে যুক্ত করেন, ‘ভয় করে না, কারণ পাইলের মুখের চারপাশ ঘিরে রাখা হয়। তবে পাইলের মধ্যে নামলে ভীষণ গরম লাগে। এত গরম যে বলার মতো না। ঘামে শরীর ভিজে যায়। তাই পাতলা কাপড় পরে নামতে হয়। ঝড়-বৃষ্টি হলেও কাজ করতে হয়। অবশ্য বেশি ঝড় হলে উঠে পড়ি।’

পদ্মা সেতুর খুঁটির নকশা। সংগৃহীতপাইলে নামার সময় সব ধরনের নিরাপত্তাই থাকে বলে জানান রাজু নামে আরেক শ্রমিক। তিনি বলেন, মই বেয়ে নিচে নামতে হয়। কোমরে সেফটি বেল্ট পরতে হয়। হেলমেট পরতে হয়। এর সঙ্গে টর্চলাইট যুক্ত থাকে। শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিতে হয়। পাইলের নিচের জায়গা বেশ ফাঁকা। সেখানে ফুটবলও খেলা যায়। তবে গরমে বেশি সময় পাইলের মধ্যে থাকা যায় না। শীতকাল, গরমকাল সব সময়ই পাইলের ভেতর গরম লাগে।

পাইলের ভেতরে কাজের ধরন সম্পর্কে তাজুল ইসলাম বলেন, ইস্পাতের ওপর মরচে পড়ে যায়। আরসিসি ঢালাইয়ের আগে মরিচা তুলতে হয়। তাই ব্রাশ দিয়ে ঘষে মরিচা তুলতে হয়। তবে আধা ঘণ্টার বেশি পাইলের ভেতর থাকা যায় না। আধা ঘণ্টা পরপর বিরতি দিয়ে মরিচা তোলার কাজ করতে হয়। দল ভাগ করে কাজটি করতে হয়। প্রতি দলে ২০ জন শ্রমিক থাকেন।

তাজুল, জাকির, মোস্তফার মতো তিন হাজার শ্রমিকের বিন্দু বিন্দু ঘামে গড়ে উঠছে পদ্মা সেতু। সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে ছাড়তে হবে পদ্মার পাড়। তবু কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ পদ্মা সেতু দেখিয়ে দিচ্ছে বড় পথ। যেখানে বুক ফুলিয়ে আরও গভীরে নামতে হবে তাঁদের।

কমল জোহা খান