হাওর বার্তা ডেস্কঃ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরে হবে। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনও হওয়ার কথা আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ। জনৈক নির্বাচন কমিশনার এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এসব নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনের একটি মহড়া হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা হবে না বিভিন্ন কারণে। প্রথমত, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের কোনো পরিবর্তন হবে না। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো বেপরোয়া উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। তারপর থাকছে ভোটকেন্দ্র ও ভোটারদের নিরাপত্তা। এসব সিটি করপোরেশনের ভোটার সংখ্যা খুবই সীমিত। আয়তনও তেমন বেশি কিছু নয়। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক সমাবেশ ঘটানো সম্ভব হবে এসব স্থানে। একধরনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থায় থাকবে মহানগরগুলো। আস্থাশীল থাকবেন পরিচালনাকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গণমাধ্যমের উপস্থিতিও হবে ব্যাপক। ভোট গ্রহণ পক্ষপাতহীন হওয়ারই কথা। নির্বাচনী আচরণবিধি যাতে ভঙ্গ না হয়, তা যথেষ্ট পরিমাণে নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে শুরুতেই রংপুরে একজন প্রার্থীর মোটরসাইকেল শোভাযাত্রায় এটা হোঁচট খেয়েছে। এসব নির্বাচনের কিছুদিন পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এ অবস্থা সামনে রেখে সরকার সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার কথা নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি একটু ফলাও করে দেখালে জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে, এ মনোভাব কাজ করতে পারে।
পক্ষান্তরে সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে গঠিত হয় সরকার। সেখানে বিজয়ী দল আমাদের দেশের সংস্কৃতি অনুসারে ‘উইনার টেক্স অল’ নীতি নেবে। চাকরি, ঠিকাদারি থেকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো ধরনের কাজের একমাত্র উপকারভোগী হবেন বিজয়ী দলের কর্মী-সমর্থকেরা। অবশ্য তাঁদের দল না করেও উপকারভোগী হবেন যাঁরা কোনো নেতা-কর্মীর সেবা করেছেন বা করবেন। বড় রকম ফৌজদারি অপরাধের মামলাও প্রত্যাহার হয়ে যাবে। সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস হবে অনেকের। পক্ষান্তরে যাঁরা হেরে যাবেন, তাঁদের রাজনৈতিক কার্যক্রম বিভিন্নভাবে বাধাপ্রাপ্ত হবে। কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে হতে থাকবে মামলা। কঠিন হবে তাঁদের চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখা। চাকরি, ঠিকাদারি এমনকি ছাত্রাবাসেও তাঁরা অচ্ছুত। কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও স্বস্তিতে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এমনই পরিবেশে এ দেশে কোনো দল কেন জয়ী হতে মরিয়া
হবে না? সে অবস্থায় দেশের প্রায় ৬০ হাজার ভোটকেন্দ্রে এক দিনে ১০ কোটি ভোটারের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা সম্ভব হবে না। প্রচলিত সাংবিধানিক ব্যবস্থায় সরকার ক্ষমতায় থাকবে। বহাল থাকবে সংসদও। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষে চলমান সংস্কৃতি অনুসারে ক্ষমতাসীন দলের অন্যায় কাজের বিপরীতে যাওয়া দুঃসাধ্য হবে। ক্ষেত্রবিশেষে অনেকেই তাদের সহায়কও হতে পারে। পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্ক যে গাঁটছড়া বাঁধা। সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অংশ হিসেবে যেভাবেই নামানো হোক, তাদের মোতায়েন করা যাবে না কেন্দ্রে কেন্দ্রে। স্ট্রাইকিং ফোর্স কিংবা মোবাইল টিম যদি অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা না পায়, তাহলে তাদেরও কার্যকর ভূমিকা রাখা কঠিন হবে।
সেসব বিষয়ে একটি দাওয়াই অনেক সময় আলোচিত হয়। তা হলো নির্বাচন কমিশনের লোকেরা এ কাজ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকলে স্বচ্ছতা অনেক বাড়বে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো চলছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁরাই থাকেন রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনেক আসনেও তাঁদেরই এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলো মোটামুটি ভালোভাবে হয়। আর নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে করা যায়। বড় সিটিগুলোতে তা-ই হয়। ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন এক দিনে হয়েছে। এ করপোরেশনগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাখা সরকারের প্রয়োজন ছিল। তারা সফল হয়েছে। এগুলোতে ভোটের ধরনও সবার দেখা। আর পৌরহিত্যে ছিলেন কমিশনের কর্মকর্তারাই। তবে জাতীয় নির্বাচন এত ব্যাপকভিত্তিক ব্যাপার যে এর সব পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করার মতো কমিশনের জনবল নিয়োগ অসম্ভব ও অপ্রয়োজনীয়। এমনিতেই এটি ভারতের নির্বাচন কমিশনের কয়েক গুণ বড় হয়ে গেছে। আরও বাড়ানোর উদ্যোগ চলছে। দলীয়করণের অজুহাতে সরকারি কর্মচারীদের আস্থাহীনতার কাতারে নেওয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও তো তাঁদের বাদ দেওয়া যাবে না। এ দেশের গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলো তো তাঁরাই করেছেন। আবার কোনো কোনো অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনও কমিশন কর্মকর্তাদের আওতাতেই হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, কমিশন গ্রহণযোগ্য না হলে এর কর্মকর্তারা অন্যদের তুলনায় কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবেন, এটা বোধগম্য নয়। আর কমিশন গ্রহণযোগ্য এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর তাদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ থাকলে সরকারি কর্মকর্তারাই সফল নির্বাচনের হাতিয়ার হতে পারেন।
রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বিগত কমিশনের সময়কালে জাতীয় নির্বাচনের আগেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। সব কটিতে সরকার–সমর্থক প্রার্থীরা হেরে যান। এটা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র মানদণ্ড নয়। তাদের সময়কালেই সফল নির্বাচনে রংপুর ও নারায়ণগঞ্জে বিজয়ী হন সরকার–সমর্থক প্রার্থীরা। সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল না। কিন্তু ঢাকার দুটি আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার মান ছিল অনেক নিচে। তবে বিরোধী দলটির প্রার্থী থাকায় কিছু ভোটার–সমাগম হয়েছিল। কিন্তু ভোট যাঁরা দেওয়ার (!) তাঁরাই দিয়েছেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন তো করল নতুন কমিশন। এটা তো সবাই মেনে নিয়েছেন। এ নিয়ে কি বলা যায়, জাতীয় নির্বাচনও একইভাবে হবে? গত কমিশন পাঁচ সিটি নির্বাচন করার পর ২০১৪ সালে কী করেছে, এটা সবার জানা। অবশ্য প্রধান বিরোধী দল মাঠ ছেড়ে দেওয়ায় সে নির্বাচন অনেকটা একতরফা হয়। কমিশন ছিল একেবারেই গা-ছাড়া। সে নির্বাচনটির আইনগত বৈধতা থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। যেখানে নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, সেখানেও ছিল না ভোটারের উপস্থিতি। তা–ও ভোট দেখানো হয়েছে লাখের হিসাবে। এর দায় সরকার, কমিশন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ও বর্জনকারী দল—সবার। খেসারত দিচ্ছে এ দেশের গণতন্ত্র।
নির্বাচন কমিশন যাঁদের সমন্বয়ে গঠিত, তাঁদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) রয়েছে মাঠপর্যায়ে সফল ও ব্যর্থ উভয় ধরনের নির্বাচন পরিচালনার অভিজ্ঞতা। সুতরাং, জাতীয় নির্বাচন সফলের জন্য তাঁদের কী করতে হবে, এটা অজানা থাকার কথা নয়। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা ঠিক করার দায়িত্ব রাজনীতিকদের। এতে কমিশনের করণীয় কিছু নেই। তবে প্রচলিত সাংবিধানিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে কমিশনের কিছু ক্ষমতা বাড়াতে হবে। যেমন নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পর বিভাগীয় কমিশনার স্তর থেকে এর নিম্ন পর্যায়ের সব প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমিশনের আওতায় চলে যান। এ ক্ষমতার পরিসরটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। তবে জনপ্রতিনিধি আদেশ সংশোধনের ক্ষমতা সংসদের। কমিশন এ মর্মে দাবি জানাতে পারে। আর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা দরকার ভোট গ্রহণের তিন মাস আগে। তা ঘোষণার পর প্রশাসন ও পুলিশের চিহ্নিত দল-সমর্থক কর্মকর্তাদের নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন পদে কিংবা মাঠপর্যায়ে দূরবর্তী কোনো স্থানে বদলি নিশ্চিত করতে হবে। তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য কমিশন সরকারের কাছে দাবি জানালে অসংগত হবে না। এর ফলে মাঠপর্যায়ে কিছুটা সমতা আসবে। এতে কমিশন সক্রিয় ও সফল হলে একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আর বিরোধী দলকেও বুঝতে হবে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কেউ তাদের জন্য লালগালিচা বিছিয়ে বসে থাকবে না। কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরেই চলতে হবে তাদের। সরকারেরও উচিত তাদের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরতে সফল নির্বাচনের পথের কাঁটা দূর করা।
শেষের কথা হলো, আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো সফলভাবে উতরানোর উদ্যোগ অবশ্যই দরকার। তবে এতে সফল হলেই জাতীয় নির্বাচনেও তা হবে, এটা মনে করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এ ধরনের টেস্ট পরীক্ষায় ভালোভাবে পাস করে ফাইনালে ফেল করেছে বিগত নির্বাচন কমিশন। আর এবারের প্রেক্ষিতটা পৃথক। গত জাতীয় নির্বাচন প্রধান বিরোধী দলের বর্জন সরকারের পাশাপাশি কমিশনকেও ভারমুক্ত করেছিল। এবার বোধ হয় তেমনটি হবে না।
আলী ইমাম মজুমদার