ঢাকা ০১:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৭:৩৯:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ নভেম্বর ২০১৭
  • ৩৭৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ভোলাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শুরু হয়েছে মিষ্টি খেঁজুর রস সংগ্রহের উৎসব। গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ খেঁজুর গাছ। গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক উৎসব শুরু হয়েছে খেঁজুর গাছকে ঘিরে। প্রভাতের শিশির ভেজা ঘাস আর ঘণ কুয়াশার চাদর হেমন্তের শেষে শীতের আগমনের বার্তা জানান দিচ্ছে আমাদের।

শীত যত বাড়বে খেঁজুরে রসের মিষ্টতাও তত বাড়বে। শীতের সঙ্গে খেঁজুরের রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। খেঁজুর রস সংগ্রহকারীরা তাদের প্রস্তুতি শেষ করে গাছি, দা, নলি, কোমরবন্ধ রশি, ভাড় বা হাড়ি সংগ্রহ করে গাছ ছাঁচার কাজ শুরু করে। শীতের শুরুতে নেশার বশেই তারা ছুটে যায় রস সংগ্রহের কাজে।

বোরহানউদ্দীন উপজেলার হাসান ননগর ইউনিয়নের রস সংগ্রহকারী জানান,সাধারণত এই শীত মৌসুমেই খেঁজুর গাছ তোলা বা ছাঁচা হয়। অর্থাৎ খেঁজুর গাছ কেটে রস বের করার জায়গা করার পদ্ধতি। এর সপ্তাহ খানেক পর ঐ স্থান থেকে রস বের করার জন্য দুই পাশে দুটি চিকন নালা তৈরী করে খিলি স্থাপন এবং ভাড় বা রস রাখার হাড়ি টাঙ্গানোর জায়গা করে দিতে হবে। এরই মধ্যে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে খিলি লাগানো হয়ে গেছে কিন্তু আগের তুলনায় খেঁজুর গাছের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ইটভাটায় খেঁজুর গাছ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ইটভাটার মালিকরা সবকিছু ম্যানেজ করে ধ্বংস করে চলেছে খেঁজুর গাছ। এক সময় জেলার সর্বত্রই দেখা যেত খেঁজুর গাছ। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছাস সহিঞ্চু খেঁজুর গাছের আয়ুও গড়ে প্রায় শত বছর। তাছাড়া এই গাছের কাঠের মানও ভালো। কিন্তু এটির সংখ্যা ইদানিং গুণিতক হারে কমতে শুরু করেছে।

বোরহানউদ্দীন উপজেলা কৃষি অফিস ও বিশেষ তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে প্রায় ২০ হাজার কৃষি পরিবার রয়েছে। সড়কপথ, পতিত জমি, জমির আইল ও বাড়ির আঙিনায় রয়েছে অর্ধ লক্ষাধিক খেঁজুর গাছ। একজন ব্যক্তি প্রতিদিন ১০-২০টি খেঁজুর গাছের রস আহরণ করতে পারে। এ রকম রস আহরণকারী ব্যক্তি রয়েছে ৩ হাজার। মৌসুমভিত্তিক এখানে প্রায় এক হাজার পরিবার খেজুরের রস আহরণের ওপর নির্ভরশীল। একজন গাছি এক মৌসুমে অর্থাৎ ১২০ দিনে একটি গাছ থেকে ২০-২৫ কেজি গুড় পেয়ে থাকেন।

হাসাননগর ইউনিয়নের গাছি আবুল কালাম বলেন, ২-৩ মাসের জন্য খেঁজুর গাছ ১০০-১২০ টাকায় চুক্তি নিয়ে রস সংগ্রহ করি। এগুলো গুড় তৈরি করে হাটবাজারে বিক্রি করি। এবার ১২০টি গাছ চুক্তি নিয়েছি। এই গাছগুলো থেকে আমরা দুইজন রস সংগ্রহ করব। সংসারে ৫ সদস্যের পরিবার। এর ওপর ৩-৪ মাস ভালোভাবে চলবে।

কাঁচিয়া ইউনিয়ন কাশেম মিয়া এর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার ৪ মেয়ে ও ২ ছেলে। সবাইকে বিয়ে দিয়েছি। শীত এলেই জামাই-মেয়ে, নাতি-নাতনি, ছেলেদের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আতীয়দের নিয়ে দু-এক বার উৎসবের আয়োজন করি। এই প্রথাটা আমার দাদা- পিজার আমল থেকে চলে আসছে, তাই আমিও করি। নিজেদের ৪০-৫০ টার মতো খেঁজুর গাছ আছে। এসব গাছের রস বা গুড় বাড়ির জন্য ব্যবহৃত হয়।

