হাওর বার্তা ডেস্কঃ ৪০ বছর আগে থেকে আমি এই রাস্তায় বইসা ভাত বিক্রি করি। মাত্র এক টাকায় তখন মাছ-ভাতের প্যাকেজ বিক্রি করতাম। আর এহন বেচতেছি মাছ-ভাত পেট পুরে খাওন ৩৫ টাকায়।’
‘দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি, তাই এহন লাভ কম; তবু আমার অভাবী এই কাষ্টমারদের কথা ভেবে এহন বেচতাছি। আমরা না থাকলে এরা কি খাইবো’- কথাগুলো খুব আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু ষ্টেডিয়ামের তিন নম্বর গেটে সামনের রাস্তার ফুটপাতের ভাত বিক্রেতা মরিয়ম বিবির (৬২)।
মরিয়ম বিবি গত ৪০ বছর ধরে এই ফুটপাতে ভাত বিক্রি করেন। তিনি ছাড়াও এখানে রয়েছেন আরো আটজন ভাত বিক্রেতা।
গতকাল বেলা আড়াইটায় রাজধানীর রাজউক ভবনের উল্টোপাশের ফুটপাত ধরে হেঁটে আসতেই দেখা গেল ২০ থেকে ৩০ জন লোক রাস্তায় বসে হাতের তালুতে থালা রেখে ভাত খাচ্ছেন। রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি রিকশা দাঁড় করানো দেখে অনুমান করা গেল, ক্রেতা সবাই রিকশাচালক।
কথা বলে জানা যায়, স্বল্প মূল্যের হওয়ায় এদের অনেকেরই তিনবেলা খাবারের শেষ ভরসা এই সব খাবারের দোকান। রিকশা, ভ্যান ছাড়াও এখানে ক্রেতা হিসেবে আছেন কয়েকশ ছিন্নমূল মানুষ।
ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠেই ভাত-তরকারি রান্না করে খাবারসহ চলে আসেন এখানকার বিক্রেতারা। আবার পুঁজির স্বল্পতায় একেকজন ভাত বিক্রেতা ৬০ থেকে ৭০ জনের খাবার নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। এখানে রয়েছে, ৩৫ টাকা দরে মাছ-ভাতের প্যাকেজ। এ ছাড়াও রয়েছে ৩০ টাকা দরে ডিম-ভাতের প্যাকেজ। এমনটাই জানালেন ভাত বিক্রেতা মরিয়ম।
জীবন যুদ্ধে এই ভাতের ব্যবসার শুরুটা কীভাবে শুরু হলো জানতে চাইলে মরিয়ম বিবি হাওর বার্তাকে বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। আমার যতদূর মনে আছে, দেশ স্বাধীন হইছে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দিনটি ছিল গতকাল। আমার বিয়ে হয়েছে তিনদিনের মাথায় রবিবার। তার দুইদিন পর আমি স্বামীর সাথে ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় আইয়া আমরা ফকিরাপুলে একটা টিনশেড বাসায় উঠি। আমার স্বামী রিকশা চালাতো। আর এতে সংসারে ছিল টানাপোড়েন। তাই, আমি আশেপাশের ব্যাচেলারদের ভাত খাওয়ানো শুরু করি মাসভিত্তিক চুক্তিতে।
পরবর্তীতে আস্তে আস্তে এই ফুটপাতে বসে ভাত বিক্রি শুরু করি। আর যখন আমরা এখানে বসতাম তখন এই স্টেডিয়াম ছিল না। আর এখানে ছিল সরু রাস্তা। আর পাশে ছিল বন-জঙ্গল। মাঝে মাঝে শিয়াল ডাকতো এই জঙ্গলে।
এ ব্যবসায় কেমন লাভ থাকে জানতে চাইলে মরিয়ম বিবি বলেন, ‘এখন আর লাভ! কোনো মতে সমান সমান থাকে। আমার নিজের খরচটা চলে। কারণ স্বামীও মরে গেছে। ছেলেপুলেরাও বিয়ে করে যে যার মতন থাকে।’
তিনি বলেন, ‘এখন মায়া লাগে যারা আমার কাছে ভাত খায় এদের জন্য। আমি না আসলে এরা কী খাবে, এটাই এখন ভাবনা ! এদের অনেকেই আমার ছেলেপুলের মতন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে সবার সাথে কর্মব্যস্ততার মাঝে বেশ কেটে যায়। আবার রাতে গিয়ে শুরু করি রান্নার প্রস্তুতি।’
এই ফুটপাতে ভাত বিক্রিতে কোনো বাধা আছে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে মরিয়ম বলেন, হাত ধোয়ার পানি ও খাবার পানির সংকট আছে। একা মানুষ দূর থেকে টেনে আনা খুব কষ্টের কাজ। এছাড়া পুরো দিন রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ের মধ্যে ফুটপাতে বসে থাকাটাও অনেক কষ্টের !’
‘তবুও জীবন সংগ্রামের এই যুদ্ধে বেঁচে আছি এটা বলতে পারি !’ কথা শেষে চোখের কোণের ছলছল করা পানি মুছে আবারও কাস্টমারের থালায় ভাত তুলতে গেলেন মরিয়ম বিবি।