হাওর বার্তা ডেস্কঃ গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গাইবান্ধা-৪ আসনে কোনো দলেরই একক প্রভাব নেই। এখানকার ভোটাররা জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এমনকি ভালো প্রার্থীর কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে এমপি বানিয়েছেন। উপজেলা সদরের বুক চিড়ে চলে গেছে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এলকাটি যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ, তেমনি শিল্প সংস্কৃতি ক্রীড়ার দিক থেকেও এগিয়ে।
নব্বই-পরবর্তী নির্বাচনে এ আসন থেকে দু’বার জাতীয় পার্টি, দু’বার আওয়ামী লীগ এবং একবার বিএনপি প্রার্থী জয়লাভ করেন। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির লুৎফর রহমান চৌধুরী ১৯৯১ ও ৯৬ সালে টানা দু’বার এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর অবশ্য তিনি পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এরপর এলাকায় জাতীয় পার্টি অবস্থান কিছুটা দুর্বল হলেও সম্প্রতি দলটি বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তবে এখনও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ব্যক্তি ইমেজ প্রবল।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন চৌধুরী জয়লাভ করেন। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। তিনি ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে মনোয়ার হোসেনকে পরাজিত করেন। আবুল কালাম আজাদ আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন প্রত্যাশী।
এছাড়া আওয়ামী লীগের আরও অন্তত চারজন প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে কাজ করছেন।
বিএনপিরও একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির আবদুল মোত্তালিব আকন্দের আকস্মিক মৃত্যুর পর তার ছেলে শামীম কায়সার লিংকন উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন। তিনি ছাড়াও মনোনয়ন প্রত্যাশী আরও একাধিক প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে তৎপর রয়েছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এখনও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাউকে প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেননি। নতুন করে এলাকায় জাতীয় পার্টির হাল ধরেছেন উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক রংপুর নার্সিং ইন্সটিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ মো. মশিউর রহমান। তিনি দল গুছিয়ে মাঠে তৎপর রয়েছেন।
অবশ্য সিপিবি, ওয়ার্কাস পার্টিসহ অন্য দলগুলোও কিছুটা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। তারাও সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করছেন। সব কিছু মিলিয়ে গোবিন্দগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরগরম। নির্বাচনী হাওয়া লেগেছে উপজেলার সর্বত্র। মাঠে-ময়দানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে শোভা পাচ্ছে প্রার্থীদের নানা রঙের ব্যানার ও ফেস্টুন।
অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ ছাড়াও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র আতাউর রহমান সরকার, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মহিমাগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ প্রধান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় পাট ও বস্ত্রবিষয়ক সম্পাদক নাজমুল ইসলাম লিটন। এরই মধ্যে এলাকায় দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। তারা নানা অজুহাতে ছুটে যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে।
বিনয়ী চরিত্রের অধিকারী সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী থাকার সময় এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও প্রচুর কাজ করেন। জানতে চাইলে মনোয়ার বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি নিশ্চিত বিজয়ী হবেন।
কথা হয় বর্তমান এমপি ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে। গোবিন্দগঞ্জ আওয়ামী লীগের ভিত মজবুত করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনেক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শেষে এলাকায় ফিরে আসেন। ফুলপুকুরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। দু’বার ইউপি চেয়ারম্যান এবং ২০০৯ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগের পরই বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতেও তার বিচরণ রয়েছে।
জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গোবিন্দগঞ্জবাসীর সুুখে-দুঃখে ছিলাম, আছি।’ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করেছি। আমি থাকতে এখানে অশান্তময় পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ নেই। উন্নয়নে গোবিন্দগঞ্জের সঙ্গে অন্য উপজেলার তুলনা হবে না। প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিলে এ আসনটি পুনরায় তাকে উপহার দিতে পারব। কথা হয় জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন ফকুর সঙ্গে। তিনি বলেন, চমৎকার মানুষ আবুল কালাম আজাদের বিকল্প গোবিন্দগঞ্জ আওয়ামী লীগে নেই।
আওয়ামী লীগের আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান সরকারের বাবা দীর্ঘদিন ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। কলেজজীবনে আতাউর রহমান জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দিলে আসনটি তাকে উপহার দিতে পারব।
আসনটিতে এক সময় জাতীয় পার্টির ব্যাপক প্রভাব ছিল। তবে তিনবারের এমপি লুৎফর রহমান চৌধুরী দশম সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেও দলীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশে প্রত্যাহার করে নেন। পরে তিনি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপিতে যোগ দেন। বর্তমানে দলের হাল ধরেছেন অধ্যক্ষ মো. মশিউর রহমান। তার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠেছে। এরই মধ্যে তিনি ঘর গোছানোর কাজে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি করা হয়ে গেছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। দলের নেতারা সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি জনসংযোগেও ব্যস্ত সময় পার করছেন। তারা হারানো আসনটি ফিরে পেতে চান।
জানতে চাইলে মশিউর রহমান জানান, নেতৃত্বে দুর্বলতা এবং সাংগঠনিক তৎপরতার অভাবে দলের অস্তিত্ব ধরে রাখাই কঠিন ছিল। তিনি দলের হাল ধরার পর গ্রাম-গঞ্জ চষে বেড়িয়ে সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। দল এখন শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। গোবিন্দগঞ্জবাসী এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এবার বিজয়ী হয়ে আসতে পারে। জনগণ জাতীয় পার্টির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বন্যায় দলের পক্ষ থেকে রিলিফ কার্যক্রম ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে চিকিৎসা সেবাসহ অন্যান্য সেবা কার্যক্রম চালানো হয়। এতে দলের সুনাম বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষ দলের পক্ষে তাই একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আশাবাদী।
এ আসনে বিএনপিরও যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। শামীম কায়সার লিংকন ছাড়াও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি আবদুল মান্নান মণ্ডল, সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক কবির আহমেদ ও পৌর বিএনপি সভাপতি ফারুক আহমেদ। নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলে আবদুল মান্নান মণ্ডল বলেন, দলের চেয়ারপারসন যাকেই মনোনয়ন দিক না কেন তার পক্ষেই সব নেতাকর্মী কাজ করবেন। তবে সব কিছুই নির্ভর করবে নির্বাচনের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের ওপর। সাধারণ ভোটারদের ধারণা, সাবেক এমপি শামীম কায়সার লিংকনকে মনোনয়ন দেয়া হলে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের মঙ্গে তার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
এদিকে জামায়াত এখন কোণঠাসা। প্রকাশ্যে তাদের কোনো তৎপরতা নেই। তবে দলীয় সূত্র বলছে, জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে তাদের জেলা সভাপতি ডা. আবদুর রহিম সরকারকে তারা প্রার্থী হিসেবে চাইবেন।