রস সংগ্রহকারি শাহিন বলেন, খেঁজুর গাছের গাছি নিয়োগ সাধারণত চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করা হয় তা অনেক জায়গায় টাকার বিনিময়ে আবার অনেক জায়গায় ভাগ হিসাবে। খেঁজুর গাছ থেকে যে গুড় উৎপাদিত হয় তার দুইয়ের এক ভাগ পায় গাছি। খেঁজুরের গুড়ের মৌসুম এলেই গ্রামাঞ্চলে উৎসবের আমেজ দেখা যায়।গুড় তৈরীর জন্য আগে যেখানে জালো ব্যবহার করা হতো সেখানে এখন ষ্টীলের শীটের ট্রে যা কেবল মাত্র রস জ্বালানোর তৈরী করা হয়। রস জ্বালিয়ে গুড় বানানোর করার সময় ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা উনুনের সামনে চামচ হাতে অপেক্ষা করে গুড় খাওয়ার জন্য। শুধু গুড় নয় খেঁজুরের ফল ও কাঁচা রসের স্বাদও অতুলনীয়। যাদের বেশি খেঁজুর গাছ আছে তারা এর রস বিক্রিও করে। প্রতি হাড়ি খেঁজুরের রস ৮০/১০০ টাকায় বিক্রি হয়।

বোরহানউদ্দীন কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, শুধু সরকারি ভাবেই নয়, আমরাও কৃষককে খেঁজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছি, যাতাদের মাঝে রস ও গুড়ের চাহিদা মেটাবে। ঐতিহ্যবাহী এ খেঁজুরের রস বা গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে হলে টিকিয়ে রাখতে হবে খেঁজুরের গাছের অস্তিত্ব আর সে জন্য যথাযথ ভাবে পরিবেশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাটা সহ যেকোন বৃক্ষ নিধনকারির হাত থেকে খেঁজুর গাছ রক্ষা করতে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে

আপডেট টাইম : ০৭:৩৯:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ নভেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ভোলাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শুরু হয়েছে মিষ্টি খেঁজুর রস সংগ্রহের উৎসব। গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ খেঁজুর গাছ। গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক উৎসব শুরু হয়েছে খেঁজুর গাছকে ঘিরে। প্রভাতের শিশির ভেজা ঘাস আর ঘণ কুয়াশার চাদর হেমন্তের শেষে শীতের আগমনের বার্তা জানান দিচ্ছে আমাদের।

শীত যত বাড়বে খেঁজুরে রসের মিষ্টতাও তত বাড়বে। শীতের সঙ্গে খেঁজুরের রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। খেঁজুর রস সংগ্রহকারীরা তাদের প্রস্তুতি শেষ করে গাছি, দা, নলি, কোমরবন্ধ রশি, ভাড় বা হাড়ি সংগ্রহ করে গাছ ছাঁচার কাজ শুরু করে। শীতের শুরুতে নেশার বশেই তারা ছুটে যায় রস সংগ্রহের কাজে।

বোরহানউদ্দীন উপজেলার হাসান ননগর ইউনিয়নের রস সংগ্রহকারী জানান,সাধারণত এই শীত মৌসুমেই খেঁজুর গাছ তোলা বা ছাঁচা হয়। অর্থাৎ খেঁজুর গাছ কেটে রস বের করার জায়গা করার পদ্ধতি। এর সপ্তাহ খানেক পর ঐ স্থান থেকে রস বের করার জন্য দুই পাশে দুটি চিকন নালা তৈরী করে খিলি স্থাপন এবং ভাড় বা রস রাখার হাড়ি টাঙ্গানোর জায়গা করে দিতে হবে। এরই মধ্যে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে খিলি লাগানো হয়ে গেছে কিন্তু আগের তুলনায় খেঁজুর গাছের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ইটভাটায় খেঁজুর গাছ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পরও ইটভাটার মালিকরা সবকিছু ম্যানেজ করে ধ্বংস করে চলেছে খেঁজুর গাছ। এক সময় জেলার সর্বত্রই দেখা যেত খেঁজুর গাছ। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছাস সহিঞ্চু খেঁজুর গাছের আয়ুও গড়ে প্রায় শত বছর। তাছাড়া এই গাছের কাঠের মানও ভালো। কিন্তু এটির সংখ্যা ইদানিং গুণিতক হারে কমতে শুরু করেছে।

বোরহানউদ্দীন উপজেলা কৃষি অফিস ও বিশেষ তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে প্রায় ২০ হাজার কৃষি পরিবার রয়েছে। সড়কপথ, পতিত জমি, জমির আইল ও বাড়ির আঙিনায় রয়েছে অর্ধ লক্ষাধিক খেঁজুর গাছ। একজন ব্যক্তি প্রতিদিন ১০-২০টি খেঁজুর গাছের রস আহরণ করতে পারে। এ রকম রস আহরণকারী ব্যক্তি রয়েছে ৩ হাজার। মৌসুমভিত্তিক এখানে প্রায় এক হাজার পরিবার খেজুরের রস আহরণের ওপর নির্ভরশীল। একজন গাছি এক মৌসুমে অর্থাৎ ১২০ দিনে একটি গাছ থেকে ২০-২৫ কেজি গুড় পেয়ে থাকেন।

হাসাননগর ইউনিয়নের গাছি আবুল কালাম বলেন, ২-৩ মাসের জন্য খেঁজুর গাছ ১০০-১২০ টাকায় চুক্তি নিয়ে রস সংগ্রহ করি। এগুলো গুড় তৈরি করে হাটবাজারে বিক্রি করি। এবার ১২০টি গাছ চুক্তি নিয়েছি। এই গাছগুলো থেকে আমরা দুইজন রস সংগ্রহ করব। সংসারে ৫ সদস্যের পরিবার। এর ওপর ৩-৪ মাস ভালোভাবে চলবে।

কাঁচিয়া ইউনিয়ন কাশেম মিয়া এর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার ৪ মেয়ে ও ২ ছেলে। সবাইকে বিয়ে দিয়েছি। শীত এলেই জামাই-মেয়ে, নাতি-নাতনি, ছেলেদের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আতীয়দের নিয়ে দু-এক বার উৎসবের আয়োজন করি। এই প্রথাটা আমার দাদা- পিজার আমল থেকে চলে আসছে, তাই আমিও করি। নিজেদের ৪০-৫০ টার মতো খেঁজুর গাছ আছে। এসব গাছের রস বা গুড় বাড়ির জন্য ব্যবহৃত হয়।

রস সংগ্রহকারি শাহিন বলেন, খেঁজুর গাছের গাছি নিয়োগ সাধারণত চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ করা হয় তা অনেক জায়গায় টাকার বিনিময়ে আবার অনেক জায়গায় ভাগ হিসাবে। খেঁজুর গাছ থেকে যে গুড় উৎপাদিত হয় তার দুইয়ের এক ভাগ পায় গাছি। খেঁজুরের গুড়ের মৌসুম এলেই গ্রামাঞ্চলে উৎসবের আমেজ দেখা যায়।গুড় তৈরীর জন্য আগে যেখানে জালো ব্যবহার করা হতো সেখানে এখন ষ্টীলের শীটের ট্রে যা কেবল মাত্র রস জ্বালানোর তৈরী করা হয়। রস জ্বালিয়ে গুড় বানানোর করার সময় ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা উনুনের সামনে চামচ হাতে অপেক্ষা করে গুড় খাওয়ার জন্য। শুধু গুড় নয় খেঁজুরের ফল ও কাঁচা রসের স্বাদও অতুলনীয়। যাদের বেশি খেঁজুর গাছ আছে তারা এর রস বিক্রিও করে। প্রতি হাড়ি খেঁজুরের রস ৮০/১০০ টাকায় বিক্রি হয়।

বোরহানউদ্দীন কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, শুধু সরকারি ভাবেই নয়, আমরাও কৃষককে খেঁজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছি, যাতাদের মাঝে রস ও গুড়ের চাহিদা মেটাবে। ঐতিহ্যবাহী এ খেঁজুরের রস বা গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে হলে টিকিয়ে রাখতে হবে খেঁজুরের গাছের অস্তিত্ব আর সে জন্য যথাযথ ভাবে পরিবেশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাটা সহ যেকোন বৃক্ষ নিধনকারির হাত থেকে খেঁজুর গাছ রক্ষা করতে হবে।